ঢাকা: ২০২১ সালের শুরুর দিকে দেশে করোনার প্রকোপ কিছুটা কম ছিল। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি পেরিয়ে মার্চের প্রথমদিকেও শনাক্ত এবং মৃত্যুর হার কম ছিল, কিন্তু মার্চের শেষদিকে ফের করোনার প্রকোপ বেড়েই চলেছে।
দেশে ৩১ মার্চ পাঁচ হাজার ৩৫৮ জন নতুন করে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। দেশে এটি করোনায় এক দিনে সর্বোচ্চ শনাক্ত। এর আগে গত ২৯ মার্চ এক দিনে দেশে করোনায় আক্রান্ত হয়েছিল পাঁচ হাজার ১৮১ জন। এদিন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন ৫২ জন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা ভিন্ন কৌশলে একপ্রকার ছদ্মবেশেই আগের চেয়ে শক্তিশালী হয়ে ফিরেছে। এতে খুব একটা কাশি হচ্ছে না। হচ্ছে না জ্বরও। এটা জয়েন্টে ব্যথার উদ্রেক করছে এবং শরীরকে দুর্বল করে দিচ্ছে। মুখের স্বাদ নষ্ট করে দিচ্ছে। আক্রান্ত রোগীকে নিউমোনিয়া কাবু করে ফেলছে। লক্ষণ পর্যন্ত দেখা দিচ্ছে না। করোনায় আক্রান্ত রোগী দ্রুত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় চলে যাচ্ছে।
করোনার নতুন স্ট্রেইন সরাসরি ফুসফুসকে আক্রান্ত করছে। এমন অনেক রোগী রয়েছেন যাদের জ্বর নেই কিন্তু এক্স-রে রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে তারা মাঝারি পর্যায়ে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত। কিন্তু করোনা টেস্ট (ন্যাসাল সোয়াব) রিপোর্ট নেগেটিভ। এরকম অহরহ ভুল রিপোর্ট আসছে। এর অর্থ হলো- করোনা সরাসরি ফুসফুসকে আক্রান্ত করছে। নিউমোনিয়ার কারণে ভাইরাসগুলো সরাসরি ফুসফুসে ছড়িয়ে পড়ে তীব্র শ্বাসকষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এর কারণেই প্রাণহানি বাড়ছে।
এ বিষয়ে হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালের পরিচালক এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, আমরা জানি বাংলাদেশে ইউকে ভেরিয়েন্ট আছে যেটা অতি সংক্রমনশীল। একইসাথে দেশে দক্ষিণ আফ্রিকার ভেরিয়েন্টও আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং চট্টগ্রামের ভেটেরনারি বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ জরিপে করোনা ভাইরাসের আরও ৩৪টি মিউটেশন পাওয়া গিয়েছে। এসব মিউটেশনের যে কোনো একটি অতি সংক্রমনশীল হয়ে যেতে পারে। ফলে বর্তমান সময়ে করোনা ভাইরাসের বিস্তৃতির যে লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, আমাদের কাছে মনে হচ্ছে এটা আগের থেকে ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের। সব কিছু মিলে বলা যায়, আমরা করোনা ভাইরাসে বর্তমানে চরম ঝুঁকিতে রয়েছি। আগের করোনাকে যদি আমরা প্রবল বন্যার স্রোতের সঙ্গে তুলনা করি, তাহলে বর্তমান সময়ের করোনাকে সুনামির তীব্রতার সঙ্গে তুলনা করা যায়।
বর্তমানে করোনা কতটা আগ্রাসী জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগে করোনা আক্রান্ত রোগীর যেমন তীব্র জ্বর এবং কাশি থাকতো, এবারের করোনায় অল্প জ্বর থাকে। কিন্তু দুই থেকে তিন দিনের মধ্যেই শ্বাস কষ্ট দেখা দেয় এবং রোগীর শরীরে অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে যায়। আগে যত সংখ্যক রোগীকে হাই ফ্লো অক্সিজেন দিতে হতো, এখন তার থেকে বেশি রোগীকে অক্সিজেন দিতে হয়। আগে যেখানে ১০ জনের মধ্যে একজনকে আইসিইইউতে পাঠাতে হতো, বর্তমানে সেখানে ১০ জনের মধ্যে দুই থেকে আড়াই জনকে আইসিইউতে পাঠাতে হয়। ফলে আমরা মনে করেছি, এবারে করোনা ভাইরাসের ধরন আগের মতো না, এর মধ্যে আগ্রাসী চরিত্র লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ এ বিষয়ে বলেন, আমার ধারনা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে যে ভাইরাসগুলো, সবগুলো না হলেও তার মধ্যে একটা উল্লেখযোগ্য অংশ মিউটেশন হয়েছে যা দ্রুত ছড়িয়ে যেতে পারে। এরইমধ্যে চিহ্নিত ভেরিয়েন্ট হচ্ছে, ইউকে ভেরিয়েন্ট, চিহ্নিত ভেরিয়েন্ট হচ্ছে সাউথ আফ্রিকান ভেরিয়েন্ট। চিহ্নিত ভেরিয়েন্ট হচ্ছে এগুলোর সম্মিলনে আরও নতুন ভেরিয়েন্ট তৈরি হয়েছে, যেটা রোগের সিভিয়ারিটি বাড়িয়ে দেয়। তবে এটা নিশ্চিত গতবছরের ভেরিয়েন্ট থেকে বর্তমানের ভাইরাস আলাদা কোনো ভেরিয়েন্ট, যা অনেক দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। যেটার সংক্রমণের তীব্রতা বেশি এবং মৃত্যুও হারও বেশি।
করোনা ভাইরাস প্রতিরোধ এবং প্রাণহানি কমাতে জনগণ এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের আরও বেশি সতর্ক এবং কার্যকরী উদ্যোগের বিকল্প নেই। সতর্কতার পাশাপাশি জনসমাগম এড়িয়ে চলা, মাস্ক পরা এবং সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, নিরাপদ শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং পাশাপাশি করোনা ভাইরাসের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের।
বাংলাদেশ সময়: ২১০০ ঘণ্টা, মার্চ ৩১, ২০২১
আরকেআর/এজে