ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা?

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৩৭ ঘণ্টা, জুলাই ২১, ২০১৯
স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা? ফাইল ছবি

ঢাকা: সরকারের সব মন্ত্রণালয়ের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এর কার্যক্রম দেশের প্রতিটি মানুষের সঙ্গেই ওতপ্রোতভাবে জড়িত বলে মত বিশেষজ্ঞদের। তবু, অসংখ্য প্রশ্ন রয়েছে জনগুরুত্বপূর্ণ এ খাত নিয়ে।

সম্প্রতি দেশের স্বাস্থ্য খাত সম্পর্কে মতামত জানতে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলেছে বাংলানিউজ।  

স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, প্রায় এক কোটি মানুষ দেশের বাইরে অবস্থান করেন।

কিন্তু, ‘মাইগ্রেন্ট হেলথ’ নিয়ে আমাদের মাথাব্যাথা নেই। অনেক সময় তারা নতুন নতুন রোগ নিয়ে দেশে ফিরছেন। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ও আওয়ামী লীগ সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখ্য বিষয়গুলো অর্জন করতে পারলে আমরা অনেক বেশি এগিয়ে যাবো। তবে, কার্যক্রমের আধুনিকায়ন করতে হবে। যেমন, মনিটরিং কার্যক্রম টেলিফোনে সম্পাদন করা যাবে না। আলাদা ব্যবস্থাপনা থাকতে হবে। যে পরিমাণ মানুষ রয়েছে, সে পরিমাণ হাসপাতাল নেই আমাদের। তাই গ্রামাঞ্চলের হাতুড়ে ডাক্তারদের কাজে লাগাতে হবে। তারা অনেক সময় সমস্যা সৃষ্টি করলেও, এমনিতে অনেক অবদান রাখছেন। তাদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়ে নিবন্ধিত করা যেতে পারে।
 
তিনি বলেন, দেশের স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে অবশ্যই ২০২১ সাল পর্যন্ত পরিকল্পনা নিতে হবে। খাত-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে হবে। এটা অধিদফতরের মহাপরিচালক থেকে শুরু করে সচিব পর্যন্ত করতে হবে। নাহলে, তারা করণীয়গুলো কী, তা বুঝতে পারবেন না। হাসপাতাল ও কেয়ার সেন্টারসহ স্বাস্থ্যসেবা দানকারী প্রতিষ্ঠানে শতভাগ উপস্থিতি নিশ্চিতের পাশাপাশি সেবা গ্রহীতাদের সঙ্গে আচরণ ভালো করতে হবে। আমাদের অনেক অভিজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞ জনবল রয়েছে, যারা নিয়মানুসারে অবসর গ্রহণের পরও কাজ চালিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখেন। তাদের বিশেষ ব্যবস্থাপনায় কাজে লাগাতে হবে। এছাড়া, পরিকল্পনা অনুসারে কার্যক্রম বাস্তবায়নে প্রতিটি স্তরে আলাদা কমিটি করে কাজ ভাগ করে দিতে হবে।
 
স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক লাইন ডিরেক্টর ও বর্তমানে জাতিসংঘ তহবিলের (ইউএনএফপিএ) সিনিয়র উপদেষ্টা ডা. এসএজে মো. মুসা বাংলানিউজকে বলেন, হাসপাতালগুলোর অ্যাম্বুলেন্স সহজলভ্য করতে হবে ও এর সংখ্যা আরও বাড়াতে হবে। দেশে এমনিতেই অ্যাম্বুলেন্স সংকট, তার ওপর অনেক অ্যাম্বুলেন্স নষ্ট হয়ে পড়ে থাকে। এ বিষয়ে জরুরি ভিত্তিতে নজর দিতে হবে। এ জন্য গাইডলাইনের প্রয়োজন। সরকারি কাজের অগ্রগতির হার খুব মন্থর। কোনো প্রকল্প বা অর্ডারের প্রস্তাবনা দেওয়া হলে, অনেক সময় মন্ত্রণালয়ে এ বিষয়ে দেরিতে মিটিং হয়, আবার অনেক সময় মিটিং হলেও কোনো লাভ হয় না। আবার, হাসপাতালের একেকটি বিভাগে কতজন করে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক ও অধ্যাপক কর্মরত থাকবেন, সে বিষয়ে সরকারি প্রজ্ঞাপন থাকা জরুরি। এর অভাবে সেবা দানকারীদের সঠিক অবকাঠামো সৃষ্টি হচ্ছে না, ফলে মানসম্মত সেবা নিশ্চিত হচ্ছে না।

তিনি বলেন, হাসপাতালে জরুরি সেবা ও সাধারণ সেবার মধ্যে অনেক পার্থক্য। এ বিষয়ে চিকিৎসকদের আরও বেশি জানাতে হবে। আবার, অনেক উন্নয়ন কাজ শুধু ঢাকাতেই হয়, এর বাইরে হচ্ছে না। সেগুলো সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে হবে। অনেক গবেষণার কাজে বিশ্বব্যাংক সহায়তা করলেও, আমরা তা সম্পন্ন করতে পারি না। আবার, গবেষণা যা হচ্ছে, তার ফলাফলের বাস্তবায়ন নেই। যদিও, বাস্তবায়ন করার মতো অবস্থা আমাদের আছে।
 
স্বাস্থ্য অধিদফর সম্পর্কে ডা. এসএজে মো. মুসা বলেন, এ অধিদফতরে বিভিন্ন পদে সঠিক লোককে বসানো হয়নি। যেমন, আইনি জটিলতা মোকাবিলায় কর্মরত একজন চিকিৎসক, যিনি এসব বিষয়ে কিছুই বোঝেন না। এখানে আইনজীবী দরকার। একজন সিভিল সার্জন একজন চিকিৎসকের বেতন কাটার ক্ষমতা রাখেন না। তাহলে, অপরাধ করলে শাস্তি দেবেন কে? একই কাজের অঞ্চলভেদে ভিন্ন ভিন্ন খরচ রয়েছে। এক্ষেত্রে একই খরচ নির্ধারণ করা জরুরি। হাসপাতাল লাইসেন্সিংয়ে প্রয়োজনীয় সংখ্যক জনবল নেই। সেখানে মনিটরিং খুবই কষ্টসাধ্য বিষয়। এছাড়া, অধিদফতরের অডিট টিম আরও শক্তিশালী করতে হবে। অধিদফতরের এনজিও মনিটরিং সেল নেই, এটা খুবই দরকার।
 
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হেলথ ইকনোমিকস বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এস এ হামিদ বাংলানিউজকে বলেন, জনগণের জন্যই ন্যাশনাল হেলথ ইন্স্যুরেন্স করাটা জরুরি। এজন্য আমরা প্রতিটা মোবাইল অপারেটরের মাধ্যমে সব গ্রাহকের কাছ থেকে মাত্র দুই টাকা করে কেটে নিতে পারি। এ টাকাগুলো বিভিন্ন ব্যয়বহুল চিকিৎসা, যেমন- ক্যান্সার, হার্ট ও কিডনি রোগীদেরকে দিতে পারি। দেখা যায়, যেসব দেশে ন্যাশনাল হেলথ ইন্স্যুরেন্স আছে, তাদের জিডিপি অনেক বড় আকারের। তাই, এ কাজটা করলে পুরো দেশ সব দিক থেকেই এগিয়ে যাবে।

তিনি বলেন, বর্তমানে বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে যে বরাদ্দ রয়েছে, তা যদি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা হয়, তাও অনেক সমস্যা দূর হবে। এদিকে আগে নজরদারি বাড়াতে হবে, যাতে বাজেট অখাতে ব্যয় না হয়। তবে, স্বাস্থ্য খাতের বাজেট প্রণয়নে ব্যপক দুর্বলতা আছে। কেননা, প্রয়োজনের তুলনায় সঠিক পরিমাণ বাজেট দেওয়া হচ্ছে না। অনেক জায়গায় বরাদ্দ বাড়ানোর সুযোগ থাকলেও, শুধু নজরদারির অভাবে বাজেট বাড়ছে না। আবার, ২৫০ বেডের হাসপাতালে অনেক বেশি পরিমাণ রোগী থাকছে, ফলে বরাদ্দ টাকায় টান পড়ছে।
 
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশের শেয়ার প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ও বিজ্ঞানী ইকবাল আনোয়ার বাংলানিউজকে বলেন, পাবলিক হেলথ বিষয়ে আমরা যথেষ্ট উদাসীন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে, আমাদের ১ লাখ ৬০ হাজার চিকিৎসক লাগবে। কিন্তু, ১৯৭২ সাল থেকে এ পর্যন্ত মাত্র ৯৫ হাজার চিকিৎসক বিএমডিসির রেজিস্ট্রেশন নিয়েছেন। দেশে বর্তমানে ৮০ হাজার চিকিৎসক আছেন। এর মধ্যে, সরকারিভাবে আছেন ২৬ হাজার। বেকার বসে আছেন প্রায় ৪০ হাজার চিকিৎসক। তাদের কাজে লাগাতে হবে। নতুন নতুন হাসপাতাল হচ্ছে, কিন্তু চিকিৎসক নেই। এখানে চিকিৎসা শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। বিশেষ করে প্রাইভেট মেডিক্যাল ব্যবস্থাপনায় সবচেয়ে বেশি নজর দেওয়া দরকার।
 
তিনি বলেন, সবচেয়ে মারাত্মক বিষয় হচ্ছে, ৯৪ দশমিক ৪ শতাংশ চিকিৎসক সরকারি-বেসরকারিভাবে ডুয়েল প্র্যাকটিস করেন। আমাদের চিকিৎসকদের ক্যারিয়ারের নির্দিষ্ট পথ নেই। কয়েকটা ডিগ্রি নিয়ে পরিচিত হতে পারলেই টাকা উপার্জন করা যায়। তাই, অনেকেই বেশি কাজ বা পড়াশোনা করতে চান না। আমি বলবো, ৩৯তম বিসিএসের সব চিকিৎসককে উপজেলা পর্যায়ে রাখা উচিৎ। আমাদের হেলথ সার্ভিসেস কমিশন দরকার।  

বাংলাদেশ সময়: ০৯৩৫ ঘণ্টা, জুলাই ২১, ২০১৯
এমএএম/একে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।