ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

অ-সংক্রামক রোগে অসহায় কোটি মানুষ!

মফিজুল সাদিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩৫৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৯, ২০১৮
 অ-সংক্রামক রোগে অসহায় কোটি মানুষ! অ-সংক্রামক রোগে অসহায় কোটি মানুষ! ছবি: বাংলানিউজ

ঢাকা: জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে পুরুষ ওয়ার্ডের ফ্লোরে কাতরাচ্ছেন সুধীর চন্দ্র শীল(৬০)। হার্টের সমস্যা নিয়ে গত ০১ এপ্রিল চাঁদপুরের মতলব থেকে এই হাসপাতালে এসেছেন তিনি। পেশায় সেলুনকর্মী।

সম্পদ বলতে তিন কাঠা বসতভিটা। পাড়া-প্রতিবেশীদের কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা নিয়ে চিকিৎসা নিতে এখানে এসেছেন সুধীর।

সঙ্গে এসেছেন স্ত্রী গীতা রাণী শীল ও পুত্র অধীর চন্দ্র শীল।  এরই মধ্যে বিভিন্ন পরীক্ষা ও থাকা খাওয়ার পেছনেই ২০ হাজার টাকা শেষ হয়ে গেছে।

ডাক্তার প্রাথমিকভাবে জানিয়েছেন, হার্টে ছিদ্র।  সুস্থ হতে লাগবে এক লাখ ৫৫ হাজার টাকা।   দ্রুত সময়ে অপারেশন করতে হবে।  ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনে হার্টের বাইপাস সার্জারি করাতে হবে।  একথা শুনে মাথায় হাত স্ত্রী গিতা রাণী শীলের।  এতো টাকা এক সঙ্গে সংগ্রহ করার সামর্থ্য নেই।

শুধু গীতা রাণী শীলের স্বামী অধীর শুধু নন, তার মতো হাজারও মানুষ ভুগছেন এইসব রোগে।  স্বল্প আয়ের পরিবারের পক্ষে চিকিৎসা নেয়া কঠিন।

শুধু জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল নয়, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনেও হতদরিদ্রদের ভিড়।  ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনে কাগজপত্র নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছেন কবির আহমেদ(৩৮)।  গুলশান-২ নম্বরে তিনি গার্ডের কাজ করতেন।  স্ত্রী রহিমা, সন্তান ইমরান হোসেন, কামরুল হোসেন ও কামরুননেসাকে নিয়ে কড়াইল বস্তিতে বসবাস করেন তিনি।  প্রায় পাঁচ বছর আগে ভোলার লালমোহন থেকে ঢাকায় এসেছে এই পরিবার।

কড়াইল বস্তিতে দুই হাজার টাকা ঘর ভাড়া, সঙ্গে প্রতিমাসে সংসারের খরচ আরও ৪ হাজার টাকা।   এখন কবির আহমেদের স্ত্রী রহিমা বাসাবাড়িতে বুয়ার কাজ করেন। ব্যয়বহুল রোগ নিয়ে বিপাকে কবির।

কবির আহমেদের তথ্য অনুসারে কড়াইলবস্তি সরেজমিন ঘুরে এরকম অনেক রোগী দেখা গেছে।  কড়াইল বস্তির সামছুন নাহার ৩৫) কিডনি রোগে আক্রান্ত।  প্রায় ৫ বছর ধরে ডান পাশের কিডনিতে সমস্যা।  বর্তমানে এই কিডনি প্রায় অকেজো।  বাঁ পাশের কিডনিও ভালো কাজ করে না। গুলশানে জনৈক শহিদুল হোসেনের বাসায় প্রায় ১৫ বছর ধরে বুয়ার কাজ করেন। সেই শহিদুল একবার অ্যাপোলো হাসপাতালে সামছুন নাহারকে চিকিৎসা করিয়েছিলেন।  প্রায় বছর দেড় হলো মারা গেছেন শহিদুল।  এখন সামছুন নাহারের পাশে দাঁড়াবার কেউ নেই।

স্বামী হোসেন আলী কোনো রকম রিকসা চালিয়ে সংসারের ভার সামাল দিচ্ছেন। গরিব স্বামীর পক্ষে কিডনি প্রতিস্থাপন করা সম্ভব নয় বলে কান্না জড়িত কন্ঠে জানান সামছুন নাহার।  সামছুন নাহারের জন্মস্থান কিশোরগঞ্জেন নিকলীতে।

সামছুন নাহার বলেন, দুইটা কিটনি(কিডনি) নষ্ট।  একন ট্যাকার অভাবে ওষুধ কিনতে পারি না।  তিন মাস পরপর পরীক্ষা করতে বলে।  এখন তো ওষুধই খাইতে পারি না পরীক্ষা করবো ক্যামনে।  ডান সাইডের কিটনিটা এক্কেবারে শুকাই গ্যাছে গা, বাম সাইডেরটা কোনো রকম আছে।  এখন মরণ ছাড়া উপায় নাই। ’

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, এসব রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ডায়াবেটিস ছিল। নিয়মিত ধূমপান করতেন, পানে জর্দাও খেতেন অনেকে।

অ-সংক্রামক রোগ প্রতিরোধের উপায়

ধূমপান অথবা তামাক পরিহার করা। সপ্তাহের অধিকাংশ দিন আধ ঘণ্টার করে হাঁটা ও হালকা ব্যায়াম করলে এই রোগে উপকার মিলবে।  স্বাস্থ্যকর ও পরিমিত খাবার হৃদযন্ত্রকে সুরক্ষা দেবে । অসংক্রামক রোগ থেকে মুক্তি পেতে চর্বি  ও লবণযুক্ত খাবার কম খাওয়া এবং বেশি করে সব্জি, ফল, দানাদার শস্য, কম চর্বিযুক্ত দুগ্ধজাত খাবার খাওয়া জরুরি। কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখাও জরুরি।  

নিয়মিত শরীর চর্চার অনেক উপকার রয়েছে ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে এটি ওজন কমাবে, রক্তে শর্করার পরিমাণ কমিয়ে আনবে, আর ইনসুলিনের সক্রিয়তাকে বাড়িয়ে রক্তে শর্করার পরিমাণ মাত্রার মধ্যে রাখবে ।

এই বিষয়ে কার্ডিওলজি (হৃদরোগ) বিশেষজ্ঞ ও  জাতীয় হৃদরোগ  ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের অধ্যাপক ডাক্তার নজরুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, আগে সংক্রামক রোগ নিয়ে ভয় করতাম।  কিন্তু এখন অসংক্রামক রোগ, ডায়াবেটিক, উচ্চ রক্ত চাপ, ইউরিক এসিড, গ্যাসট্রিক, কিডনিরোগ, হৃদরোগ, ক্যান্সার, হাঁপানি ও আর্থরাইটিস্ ভয়ের কারণ।  তবে মনে রাখতে হবে অসংক্রামক রোগে আমরা নিজেরাই সৃষ্টি করি। খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন ও একটু সচেতন হলে এইসব রোগের ঝুঁকি থেকে মুক্তি পেতে পারি।  ধূমপান ও জাঙ্ক ফুড থেকে দূরে থাকতে হবে।  আমরা মডার্ন হয়ে গেছি গাড়িতে চলতে অভ্যাস্ত হয়ে গেছি।  প্রতিদিন ৪০ থেকে ৪৫ মিনিট পায়ে হাঁটতে হবে। সুগার ও কোলস্টোরেল লেবেল কমিয়ে আনতে হবে।  প্রতিনিয়ত স্বাস্থ্যপরীক্ষা করাও জরুরি।  এই কাজগুলো করলে অসংক্রামক রোগ থেকে পরিত্রাণ মিলবে বলে আমি মনে করি।

অসংক্রামক রোগ নিয়ে গবেষণা করছে আইসিডিডিআরবি'র (ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ডায়ারিয়াল ডিজিজ রিসার্চ,বাংলাদেশ)।  আইসিডিডিআরবি সূত্র জানায়, এগুলোকে অসংক্রামক রোগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হ্নদযন্ত্রের রোগ, ক্যান্সার, উচ্চ রক্তচাপ, ফুসফুসের রোগ এবং ডায়াবেটিস।   বাংলাদেশে প্রায় ৬১ শতাংশের অধিক অসংক্রামক রোগে মারা যায়। এদের বড় একটা অংশ হৃদরোগ, ডায়াবেটিস ও ক্যান্সারে আক্রান্ত।

আইসিডিডিআরবি’ সূত্র জানায়, দেশে ৫০ লাখ মানুষ ডায়াবেটিসে ভুগছেন। আর উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ।  দেশে ১০ থেকে ১১ লাখ মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত ৫ বছর বা তার বেশি বয়সীদের ৯৪ শতাংশই কমপক্ষে একটি অসংক্রামক রোগের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছেন পুষ্টিবিজ্ঞানী ও আইসিডিডিআরবি’র গবেষক সোহানা শফিক।

এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বর্তমানে বিভিন্ন রোগের কারণে মারা যাওয়াদের মধ্যে ৬০ শতাংশই মারা যাচ্ছেন অসংক্রামক রোগে। আগে কমিউনিকেবল (সংক্রামক) রোগে বেশি মানুষ মারা যেতেন।  এখন বেশি মানুষ মারা যান নন-কমিউনিকেবল বা অসংক্রামক রোগে।  উচ্চবিত্ত শ্রেণীর মানুষের মধ্যে এই রোগ বেশি বলে আগে আমাদের ধারণা ছিলো।  কিন্তু গবেষণা করে দেখেছি, নগরায়নের ফলে দরিদ্র মানুষের মধ্যে নন-কমিউনিকেবল রোগ বাড়ছে।  খাবারে প্রচুর লবণ খাওয়া ও পরিমিত শাক-সবজি ও ফলমূল না খাওয়ার কারণে দরিদ্রদের দেহে বাড়ছে এই রোগ।  এদের খাবারে বৈচিত্র থাকে না, ফলে শুধু ভাত খেয়ে পেট ভরতে হয়, এতে কার্বোহাইড্রেডের পরিমাণ বাড়ে।  বাড়ে নানা রোগ।  ফলে নন-কমিউনিকেবল রোগ এসব পরিবারকে আর্থিকভাবে ধ্বংস করে দেয়।  সবাইকে এখনই সচেতন হতে হবে।  নিয়মিত শাক-সবজি ও ফলমূল খেতে হবে।  নিয়মিত হাঁটাচলাসহ ধূমপান ও তামাক ছাড়তে হবে।  তবেই আমরা নন-কমিউনিকেবল ডিজিজ থেকে রক্ষা পাবো।

সরকার ম্যালেরিয়া, ডায়রিয়া, কলেরা, কালা জ্বর,  কুষ্ঠ, গুটিবসন্ত, গোদ রোগ, দাদ,  ডেঙ্গুজ্বর, ধনুষ্টঙ্কার ও  যক্ষ্মার মতো রোগ বা সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে।  সরকার বিনামূল্যে এসব রোগের চিকিৎসাও দিচ্ছে।  অথচ অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে তেমন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।  সংক্রামক রোগ নিরাময়ে বিনামূল্যেচিকিৎসা সেবা দেয়া হলেও  অসংক্রামক রোগে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয় না।

এই বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক(রোগনিয়ন্ত্রণ) সানিয়া তহমিনা বলেন, সরকার সংক্রামক রোগ নির্ণয়ে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে।  ম্যালেরিয়া, ডায়রিয়া, কলেরা, কালাজ্বর,  কুষ্ঠ, গুটিবসন্ত, গোদ রোগ,  ডেঙ্গুজ্বর, দাদ ও ধনুষ্টঙ্কার নিয়ন্ত্রণে বিনামূল্যে চিকিৎসা দিচ্ছে।  তবে অসংক্রামক রোগ নির্ণয় ও বিনামূল্যে চিকিৎসার বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে বলে আমার জানা নেই।

অসংক্রামক রোগের বিষয়ে সরকারকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডাজাফরুল্লাহ চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, অসংক্রামক রোগে গরিব-ধনি সবাই অসহায়।  সরকারকেই প্রথমে এগিয়ে আসতে হবে।  গরিব মানুষকে ভর্তুকি দিয়ে এনসিডি’র( নন-কমিউনিকেবল ডিজিজ) চিকিৎসা দিতে হবে।  সবার জন্য ওষুধের দাম কমাতে হবে।  ওষুধের ক্ষেত্রে ভর্তুকিও বাড়াতে হবে।  এটা না করলে সাধারণ মানুষ অসংক্রামক রোগের কাছে আত্মসমর্পণ করবে, জীবন নীরবে বিলিয়ে দেবে।

বাংলাদেশ সময়: ০৯৫৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৯, ২০১৮
এমআইএস/জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।