ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

স্বাস্থ্য

ইউরোনারি হেলথ: লজ্জা নয়, প্রয়োজন সচেতনতা-চিকিৎসা

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৪০ ঘণ্টা, আগস্ট ৭, ২০২২
ইউরোনারি হেলথ: লজ্জা নয়, প্রয়োজন সচেতনতা-চিকিৎসা ডা. সঞ্জয় পান্ডে। ছবি: জিএম মুজিবুর

ঢাকা: প্রস্রাবজনিত জটিলতায় অবহেলা বা লজ্জা না করে সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা নেওয়া প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন ভারতের মুম্বাইয়ের কোকিলাবেন ধীরুভাই আম্বানি হাসপাতাল ও মেডিক্যাল রিসার্স ইনস্টিটিউটের এন্ড্রোলজি ও রিকনস্ট্রাকটিভ ইউরোলজি বিভাগের প্রধান ডা. সঞ্জয় পান্ডে।

সম্প্রতি ডা. সঞ্জয় পান্ডে বাংলাদেশে সফরে এসেছেন।

ঢাকায় অবস্থানকালে ইউরোলজি বিষয়ক বিভিন্ন সমস্যা এবং চিকিৎসার বিষয়ে তিনি কথা বলেন বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কমের সঙ্গে।  
ইউরোলজিক্যাল সমস্যার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে ডা. সঞ্জয় পাণ্ডে বলেন, পেটে চাপ দিলে- যেমন, হাঁচি কাশি, হাঁটাচলা, বহু সন্তানের জন্মদানের ফলে ৪০ থেকে ৭০ বয়সী অনেক নারীর প্রস্রাব ফোটায় ফোটায় (লিকেজ) হয়। আমাদের মা, বোন বা স্ত্রীদের প্রস্রাব লিকেজের বিষয়ে আমরা কেউ জিজ্ঞেস করি না। তারাও লজ্জায় এটা কাউকে বলে না। তারা ভয়ে পানি খায় না, ডায়াপার পরে। এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়, আমরা এটাকে গুরুত্ব দিই না। এই সমস্যা নারীদের ক্ষেত্রেই হয়। এটার জন্য খুব ছোট একটা অপারেশন করতে হয়। কিন্তু নারীরা ৫, ১০ কিংবা ২০ বছর এই সমস্যা গোপন করে রাখে।  

তিনি বলেন, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রস্রাব লিকেজের বিষয়টি আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এখানে প্রায় সবাই নামাজ পড়ে। নামাজ পড়ার সময় পেটে চাপ লাগে। তাই চল্লিশোর্ধ, পঞ্চাশ কিংবা ৬০ বছরের ৫০ জন নারীকে প্রশ্ন করলে, তাদের মধ্যে প্রায় ৪০ থেকে ৭০ শতাংশ নারীর এই ইউরেনারী লিকেজের সমস্যা পাবেন। কিন্তু তাদের কাছে কেউ জানতে চায় না। নারীরাও লজ্জায় এটা বলতে পারে না।

‘অন্যদিকে পুরুষদের ক্ষেত্রে ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ মানুষ ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ফিজিক্যাল অ্যান্ড মেন্টাল স্ট্রেসে (শারীরিক ও মানসিক অবসাদ) থাকি, যার ফলে আমাদের যৌন ক্ষমতা কমে যায়। বর্তমান সময়ে পুরুষদের ক্ষেত্রে ইরেক্টাইল ডিসফাংশান (নপুংসকতা বা লিঙ্গ উত্থানে সমস্যা) হয়। সকালে উঠলে ইরেক্টাইল থাকে না। তার মানে পুরুষদের বিভিন্ন হরমোন কমে যাচ্ছে। এর ফলে যৌন অক্ষমতা দেখা দিচ্ছে। বেশির ভাগ ডায়াবেটিস রোগীর ক্ষেত্রে এটা হয়। আমরা এ চিকিৎসায় যেমন ব্রেস্ট ইমপ্ল্যান্ট করা হয়, তেমনি পিনাইল ইমপ্ল্যান্ট করে দিই। এতে যৌন সমস্যার সমাধান হয়। যার ফলে ডিভোর্সের মতো ঘটনা ঘটবে না। ’ বলেন ডা. সঞ্জয় পান্ডে।  

তিনি আরও বলেন, আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা হচ্ছে, প্রতি চার থেকে পাঁচ হাজার মেয়ের মধ্যে একজন ইউটেরাস (জরায়ু) ও ভ্যাজাইনা (যোনিপথ) ছাড়াই জন্ম নেয়। একজন মেয়ের ভ্যাজাইনা বা ইউটেরাস নেই- এটা মেয়েরা যখন ছোট থাকে তখন জানা যায় না। যখন তার পিরিয়ডের (ঋতুস্রাব) বয়স হবে এবং পিরিয়ড হবে না- এটা তখন জানা যায়। ১২, ১৪ কিংবা ১৬ বছর বয়সে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর দেখা যায় তার ইউটেরাস, ভ্যাজাইনা নেই। এসব মেয়ে বিয়ে-শাদি করতে পারে না। এটাকে বলে এমআরকেএইচ সিন্ড্রোম। ছোট ছেলের জন্মের পরেই বোঝা যায়, তার লিঙ্গে কোনো সমস্যা আছে কি না। কিন্তু নারীদের ক্ষেত্রে এটা জানা যায় না। কারণ নারীদের এসব অঙ্গ থাকে শরীরের ভেতরে। এ সমস্যা থাকলে নারীরা যৌন কাজ করতে পারেনা, সন্তান জন্ম দিতে পারবে না। এসব নারীকে আমরা ভ্যাজাইনাপ্লাস্টি করে দিই। যার ফলে তার জীবনটাই পরিবর্তন হয়ে যায়। সে বিয়ে শাদি করতে পারে এবং সারোগেট প্রেগ্ন্যাসিও করতে পারবে। তখন সে একজন পরিপূর্ণ নারী হবে।  

এন্ড্রোলজি ও রিকনস্ট্রাকটিভ ইউরোলজি বিশেষজ্ঞ সঞ্জয় পান্ডে বলেন, এমআরকেএইচ সিন্ড্রোমের বিষয়ে কেউ কথা বলতে চায় না, চিকিৎসাও করে না, পত্র-পত্রিকায় লেখাও হয় না। সেক্সুয়াল ডিসফাংশান বিষয়টি কেউ বলে না, আলোচনা করে না, এটা সম্পূর্ণ গোপন রেখে দেয়। আমি এটার চিকিৎসা করি, আমাদের হাসপাতালের মূল শ্লোগান হচ্ছে, ‘ এভরি লাইফ ম্যাটার্স। আমরা সবার চিকিৎসা দিই। আমাদের কাছে সব রোগী সমান।

ডা. সঞ্জয় পান্ডে বলেন, এই যে প্রস্রাবে সমস্যা এটা কেউ বলতে চায় না। প্রোস্টেট গ্লান্ড (জননগ্রন্থি) বয়সের সঙ্গে সঙ্গে প্রস্রাবের রাস্তাকে সরু করে দেয়। যাদের বয়স কম তাদের প্রস্রাবের রাস্তা ভালো থাকে, কারণ তার বিভিন্ন হরমোনের পরিবর্তন হয়নি। ৪০ থেকে ৭০ বছর বয়সীদের হরমোনের পরিবর্তনের ফলে প্রোস্টেট গ্লান্ড প্রস্রাবের রাস্তাকে চাপ দেয়, এতে প্রস্রাব অনেক সরু বের হয়, ফোটা ফোটা করে ধীরে ধীরে বের হয়। পুরো প্রস্রাব বের হয় না। আমরা বিভিন্ন ওষুধ দিয়ে প্রথমে প্রস্রাবের রাস্তা খুলতে চেষ্টা করি। আমি একজন ইউরোলজিস্ট হিসেবে বলতে চাই, যাদের বয়স ৪০ থেকে ৭০ বছর এবং প্রস্রাবে সমস্যা আছে, তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চিকিৎসা নেওয়া প্রয়োজন। এ বিষয়ে আমাদের সবার সচেতনতার দরকার আছে। ৪০ থেকে ৭০ বছর বয়সীদের জানতে হবে, তাদের প্রস্রাব ঠিক মতো হচ্ছে, না কি থেকে যাচ্ছে, না ফোটা ফোটা বের হচ্ছে। প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত বের হচ্ছে, কেন বের হচ্ছে, প্রস্রাবের রাস্তায় পাথর, ক্যানসার বা সিভিয়ার ইনফেকশন থাকতে পারে। গরমকালে পানি কম খেলেও প্রসাবের সঙ্গে রক্ত বের হতে পারে। এমনটা হলে অবশ্যই একজন ইউরোলজিস্টের কাছে গিয়ে চিকিৎসা বা পরামর্শ নিতে হবে।  

প্রস্রাবজনিত সমস্যা থেকে কিভাবে ভালো থাকা যায় জানতে চাইলে তিনি বলেন, স্বাভাবিকভাবেই মানুষের বয়স বাড়বে, বয়সের সঙ্গে এসব সমস্যা দেখা দিতে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রে আমাদের প্রধান শক্তি হচ্ছে সচেতনতা। আমি যদি জানি আমার প্রস্রাবের রাস্তায় পাথর ছিল, তাহলে আবার হতে পারে। আমার প্রস্রাব যদি ফোটা ফোটা বের হয়, তাহলে একজন ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী এটাকে সম্পূর্ণ নিরাময় করতে হবে। ইউরোলজি বিষয়ে সচেতনতার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। সচেতন হলে এসব বিষয়ে চিকিৎসা নিয়ে স্বাভাবিক জীবন-যাপন করা যায়, অন্যথ্যায় এসব রোগ গোপন করলে ভবিষ্যতে দাম্পত্য জীবনে সমস্যা হবে, এমনকি ডিভোর্সের মতো ঘটনাও ঘটতে পারে।

তিনি আরও বলেন, আমাদের বর্তমান সময়ের আধুনিক জীবনযাপন অনেক স্ট্রেসফুল (অবসাদপূর্ণ)। আমরা পানি কম খাই, বেশি চা কফি বা মদ্যপান করি। ফলে এমন নানা শারীরিক জটিলতা তৈরি হয়। আমাদের শরীরের রিজেনারেশন (পুনর্জাগরণ) প্রয়োজন, আমাদের নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম বা ব্যায়াম করতে হবে। সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, যার যে রোগ রয়েছে সেটার জন্য কোনো লজ্জা না করে সঠিক সময়ে সঠিক ডাক্তারের কাছে গিয়ে চিকিৎসা নিতে হবে। আমি একজন ইউরোলজিস্ট হিসেবে সেক্সুয়াল সমস্যা, প্রোস্টেট সমস্যা, প্রসাবের সঙ্গে রক্ত যায় কিনা, ইনফেকশন আছে কিনা দেখবো। কিন্তু এ জন্য সমাজের সব ক্ষেত্রে সচেতনতা দরকার আছে। যাদের প্রস্রাবজনিত সমস্যা আছে, তাদেরও এগিয়ে আসতে হবে, চিকিৎসা নিতে হবে। সবাই সচেতন হলে কাজটা অনেক সহজ হয়।  

বাংলাদেশ সময়: ১৪৩৫ ঘণ্টা, আগস্ট ০৭, ২০২২
আরকেআর/এসএ
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।