ঢাকা, সোমবার, ২৪ আষাঢ় ১৪৩১, ০৮ জুলাই ২০২৪, ০০ মহররম ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

‘আমরা ক্ষুধার্তদের না খেয়ে মরতে দিতে পারি না’

মো. জুবাইর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৩৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৩, ২০২৩
‘আমরা ক্ষুধার্তদের না খেয়ে মরতে দিতে পারি না’

জামিল আবু আসি একজন ফিলিস্তিনি। বসবাস করেন বানি সুহাইলা শহরে।

এটি দক্ষিণ গাজা শহরের খান ইউনিসের পূর্বে অবস্থিত। ৩১ বছর বয়সী এ ফিলিস্তিনি তার বাড়ির বাইরে ফুটপাতে চাচাতো ভাইদের নিয়ে রান্না করছিলেন। বড় বড় কড়াইয়ে তারা রান্না করছিলেন তাদের অপর ফিলিস্তিনি ভাই-বোনদের জন্য। যারা ইসরায়েলি আগ্রাসনে বিপর্যস্ত।

২০১৪ সালেও আবু আসি একদিন তার আশপাশের লোকেদের অনুরোধে নিজের বাড়িতে রান্না করছিলেন। কিন্তু সেদিন বিরাট এক অঘটনের শিকার হন তিনি। ইসরায়েলি সৈন্যরা তাদের বাড়িতে হামলা করে। ধ্বংস করে দেয় তার রান্না ঘর। পরে তিনি তার রান্নার সমস্ত সরঞ্জাম সরিয়ে নেন।

আসি ও তার পরিবারও আজও রান্না করছেন। শুধু নিজেদের জন্য নয়। এ রান্না বিশেষ। গাজায় ইসরায়েলের আক্রমণ ও অবরোধের কারণে যারা বাস্তুচ্যুত হয়েছে তাদের জন্য। এটি এমন একটি কর্মযজ্ঞ যা আগে কখনও করেননি তারা। গত ৭ অক্টোবার ফিলিস্তিনি মুক্তিকামী সংগঠন হামাসের আক্রমণের পর গাজায় ধারাবাহিক আক্রমণ চালাচ্ছে ইসরায়েল। উত্তর ও দক্ষিণ গাজায় তাদের অত্যাচার দিন দিন বাড়ছে। বিশেষ করে দক্ষিণ গাজায়। খাবার-পানি ছাড়া অসহায় হয়ে পড়েছে সাধারণ ফিলিস্তিনিরা। তারা যেন না খেয়ে মারা না যান, সে লক্ষ্যেই আসির পরিবারের এ রান্না।

প্রতিদিন দুই হাজার মিল রান্না করেন আসি ও তার পরিবার। রান্না হয় তাদের বাড়ির ফুটপাতে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর যারা খান ইউনিসে এসেছেন তাদের মধ্যে কিছু লোককে খাবার সহায়তা দেন আসি।

দক্ষিণ গাজার এ শহরে ২০২১ সালেও জনসংখ্যা ছিল ২ লাখ ২০ হাজার। এখন সেটি বাড়তে বাড়তে পাঁচ লাখের বেশি হয়েছে।

বানি সুহাইলা শহরের বাসিন্দা আবু আসির সঙ্গে কথা বলে কাতারের সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা। তিনি সংবাদমাধ্যমটিকে বলেন, ৭ অক্টোবর যুদ্ধ শুরু হলে ইসরায়েলিরা জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। এরপর আমি কাঠের সন্ধান শুরু করি, কেননা আমাদের রান্নার গ্যাস ফুরিয়ে গিয়েছিল।

কিন্তু কাঠ সংগ্রহ করাও ঝুঁকিপূর্ণ, কারণ ইসরায়েলিরা শহরের সীমান্তের কাছাকাছি রয়েছে। গতকাল রোববার গাজা উপত্যকার শাসক হামাস জানায় তারা খান ইউনিসে ইসরায়েলি হামলা ঠেকিয়ে দিয়েছে। তারা একজন ইসরায়েলি সেনাকেও হত্যা করে। এই অবস্থায় আমি নিজেকে বিপদে ফেলতে চাই না।

তিনি জানালেন, তার অন্যান্য ভাইয়েরা নিজেদের মতো কাজ ভাগ করে নেন। তাদের মধ্যে কেউ পেঁয়াজ কাটার দায়িত্ব নেন, কেউ খাদ্যের উপাদান মিশ্রণের। কেউ রান্নার পাত্রে উপকরণ নাড়ার কাজ করেন; আবার কেউ খাবার প্যাকেট করেন। বেশিরভাগ খাবার তৈরি করা হয় চাল, মসুর ডাল, ফ্রিকেহ ও সবুজ শাকসবজি দিয়ে। আগে মাংস দিয়ে রান্না করা খাবার বিলি করতেন আবু আসি। কিন্তু ইসরায়েলি আগ্রাসন ও সরবরাহ না থাকায় মাংসের দোকানগুলো বন্ধ। যে কারণে লোকেদের মাংস খেতে দিতে পারছেন না তিনি।

অনেক ফিলিস্তিনি যারা দক্ষিণ গাজায় সরে এসেছেন তারা দেশটির শরণার্থীদের জন্য জাতিসংঘের সংস্থা ইউএন রিলিফ অ্যান্ড ওয়ার্ক এজেন্সি (ইউএনআডব্লিউএ) কর্তৃক পরিচালিত স্কুলগুলোয় আশ্রয় নিয়েছেন। এ আশ্রয় শিবিরগুলো তুলনামূলক নিরাপদ। আবু আসি বলেন, স্কুলগুলোয় থাকার জন্য জায়গা খুবই কম। আশ্রয় শিবিরগুলো জীবিত মানুষের জন্য কার্যত কবরস্থান। এখানে জীবনের মৌলিক প্রয়োজনীয়তা নেই। এখানকার লোকেদের সংকট দূর করতে আমরা আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী যতটুকু করার সেটি চেষ্টা করি।

আবু আসির ইতিহাসও কষ্টের। তিনি তৃতীয় প্রজন্মের একজন ফিলিস্তিনি যার পূর্ব পুরুষরা জাফা থেকে খান ইউনিসে এসেছিলেন। ১৯৪৮ সালে আসির দাদা-দাদি নাকাবা থেকে বাস্তুচ্যুত হয়েছিলেন। সে সময়টায় সাড়ে ৭ লাখ ফিলিস্তিনিকে তাদের জমি ও বাড়িঘর থেকে উৎখাত করেছিল ইসরায়েলিরা। ইহুদি মিলিশিয়া ও তৎকালীন ইসরায়েল সরকার প্রায় ৫০০ শহর ও গ্রাম ধ্বংস করেছিল। দুই পক্ষের জাতিগত নিধনের শিকার হয়েছিল হাজারো ফিলিস্তিনি।

আবু আসি জানান, তাকে তার দাদা বলেছিলেন- নিজ দেশে একজন শরণার্থী হয়ে ওঠা বেশ কঠিন। এই তিক্ততা কখনোই ভোলা যাবে না। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম এই ক্ষত বয়ে বেড়াবে। তিনি বলেন, ইসরায়েল আমাদের অন্তরে যে বেদনা সৃষ্টি করেছে; তারা আমাদের সঙ্গে যা করছে- সেজন্য আমি তাদের কখনই ক্ষমা করবো না।

তিনি আরও বলেন, এবারের যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত শিশুরা খাবার-পানি-বিদ্যুৎ ছাড়া বেঁচে থাকার কথা কখনোই ভুলে থাকতে পারবে না। যুদ্ধ সন্ত্রাস, অবরোধ, ক্ষেপণাস্ত্র ও মানসিক আঘাতের মধ্যেও আমাদের সঙ্গে একটি সম্প্রদায় যুক্ত হয়েছে। তারা ফিলিস্তিনিদের খাদ্য সহায়তা দেওয়ার জন্য আমার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। খান ইউনিসে সুন্দর সামাজিক সংহতি রয়েছে। যে কারণে আমরা ক্ষুধার্ত মানুষকে না খাইয়ে রাখতে পারি না। তাদের না খেয়ে মরতে দিতে পারি না। খান ইউনিস ক্রমাগত বাড়তে থাকা বাস্তুচ্যুত মানুষের খাদ্যের চাহিদা মিটিয়ে যাচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আবু আসির পরিবার। তিনি তার বাড়ির ফুটপাতের সামনে রান্নার জন্য চুলার সংখ্যা বাড়িয়েছেন। দুটি দলে কাজ ভাগ করে দিয়েছেন। তাদের কর্মযজ্ঞ শুরু হয় সকাল সাতটায়, চলে দুপুর ২টা পর্যন্ত।

আসি বলেন, আমরা আমাদের কর্মস্থল ত্যাগ করি না। যাদের খাবার দরকার- আমরা তাদের বলেছি দুপুর দুইটা থেকে বিকেল ৫টার মধ্যে আসতে। এ সময়ের মধ্যে তার তাদের পর্যাপ্ত খাবার সংগ্রহ করে। কিছু স্থানীয় ফিলিস্তিনি তাদের গাড়িতে খাবার বিতরণ করেন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে। এটি একটি চমৎকার আচরণ তাদের জন্য যাদের পরিবহনের কোনো উপায় নেই। অনেকে দূর দূরান্ত থেকে খাবার নিতে আসেন। অনেকে ভালোভাবে পুরো এলাকায়ও চেনেন না।

কিছু পরিবার এক বেলা খাবার নেন। তাদের ভাত দেওয়া হচ্ছে- এ ব্যাপারে তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। যেমন পাঁচ সন্তানের মা কারামা মুসাল্লাম। তিনি আবু আসির পরিবারের কাছে এসেছিলেন খাবার খুঁজতে। তিনি তার সন্তানও ৮০ বছর বয়সী শাশুড়িকে নিয়ে উত্তর গাজার বেত হানুন থেকে পালিয়ে এসেছেন। এখন বসবাস করছেন বনি সুহাইলার ইউএনআরডব্লিউএ’র স্কুলে।

মুসাল্লাম খান ইউনিসের কাউকে চেনেন না। এখানে তার কোনো আত্মীয়-স্বজনও নেই। আল জাজিরাকে তিনি বলেন, আমরা এখানে এসে খাবার খুঁজছিলাম। খুঁজতে খুঁজতে কিছু যুবককে দেখি রান্না করছে। তারা আমাকে দুটি খাবারের প্যাকেট দেয় যা আমার সন্তান ও শাশুড়ির জন্য যথেষ্ট ছিল।

ওই যুবকরা আমাকে বলেছিল, আমি তাদের কাছে প্রতিদিন আসতে পারি। যতটুকু খাবার নেওয়ার নিতে পারি। এ মানুষগুলো মধ্যে আমরা নিজেদের নিরাপদ মনে করছি। কারণ, আমরা সবাই একই সম্প্রদায়ের।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৩৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৩, ২০২৩
এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।