তুরস্কে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয় পেয়েছেন রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। তার জয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন সমর্থকেরা।
জয়ের পর আঙ্কারায় নিজের প্রাসাদের বাইরে উচ্ছ্বসিত জনতার উদ্দেশে এরদোয়ান বলেন, সাড়ে আট কোটি মানুষের গোটা জাতির জয় হয়েছে।
নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টের ঐক্যের ডাক অনেকটাই ফাঁপা শোনায়, কেননা তিনি প্রতিপক্ষ কামাল কিলিচদারোগলুকে নিয়ে বারবার উপহাস করেছেন এবং তিনি কুর্দিশ নেতাদের সঙ্গে এলজিবিটি গোষ্ঠীর লোকজনকে জেলে ঢোকানোর কথা বলেছেন।
বিরোধী নেতা স্পষ্টভাবেই জয় স্বীকার করেননি। এই নির্বাচনকে সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে সবচেয়ে অনিরপেক্ষ নির্বাচন হিসেবে অভিযোগ করে কামাল কিলিচদারোগলু বলেছেন, প্রেসিডেন্টের রাজনৈতিক দল তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করেছে।
২৮ মের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ৫২ শতাংশেরও বেশি ভোট পেয়েছেন। অর্থাৎ তুরস্কের প্রায় অর্ধেক ভোটার এরদোয়ানের কর্তৃত্ববাদী শাসনের দৃষ্টিভঙ্গিতে সমর্থন জানাননি।
এরদোয়ানের গোছানো প্রচারণার বিপরীতে কিলিচদারোগলু টিকতে পারেননি। প্রথম দফায় দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে ভোটের ব্যবধান ছিল ২৫ লাখের মতো। দ্বিতীয় দফায়ও সেই ব্যবধান ছিল ২০ লাখের বেশি।
গত ১৪ মে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে এরদোয়ান পেয়েছিলেন ৪৯ দশমিক ৫২ শতাংশ ভোট। অল্পের জন্য ঝুলে যায় তার ভাগ্য। এরদোয়ানের প্রধান প্রতিপক্ষ কামাল কিলিচদারোগলু পেয়েছিলেন, ৪৪ দশমিক ৮৮ শতাংশ ভোট।
২০১৪ সালে তুরস্কে নির্বাচনের পদ্ধতি পরিবর্তন করা হয়। সেসময় থেকে সরাসরি প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করতে ভোট দিতে পারে মানুষ।
ভোটের দিন আগেভাগেই জয় উদযাপন শুরু করেন এরদোয়ান। ইস্তানবুলে বাসের ছাদ থেকে সমর্থকদের উদ্দেশে ভাষণ দেন তিনি। সন্ধ্যায় তার প্রাসাদের বাইরে প্রায় ৩ লাখ ২০ হাজার সমর্থক জড়ো হন। বারান্দা থেকে তাদের উদ্দেশে ভাষণ দেন তিনি।
এরদোয়ান এই নির্বাচনকে তুরস্কের ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন হিসেবে উল্লেখ করে ঘোষণা দেন, কে জিতেছে, তার চেয়ে বড় কথা হলো তুরস্ক জিতেছে।
প্রতিপক্ষের পরাজয়ে উপহাস করে তিনি বলেন, বিদায় কামাল। আঙ্কারায় তার সমর্থকদের কন্ঠেও এই কথা শোনা যেতে থাকে।
এলজিবিটি নীতি সমর্থনসহ বিরোধী জোটের বেশ কয়েকটি প্রচারণার নিন্দা করেন এরদোয়ান।
চূড়ান্ত ফল যদিও এখনও নিশ্চিতভাবে ঘোষণা হয়নি, কিন্তু তুরস্কের সর্বোচ্চ নির্বাচন কাউন্সিল বলছে যে এরদেোয়ানের বিজয় নিয়ে আর কোনো সন্দেহ নেই।
নির্বাচনের দিন আঙ্কারায় প্রেসিডেন্টের প্রাসাদের দরজা খুলে দেওয়া হয় সাধারণ মানুষের জন্য। আঙ্কারার প্রায় সব জায়গা থেকে এসে সমর্থকরা সমবেত হন। উপস্থিত অনেককেই দেখা যায় প্রাসাদের বাইরে ঘাসের ওপর তুরস্কের পতাকা রেখে নামাজ আদায় করতে। অনেকে ইসলামি স্লোগানও দেন।
এক রাতের জন্য মানুষ তুরস্কের অর্থনৈতিক সংকট ভুলে গিয়েছিল। সেহান নামে এক সমর্থক বলেন, এটি মিথ্যা, কেউ ক্ষুধার্ত নয়। এই অর্থনীতি নিয়ে আমরা অনেক খুশি। আগামী পাঁচ বছর তিনি ভালো করবেন।
তবে প্রেসিডেন্ট স্বীকার করেন যে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ তুরস্কের সবচেয়ে জরুরি ইস্যু।
এখন প্রশ্ন উঠেছে যে, তিনি কি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে প্রস্তুত কি না। তুরস্কে বছরে প্রায় ৪৪ শতাংশ হারে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। দেশটিতে খাদ্য, বাড়ি ভাড়া ও অন্যান্য পণ্যের দাম ব্যাপক হারে বেড়েছে।
এই মূল্যস্ফীতির জন্য এরদোয়ানের গতানুগতিক অর্থনৈতিক ধারা অনুসরণ না করা এবং সুদের হার না বাড়ানোর সিদ্ধান্তকে অনেক ক্ষেত্রে দায়ী করা হয়ে থাকে।
ডলারের বিপরীতে তুরস্কের মুদ্রা লিরার মান রেকর্ড পরিমাণ পড়ে গেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিদেশি মুদ্রার চাহিদা মেটাতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে।
যদি সুদের হার কমতে থাকে, যার ইঙ্গিত এরদোয়ান দিয়েছেন, এর একমাত্র বিকল্প হলো কঠোর পুঁজি নিয়ন্ত্রণ। এমনটি মনে করেন ইস্তানবুলের কচ ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির অধ্যাপক সেলভা দেমিরাল্প।
এরদোয়ানের সমর্থকদের মন অর্থনীতির চিন্তা থেকে বহু দূরে। তাদের গর্ব হলো বিশ্বে এরদোয়ানের শক্তিশালী অবস্থানে এবং সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান। তাদের কাছে সন্ত্রাসী বলতে কুর্দিশ মিলিট্যান্টদের বোঝায়।
প্রতিপক্ষ কুর্দিশদের পক্ষে বলে অভিযোগ করেছেন প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান।
প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ফেব্রুয়ারিতে তুরস্কের ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলের উন্নয়নেরও অঙ্গীকার করেছেন।
এরদোয়ানের এই বিজয়কে অনেকেই মুসলিম বিশ্বের জন্যও তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন।
ইস্তান্বুলের তাসকিম স্কোয়ারে জয় উদযাপন করতে এসেছিলেন ফিলিস্তিনি নাগরিক আলা নাসার, তার গায়ে জড়ানো ছিল তুরস্কের পতাকা।
তিনি বলেন, এরদোয়ান নিজের দেশের উন্নয়নের পাশাপাশি আরব ও মুসলিম বিশ্বকেও সমর্থন করছেন।
২০১৬ সালে বানচাল হয়ে যাওয়া এক সেনা অভ্যুত্থানের পর এরদোয়ান প্রধানমন্ত্রীর পদ বাতিল করেন এবং ব্যাপক ক্ষমতা কুক্ষিগত করেন।
এবারের নির্বাচনের আগে তার বিরোধীরা অঙ্গীকার করেছিল যে তারা এই পদ্ধতির পরিবর্তন করবে। তুরস্কের বিরোধী দলগুলো এখন ২০২৪ সালের স্থানীয় সরকার নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নেবে।
ইস্তানবুলের মেয়র একরাম ইমামোগলু বিরোধী সমর্থকদের মধ্যে অন্যতম। তিনি বিরোধীদের হতাশ না হওয়ার জন্য বলেছেন।
তিনি সোমবার তাদের স্মরণ করিয়ে দেন যে, বিরোধীরা ২০১৯ সালে গত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে হেরে যাওয়ার কয়েক মাস পরই আঙ্কারা ও ইস্তাম্বুলে ক্ষমতাসীন দলকে পরাজিত করেছিল।
সূত্র: বিবিসি
বাংলাদেশ সময়: ১৬০৪ ঘণ্টা, মে ২৯, ২০২৩
আরএইচ