ঢাকা, শনিবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

সব বাজারেই জেলি চিংড়ি!

সৈয়দ ইফতেখার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৩৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০১৭
সব বাজারেই জেলি চিংড়ি! রাজধানীর কারওয়ান বাজারে চিংড়ি বিক্রি, ছবি, শাকিল আহমেদ

রাজধানীর কারওয়ান বাজার ঘুরে: ‘...তারপর থেকে খুবই ভয়ে থাকি। টাকা দিয়ে মরণ রোগ কেনার দশা! এদের বিশ্বাস করা যায় না। ভালোয় ভালোয় বিক্রির মধ্যেই ঢুকিয়ে দেবে জেলি বা কেমিক্যালস। আগে বুঝতাম না; একবার ধরা খেয়ে-ঠেকে শেখা’।

কথা-বার্তা, চাল-চলনে দারুণ বনেদি ভাব, থাকেনও বারিধরায় (জে-ব্লক)। গাড়ি করে নেমে পছন্দের পণ্য কিনতে কখনোই করেন না কার্পণ্য; ভাবনা নেই অর্থ খরচেও।

শাহাদাত হোসেন আফজাল তার নাম; পেশায় ব্যবসায়ী।

সাত থেকে আট মাস আগে আড়াই কেজি জেলি চিংড়ি কিনে ধরা খাওয়ার গল্পের বর্ণনা দিচ্ছিলেন তিনি।

সেবার চিংড়ি কেনেন বাড্ডা এলাকার একটি খুচরা দোকান থেকে। শঙ্কার কথা জানিয়ে তার বক্তব্য ছিল এমন, জেলি চিংড়ি শুধু বিদেশের বাজারে নয়; দেশের বাজারের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়েছে। বিষ ঢুকছে রন্ধ্রে রন্ধ্রে; এতে বৈদেশিক মুদ্রায় যেমন বাংলাদেশ পেছাচ্ছে, তেমনি স্বাস্থ্যখাতেও দেখা দিচ্ছে বিরূপ প্রভাব।
রাজধানীর কারওয়ান বাজার মৎস্য আড়তের বাইরে দাঁড়িয়ে দীর্ঘক্ষণ কথা হয় তার সঙ্গে। স্বাভাবিক কেনাকাটায় মগ্নতার মাঝেই সোনালী মৎস্য আড়তদার বহুমুখী সমবায় সমিতির ক্যাপিটাল ফিস আড়তের মালিক সবুজ হাসানের তথ্যে তাক লাগানো উপক্রম। তিনি হলফ করে বললেন, জেলির অস্তিত্বের কথা।

তিনি বললেন, বছরখানেক আগের অভিযান-জরিমানার জেরে রাতের আঁধারে কাজ হয় এখন। দক্ষিণাঞ্চলের কিছু মাল ভোররাতে এফডিসি (বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন) সংলগ্ন সড়কে নামানো হয়, এগুলো মূলত চলে যায় আবদুল্লাহপুর, কাপ্তান বাজার, যাত্রাবাড়ী, গুলিস্তানে।

জেলি চিংড়ির মূল সরবরাহ শুধু কারওয়ান বাজার নয় বলেও জানান তিনি। এমন চিংড়ির সরবরাহ রয়েছে সোয়ারীঘাট, শ্যামবাজারেও।
কারওয়ান বাজারে বিক্রেতার হাতে গলদা চিংড়ি, ছবি: শাকিল আহমেদঅনুসন্ধানে জানা যায়, পুরো ঢাকায় একটি চক্র কাজ করে যারা দক্ষিণাঞ্চল অর্থাৎ খুলনা-সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের অপদ্রব্যের চিংড়িগুলো স্থানীয় মার্কেটে প্রতিষ্ঠা করে। আড়তদারদের ভাষায় এদের বলা হয় চারমুখী চক্র/সিন্ডিকেট। এই চক্রের মূল অংশ উৎপাদনকারী; (প্রথম অংশ) যারা কিনা ঘের মালিক। (দ্বিতীয় অংশ) এরপরে স্থানীয় আড়তদার বা পার্টি। (তৃতীয়) তারপর পাইকার (ঢাকা কিংবা অন্য কোনো বড় শহরের)। (চতুর্থ) সবশেষ পর্বে খুচরা ব্যবসায়ী। অবশ্য পঞ্চম পর্ব ধরে ক্রেতাদেরও এই ‍অংশে সামিল করা যায়।

চক্রগুলোর কাজের ধাপ
তারা কাজ করেন সমঝোতার ভিত্তিতে। সব চিংড়িতে যে অপদ্রব্যের মিশ্রণ হয় তা কিন্তু নয়; তবে কম মূল্যে চিংড়ি বিক্রি এবং বিশেষ কিছু চাহিদার ভিত্তিতে এগুলো মেশানো হয়। যার মূল কাজটা করেন স্থানীয় পার্টির লোকজন, যারা ঘের থেকে সরাসরি মাছ কেনেন। পার্টির লোকেরাই ইঞ্জেকশন পুশ করান, পরে ঢাকাসহ বড় শহরে পাঠিয়ে দেন। এখানে এসে এর একটা পাঁচ মিশালি প্রক্রিয়াকরণ হয়। ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র লটে খুচরা বাজারে পৌঁছায়।

মৎস্য আড়তদার ও মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মোশাররফ হোসেন দাবি করলেন, পরিস্থিতি ‍অন্তত তার কারওয়ান বাজারে নিয়ন্ত্রিত। নেই কোনো চক্র বা সিন্ডিকেট। বলেন, সংগঠনের মাধ্যমে নোটিস, চিঠি দেওয়া আছে। এমন কোনো অভিযোগ পেলে সদস্যপদ বাতিল হবে। অধিদফতরের সঙ্গে যৌথ কমিটির ভিত্তিতে কাজ করা হচ্ছে। এরপরও যদি কেউ গোপনে এই বাজারে চিংড়ি নিয়ে আসেন, হতে পারে; এটা তার ব্যাপার।

জেলি মিশালে কী লাভ
সেখানকার পাইকার জগদীশ বালু জেলি চিংড়ির লাভের বিষয়ে জানান, প্রতি কেজি মাছে কম করে একশ গ্রাম করে জেলির ব্যবহার করা হয়। সাধারণ চিংড়ি পাঁচশ টাকা করে কেজি ধরা হলেও অপদ্রব্যের চিংড়ির দাম কমে দাঁড়ায় ৪২০-৪৩০ টাকা। পাইকারদের জন্য এর ক্রয় মূল্য আরও কমে ৩৮০ থেকে ৪০০। তাতে বিক্রি-বাট্টা ভালো; ওজনে লাভ।
 
খাজা গরিবে নেওয়াজ মৎস্য ভাণ্ডারের কর্ণধার মিজানুর রহমান মিজান বাংলানিউজকে বলেন, নদীর চিংড়ির মূল্য তুলনামুলক বেশি হয়; সেখানকার চিংড়ির রঙও হয় ঘোলা। এই মাছের হাজারের নিচে কেজি মেলা ভার। ক্রেতারাও উচ্চ শ্রেণির। এগুলোতে জেলির ব্যবহার নেই বললেই চলে।
ভোরে সদ্য দক্ষিণাঞ্চল থেকে ঢাকায় আনা চিংড়ি, ছবি: শাকিল আহমেদঅনুসন্ধান সূত্রে কথার মিল পাওয়া গেলো পাশের নিউ মার্কেটের পাইকারি মৎস্য আড়তে গিয়ে। তবে দোষ শোনা গেলো ক্রেতাদের কোটেও।

এখানে কথা হয় এক ব্যসায়ীর সঙ্গে। নাম প্রকাশ না করার স্বার্থে তিনি বলেন, দোষ তো ক্রেতাদেরও। তারা খালি চকচকে মাছের অংশীদার হতে চান; একটু লালচে কিংবা নরম মাছে আগ্রহ থাকে না বললেই চলে। ভালো মাছ কিনলে দাম দিয়েই কিনতে হবে; আর এতেই ধীরে ধীরে উৎপাদন আরও বাড়বে দামও লাগাম আসবে বলে মনে করি।

তিনি জানান, এক কেজি মাছে আধা কেজি ভালো মাছ আর বাকি আধা থাকে জেলি মিশ্রিত। কারওয়ান বাজারেও এই ব্যবসা হচ্ছে, সেখান থেকে তা চলে যাচ্ছে খুচরা পর্যায়ে বিক্রির জন্য।

অতি সম্প্রতি নিউ মার্কেটের জেলি মিশ্রিত মাছের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, চোখের আড়ালে কত মাছই চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে, তবে কিছু দিন আগে এই মার্কেটে এমন মাছ ধরা পড়ে, যা এসেছিল কারওয়ান বাজার থেকেই। পরে থানা-পুলিশের মাধ্যমে বিষয়টি সুরাহা হয়।

জেলি মিশ্রিত মাছের বিক্রয় এবং সরবরাহ নিয়ে মৎস্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা জড়িত বলেও দাবি জুড়লেন তিনি। বললেন, সেখানে কর্মচারীদের একটি সিন্ডিকেট আছে যারা কিনা তথ্য পেয়েও অভিযানে যান না; বিনিমিয়ে টাকা নেন। যাতে লাই পান অসাধুরা।

এদিকে ক্রেতারা অভিযোগ করেন, ভালো চিংড়ির দাম অতিরিক্ত আকারে রাখা হচ্ছে জেলি চিংড়ির ছুতায়। ফলে দুই পক্ষেরই লাভ। যারা জেলি দিচ্ছেন তারা ওজনে এবং যারা জেলি দিচ্ছেন না তারা কেজিতে তিন শ’ থেকে শ‘ চারেক টাকা লাভ করছেন।

আর বাছ-বিচার কম কিংবা অসচেতনতা- এতে কম দামের চিংড়ির চাহিদা নিম্ন শ্রেণির মানুষের কাছে। এছাড়া ঢাকার হোটেলগুলোতে রাঁধা হচ্ছে জেলি চিংড়ি; এ নিয়ে আরও একটি চক্র বেশ সক্রিয়ও বটে।

** ‘৬শ’র মাল সাড়ে ৩শ’তে লইবেন, জেলি তো থাকবোই’
** বাইছা লন, ক্যানসার ছাড়া লন
** সব বাজারেই জেলি চিংড়ি!
** কাপড়ের বিষাক্ত নীলে চকচকে চিংড়ি
** শক্ত খোলসেই পোয়াবারো চিংড়ি ভেজালিদের
** চিংড়ি ভীতিতে ক্রেতা-ভোক্তা!
** চিংড়িতে জেলি আতঙ্কে মাছ ব্যবসায়ীরাও
** কিভাবে কী মেশে চিংড়িতে
** এ যেন টাকা দিয়ে মৃত্যু কেনা !
 ** মোসলেম চেনালেন ভেজাল চিংড়ি

বাংলাদেশ সময়: ১৭৩৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০১৭
আইএ/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।