তুরস্কে পরপর শক্তিশালী দুটি ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে। এরমধ্যে প্রথমটি আঘাত হানে ভোর রাতে।
প্রথম ভূমিকম্পেই তুরস্ক ও সিরিয়ায় কয়েক হাজার মানুষ হতাহত হয়েছেন। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৭ দশমিক ৮, যা গত ৮৪ বছরের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী। দ্বিতীয়টির মাত্রা ৭ দশমিক ৬।
আনাতোলিয়ান প্লেটজুড়ে দুটি অন্যতম বড় ফল্ট লাইন রয়েছে। ফল্ট লাইন দুটি এই অঞ্চলে শক্তিশালী ভূমিকম্প সৃষ্টি করে।
১৯৩৯ সালে তুরস্কের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পে প্রায় ৩০ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে।
১৯৯৯ সালে ৭ দশমিক ৬ মাত্রার একটি ভূমিকম্প পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর ইজমিতে আঘাত হানে। এতে ১৭ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, বেশ কয়েকটি ফ্যাক্টর ভূকম্পন-জনিত ঘটনাকে জটিল করে থাকে। ইস্তানবুলের বোগাজিচি বিশ্ববিদ্যালয়ের কানদিলি অবজারভেটরি অ্যান্ড আর্থকোয়াক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মুস্তাফা এরদিক আল জাজিরাকে বলেন, ক্ষয়ক্ষতির সংখ্যা বেশি হওয়ার একটি কারণ ভবনের দুর্বল মান।
তুরস্কের ন্যাশনাল আর্থকোয়াক স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড অ্যাকশন প্ল্যান (পিডিএফ) ফর ২০১২-২০২৩ -এ দেখানো হয়েছে যে, ১৯৫০ এর দশকে ব্যাপক ও দ্রুত অভিবাসন কীভাবে দুর্বল তদারকিতে নগর উন্নয়নের দিকে ধাবিত করেছিল এবং একইসঙ্গে প্রাকৃতিক বিপদের বিপরীতে ত্রুটিযুক্ত ও দুর্বল শহর তৈরি করেছিল।
১৯৯৯ সালের ভূমিকম্পের পর তুরস্কের বিভিন্ন ইনস্টিটিউশন ভূমিকম্পপ্রবণ দেশটিতে ঝুঁকি কমানোর ওপর গুরুত্ব দেয়। এর পরের বছর একটি আইন পাস করা হয়, যাতে সব ভবনে বাধ্যতামূলক নকশা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও নির্মাণ তদারকির বিধান রাখা হয়।
দক্ষিণ-পূর্ব তুরস্কে ৩ হাজার ৪০০ ভবন ধসে পড়েছে বলে জানিয়েছে দেশটির দুর্যোগ সংস্থা। এর মধ্যে হাতায়ে ও ইস্কান্দারুনে দুটি হাসপাতালও রয়েছে- বলেন আল জাজিজার ইস্তানবুল সংবাদদাতা সিনেম কোসেগলু।
তিনি বলেন, বৃহৎ আকারের কয়েকটি বহুতল ভবন উদ্ধার তৎপরতাকে জটিল করে তোলে কেননা একের পর এক কম্পন অনুভূত হচ্ছে।
ক্ষয়ক্ষতির আরেকটি বড় কারণ হলো যখন প্রথম ভূমিকম্পটি আঘাত হানে, তখন স্থানীয় সময় ভোর ৪টা ১৭ মিনিট। লোকজন ঘরের ভেতর ঘুমাচ্ছিল। এই কারণে বহু মানুষ ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়ে।
তুরস্কের কর্তৃপক্ষ দ্বিতীয় ভূমিকম্পটির মাত্রা নির্ণয় করে ৭ দশমিক ৬। এর কেন্দ্রস্থল ছিল কাহরামানমারাসের একিনোজু শহরের ৪ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণপূর্বে। এই অঞ্চলে আগের ভূমিকম্পটিও আঘাত হানে।
দ্বিতীয় ভূকম্পনের ফলে মালাতিয়া শহরে কয়েকটি ভবন ধসে পড়ার দৃশ্য সরাসরি দেখা যায় স্থানীয় টিভি চ্যানেলে।
তুরস্কে সোমবারের ভূমিকম্পে শুধু আধুনিক স্থাপনাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, হিট্টিদের সময়কার গাজিয়ান্তেপ দুর্গের কিছু অংশ ভেঙে পড়েছে। রোমানদের সময়ে দুর্গটি বড় করা হয়।
স্থানীয় গণমাধ্যমে পোস্ট করা একটি ভিডিওতে দেখা দেখা যায়, দুর্গের কিছু অংশ ধসে রাস্তায় নেমে এসেছে।
তুরস্ক সরকার ৪ মাত্রার রাষ্ট্রীয় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে। দেশটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে সাহায্য চেয়েছে। নিজেদের সব বাহিনীকে মাঠে নামিয়েছে।
অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ক্রিস এলডার্স বলেন, প্রাথমিক ভূমিকম্পটির গভীরতা ছিল প্রায় ১৮ কিলোমিটার, যা এটিকে আরও বিধ্বংসী করে তুলতে ভূমিকা রেখেছে।
তিনি বলেন, ভূমিকম্পটির গভীরতা বেশি ছিল না। এই কারণে ভূমিকম্পে সৃষ্ট শক্তি ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি অনেক তীব্রভাবে অনুভূত হয়েছে। গভীরতা বেশি থাকলে তা হতো না।
তুরস্কের একাডেমি অব সায়েন্সেসের ভূ-কম্পনবিদ নাজি গোরার সম্ভাব্য বিপর্যয়কর বন্যা এড়াতে অবিলম্বে বাঁধের ফাটল পরীক্ষা করার আহ্বান জানিয়েছেন।
জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় সিরিয়ায় সরঞ্জামের অভাব।
ভূমিকম্পে প্রতিবেশী দেশ সিরিয়ার আলেপ্পো ও হামাসহ সীমান্তবর্তী অঞ্চলের অনেক স্থানে ভবন ধসে পড়েছে। দেশটিতে মৃতের সংখ্যা এখনো অনুমান করা যাচ্ছে না। জরুরি পরিস্থিতিতে সাড়া দেওয়ার মতো যথেষ্ট সরঞ্জামের অভাব রয়েছে উদ্ধারকারী দলের মধ্যে।
ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব রেড ক্রস অ্যান্ড রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির মুখপাত্র মে আল সায়েগ আল জাজিরাকে বলেন, যন্ত্রপাতিগুলো বেশ পুরোনো। সাহায্যের জন্য যথেষ্ট পরিমাণে এক্সক্যাভেটর নেই।
সিরিয়ায় ইন্টারন্যাশনাল রেসকিউ কমিটির পরিচালক তানিয়া ইভানস বলেন, দুর্বল জনসংখ্যা যারা কয়েক বছরের সংঘাতের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে, তাদের জন্য এই ভূমিকম্প আরও বিধ্বংসী আঘাত।
তার সহকর্মীদের দেওয়া প্রাথমিক প্রতিবেদন বলছে যে, তুষারঝড় ও নিম্ন তাপমাত্রার সঙ্গে যেখানে অনেক বাস্তুচ্যুত ও ঝুঁকিপূর্ণ পরিবার বসবাস করছে, সেখানে ভূমিকম্পের প্রভাব বিধ্বংসী হয়েছে।
ইভানস বলেন, এই ভূমিকম্প অভাবের তীব্রতা ও মাত্রা বাড়িয়ে দেবে।
বাংলাদেশ সময়: ০১১৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৭, ২০২৩
আরএইচ