বৃহস্পতিবার (২৫ জুলাই) সকাল ১০টা পর্যন্ত ঢামেক হাসপাতালের নথি অনুযায়ী দেখা যায়, ৪৫৬ জন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগী এ হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। এদের মধ্যে ১১২ জনই গত ২৪ ঘণ্টায় ভর্তি হয়েছেন।
ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে জুলাই মাসেই ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এক হাজার ১৬৪ জন। এদের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ৩ জনের। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে এ বছরের ফেব্রুয়ারি ছাড়া বাকি মাসগুলোসহ জুলাই মাস পর্যন্ত মোট ভর্তি হয়েছিল এক হাজার ৩২১ জন। এদের মধ্যে চারজনের মৃত্যু হয়। তারা হলেন- ফরিদপুরের রাবেয়া (৫০), রাজধানীর আজিমপুরের ফাতেমা (৪৩), এলিফেন্ট রোডের নাসিমা (৩৩) ও ডেমরার সারুলিয়ার রাজু (২০)।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢামেকের এক অধ্যাপক বাংলানিউজকে বলেন, প্রতিদিনই নদীর স্রোতের মতো হু হু করে ডেঙ্গু রোগী আসছে হাসপাতালে। এত রোগীকে হাসপাতালে রেখে চিকিৎসাসেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তাই রক্ত পরীক্ষার পর যাদের ডেঙ্গু অস্তিত্ব প্রাথমিক অবস্থাতেই পাওয়া যাচ্ছে, তাদের ব্যবস্থাপত্রসহ বাসায় বিশ্রামে থাকার পরামর্শ দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। ফলে এসব রোগীর কোনো সঠিক হিসাব আমাদের কাছে নেই। তবে যেই রোগীর রক্তে প্লাটিলেট কম, তাদের হাসপাতালে ভর্তি রাখা হচ্ছে।
স্বামী ও দুই সন্তানকে নিয়ে পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোড এলাকার একটি ভাড়া বাসায় থাকেন হামিদা খাতুন জেসমিন (২৭)। গত তিন দিন যাবৎ তার জ্বর। স্বামী শরিফুল ইসলাম আগেই জেসমিনের রক্ত পরীক্ষা করিয়েছেন। সেই রিপোর্টসহ স্ত্রীকে নিয়ে বৃহস্পতিবার সকালে ঢামেক হাসপাতালে আসেন শরিফুল। সে সময় জেসমিনেরও ডেঙ্গু হয়েছে বলে জানায় হাসপাতালের জরুরি বিভাগে কর্তব্যরত চিকিৎসক। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে হওয়ায় তাকেও ব্যবস্থাপত্র দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। কারণ বাসায় বিশ্রাম নিলে তিনি সুস্থ হয়ে যাবেন বলে আশা করছেন কর্তব্যরত চিকিৎসক।
অন্যদিকে ঢামেক হাসপাতালের নতুন ভবনের কয়েকটি ওয়ার্ড ঘুরে দেখা যায়, সব ওয়ার্ডেই ডেঙ্গু রোগীর সয়লাব। এদের মধ্যে কাউকে স্যালাইন দেওয়া হচ্ছে, আবার কেউ শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে।
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালের নতুন ভবনের ৬০১ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আরিফুল সরদার (১৯)। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, আমি ঢাবির সলিমুল্লাহ মুসলিম (এসএম) হলের ৮৫ নম্বর রুমে থাকি। তিন দিন ধরে জ্বর, শরীরে ব্যথা আর বমি হচ্ছিল। আজ রক্ত পরীক্ষার পর জানতে পারি যে, আমিও ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছি।
যাত্রাবাড়ীর রায়েরবাগ এলাকার বাসিন্দা এক সন্তানের জনক পিকআপ ভ্যানচালক মো. বেলাল হোসেন (৩৫)। তিনিও ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে ঢামেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, আমি দিন আনি, দিন খাই। এক সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে ওই এলাকায় বাসা ভাড়া করে থাকি। ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে শরীর অনেক দুর্বল হয়ে গেছে।
‘সন্তানকেও কোলে নিতে পারি না। আর কতদিন জ্বর থাকবে বুঝতে পারছি না। জ্বর কমছেই না। ডেঙ্গু রোগে নাকি অনেকে মারাও গেছে। জানিনা মারা যাবো কিনা। মারা গেলে আমার সন্তানকে দেখবে কে?’
ঢামেক হাসপাতালের বহির্বিভাগের শিশু বিভাগের আবাসিক চিকিৎসক ডা. রাজেশ মজুমদার বাংলানিউজকে বলেন, জুলাই মাসে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি। প্রতিদিন আমি ১০ থেকে ১২ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশু রোগী দেখছি। যাদের বয়স ৫ থেকে ১০ বছরের মধ্যে। এর মধ্যে যাদের ভর্তি করানো প্রয়োজন, তাদের ভর্তি করানো হচ্ছে। প্রতিদিনই গড়ে এক থেকে দুইজন শিশু রোগী ভর্তি করানো হচ্ছে। আর যারা বেশি সিরিয়াস শিশু রোগী, তাদের সরাসরি জরুরি বিভাগের চিকিৎসককে দেখিয়ে ভর্তি করানো হচ্ছে।
ঢামেক হাসপাতালের ক্লিনিক্যাল প্যাথলজি বিভাগের প্রধান ডা. আজিজ আহমেদ খান বাংলানিউজকে বলেন, ঢামেক হাসপাতালের ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ। প্রতিদিনই প্রচুর নতুন রোগী ভর্তি হচ্ছেন।
বিগত বছরগুলোর ডেঙ্গু পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, গত বছর এ সময় ডেঙ্গু জ্বরের সিবিসি প্লাটিলেট পরীক্ষা করাতে মাত্র ১০-১৫ জন আসতেন। কিন্তু এ বছর প্রতিদিন গড়ে ১০০-১৫০ জন আসছেন। এতেই বোঝা যায়, এ বছর ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা অন্য যেকোনো বছরকে ছাড়িয়ে গেছে।
দিন-রাত ২৪ ঘণ্টাই প্যাথলজিতে ডেঙ্গু শনাক্তের সব রকমের পরীক্ষা চলছে বলেও জানান ডা. আজিজ আহমেদ।
ঢামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল একেএম নাসির উদ্দিন বাংলানিউজকে জানান, আমাদের চিকিৎসকরা অত্যন্ত সফলভাবে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন। হাসপাতালে ধারণক্ষমতার চেয়ে দ্বিগুণ রোগী ভর্তি রয়েছে। ফ্লোরে-বারান্দায় যেখানে, যেভাবে পারছেন ডেঙ্গু রোগীকে ভর্তি করিয়ে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন চিকিৎসকরা। কারণ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে কোনো রোগী বিনা চিকিৎসায় ফিরে যায় না।
বাংলাদেশ সময়: ২০৪২ ঘণ্টা, জুলাই ২৫, ২০১৯
এজেডএস/এসএ