বছর শেষ হলেই পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন। তার আগে এসেছে শারদীয় দুর্গাপূজা।
কোথাও পূজামণ্ডপের উদ্বোধন করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, কোথাও ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। মণ্ডপে মণ্ডপে এখন দর্শনার্থীদের ভিড়। কোন মণ্ডপ এবং কার প্রতিমা সাজসজ্জায় সবচেয়ে বেশি চমক দিচ্ছে—এখন এটাই কলকাতায় চর্চার বিষয়।
‘ভিনরাজ্যে বাঙালিদের হেনস্থা করা হচ্ছে’, ‘বিজেপি বাঙালি বিরোধী’—এই নিয়ে সরব হয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। এমনকি ‘ভাষা আন্দোলনের’ ডাক দিয়েছেন মমতা। সেই নিয়ে দুর্গাপূজার আগে রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে চলেছিল মিটিং-মিছিল। আর সেই বাঙালি অস্মিতার ছাপ পড়েছে দুর্গাপূজার মণ্ডপেও। বাংলা ভাষা নিয়ে এবার পূজার থিম সাজায়েছে বহু বারোয়ারি পূজাকমিটি।
পশ্চিমবাংলার বিদ্যুৎ ও ক্রীড়ামন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের নিজের এলাকা কলকাতার নিউ আলিপুর। ওই অঞ্চলের জনপ্রিয় বারোয়ারি পূজা হয়ে থাকে সুরুচি সংঘের মাঠে। মন্ত্রী নিজেও জড়িয়ে থাকেন সেই পূজার সাথে। এবারে সেই পূজার থিম হলো—বাঙালি স্বাধীনতা সংগ্রামীদের শ্রদ্ধা নিবেদনে ‘আহূতি’। মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের পরিকল্পনায় এবার প্রতিমা তৈরি হয়েছে। মণ্ডপজুড়ে বাঙালি সংগ্রামীদের স্মরণ। ঠাঁই পায়নি ভগৎ সিংয়ের মতো অবাঙালি ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামীরা। অনেকেই মনে করছেন, এটা শহীদদের শ্রদ্ধা নয়। ভোটের আগে বাঙালি অস্মিতায় শান দিচ্ছে শাসক দল।
এরপরই আছে টালিগঞ্জের অশোকনগর সর্বজনীন দুর্গোৎসব কমিটি। এবার তাদের প্রয়াস ‘বাংলা আমার মায়ের ভাষা’। এখানে প্রতিমার বিশেষত্ব হলো, মায়ের দুই কোলে লক্ষ্মী ও সরস্বতী বসে রয়েছেন। পাশে আছে দুর্গার আরও দুই সন্তান কার্তিক এবং গণেশ। সবাই বাংলা পঠন-পাঠনে ব্যস্ত। সরস্বতীর হাতে রয়েছে ‘বর্ণপরিচয়’ ও লক্ষ্মীর হাতে ‘সহজ পাঠ’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিদ্যা-স্লেট লিখনির মাধ্যমে বাংলা ভাষার প্রচারের দায়িত্বে রয়েছেন কার্তিক ও গণেশ। মণ্ডপজুড়ে বাংলা বর্ণমালা আর নজরুল, রবি ঠাকুরের মতো বাঙালি মনীষীদের ছবি। মন্ডপে একটা গানই বরাদ্দ, তা হলো—প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের ‘আমি বাংলায় গান গাই’।
অনেকেই বলছেন—সারা বছর বাংলার বাঙালিরা কতটা বাংলা ভাষায় কথা বলে, তা নিয়ে সন্দেহে আছে। এমনকি শহরের দোকান থেকে বিজ্ঞাপনের হোর্ডিং। সেখানে বাংলা ভাষা দূরবীণ দিয়ে খুঁজতে হয়। কিন্তু পূজার কটাদিন এসব মণ্ডপে ঢুকলে মনে হবে, কলকাতার বাঙালিরা হারিয়ে যায়নি। তবে তারা আছেন এখন রাজনীতি আর পূজার মণ্ডপে। এবারে পশ্চিমবঙ্গজুড়ে প্রায় শতাধিক মণ্ডপের থিম ভাবনায় জায়গা পেয়েছে বাঙালি এবং বাংলা ভাষা। অন্যদিকে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ আর দেশপ্রেম মানেই যেন বিজেপি। ফলে অপারেশন সিঁদুর হয়ে দাঁড়ালো মোদী সরকারের ক্রেডিট, সেই নিয়েও সেজে উঠেছে মণ্ডপ। সেখানেই সোনার বাংলা গড়ার ডাক দিয়েছেন ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ।
শিয়ালদহ সংলগ্ন সন্তোষ মিত্র স্কয়ারের বারোয়ারি পূজা, যা পরিচালনা করেন বিজেপি নেতা সজল ঘোষ। প্রতি বছর একটু বেশি দর্শকটানে সজলের পূজায়। গত বছর উত্তর প্রদেশ থেকে তুলে নিয়ে এসেছিলেন আস্ত রাম মন্দির। অর্থাৎ রাম মন্দিরের আদলে সেজে উঠেছিল সজলের মণ্ডপ। পুলিশের তথ্য বলছে, সেবার পূজার পাঁচ দিনে দুই কোটি মানুষ মণ্ডপ দর্শনে গিয়েছিল। কাকতালীয়ভাবে গত বছর থেকে বাংলার মণ্ডপে ভিড় বাড়লেও ২০২৪ সালে উত্তর প্রদেশের অযোধ্যার রাম মন্দির এলাকায় দারুণভাবে পরাজিত হয় বিজেপি। তবে তা অতীত।
সজলের পূজায় এবারের থিম অপারেশন সিদুঁর। কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ের উপত্যকার আদলে সেজে উঠেছে মণ্ডপ। বিশাল সেই মণ্ডপের বাইরে সেভেন-ডি টেকনোলোজিতে আলোক রশ্মিতে ফুটে উঠছে পহেলগাঁওয়ের জঙ্গি হামলা ও নৃশসং হত্যাকাণ্ড। অসাধারণ লেজার শো আর শব্দের কারসাজিতে দশ মিনিটের জন্য দর্শক সেই ঘটনা অনুধাবন করতে পারবেন। একবার হলেও মনে হবে, ‘বাঙালি-অবাঙালি ওসব পরে ভাবা যাবে। আগে একজন ভারতীয়। আর যারা মোদী বা বিজেপি বিরোধী তারা কখনো ভারতীয় হতে পারে না!’ প্রতি দশ মিনিটের অনুষ্ঠান শেষে দর্শকের চিৎকার ‘ভারত মাতা কি জয়’।
এই পূজামণ্ডপের থিম অপারেশন সিদুঁর
সন্তোষ মিত্র স্কয়ারের পূজা উদ্বোধন করেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। সেই পূজার মঞ্চ থেকে পশ্চিমবঙ্গকে ‘সোনার বাংলা’ গড়ার ডাক দিয়েছিলেন তিনি। গত ২৬ সেপ্টেম্বর তিনি বলেছিলেন, ‘আমি দুর্গা মায়ের কাছে প্রার্থনা করে গেলাম যে, আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে এমন একটা সরকার প্রতিষ্ঠা হোক, যারা সোনার বাংলা গঠন করতে পারে। আমাদের এই বাংলা যেন ফের সুরক্ষিত, সমৃদ্ধ, শান্তি ও উর্বর হয়ে ওঠে এবং আমরা যেন কবিগুরুর সেই সোনার বাংলাকে নির্মাণ করতে পারি। ’
আরও কয়েক জায়গায় ‘অপারেশন সিঁদুরের আলোকে পূজামণ্ডপ হয়েছিল। তবে আগত দর্শকদের ভিড়ে পদপৃষ্ট হয়ে যাওয়ার অজুহাতে পূজার মাঝ পথেই মণ্ডপ বন্ধ করে দেয় পুলিশ, যা নিয়ে রাজ্যজুড়ে কম ক্ষোভ নেই। সজলের পূজাও বন্ধ হতো। কিন্তু পারেনি, কারণ এই পূজার উদ্বোধক স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তবে যাই হোক, একদিকে শহরজুড়ে নিম্নচাপের বৃষ্টি অন্যদিকে দুর্গাপূজা। তার ওপর আগামী বছর পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন। ফলে দুর্গোৎসব শেষ হলেই ভোট উৎসবে মাতবেন শহরবাসী। আর তার আগে রাজনীতির ছাপ পড়েছে সব মণ্ডপে।
এবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ৪৫ হাজার ক্লাবকে পূজা করার জন্য ১ লাখ ১০ রুপি করে অনুদান দিয়েছেন। গত বছর ছিল ৮৫ হাজার। সব মিলিয়ে এ বছর রাজ্যে পূজার সংখ্যা ৬০ হাজারের বেশি। এর মধ্যে বাড়ি বা ব্যক্তিগত উদ্যোগের পূজাও আছে। তবে এসব ভুলে আগামী ২ অক্টোবর পর্যন্ত দুর্গাপূজায় মেতে থাকতে চান পশ্চিবঙ্গবাসী।
ভিএস/এমজেএফ