ঢাকা, রবিবার, ২০ পৌষ ১৪৩১, ০৫ জানুয়ারি ২০২৫, ০৪ রজব ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

ভারতের ‘নেইবারহুড ফার্স্ট’ নীতি: চব্বিশে কোন দিশে

আন্তর্জাতিক ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৫৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২, ২০২৫
ভারতের ‘নেইবারহুড ফার্স্ট’ নীতি: চব্বিশে কোন দিশে

বিদায় নিয়েছে ইংরেজি ২০২৪ সাল। এসেছে ২০২৫।

বিদায়ী বছরে আকস্মিক পরিবর্তনের বদৌলতে বাংলাদেশের পরিস্থিতি এখন পুরোই মুদ্রার উল্টোপিঠ। পাশের দেশ ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক আগে খুব মধুর ছিল। এখন সেটি কার্যত তিক্ততায় রূপ নিয়েছে। এর পেছনের কারণ বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান, শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের পতন এবং তার পলায়ন। হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর তাকে বিনাবাক্যে আশ্রয় দিয়েছে ভারত। শুধু বাংলাদেশই নয়, বিদায়ী বছরে মালদ্বীপসহ আরও কয়েকটি দেশের রাজনৈতিক পট-পরিবর্তন ঘটেছে। এই পরিবর্তনের হাওয়ায় ভারতের যে ‘নেইবারহুড ফার্স্ট’ (প্রতিবেশী প্রথম) নীতি রয়েছে, সেটি কোন দিকে গেল? নতুন দিশা পেয়েছে? নাকি দিশেহারা হয়েছে, তা নিয়ে নানা আলোচনা চলছে।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি তাদের একটি প্রতিবেদনে বলেছে, রাজনৈতিক উথাল-পাথালের ২০২৪ সালে ভারতের সঙ্গে তার প্রতিবেশী কয়েকটি দেশের সঙ্গে মনোমালিন্য হয়েছে। সম্পর্কেও এসেছে টানাপোড়েন। ২০২৪ সালের শুরুতে নতুন করে সরকার গঠন করার পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ভালো ছিল। কিন্তু বছরের মাঝামাঝিতে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে টেনে নামায় জনগণ। বিষয়টি ভারতের জন্য ছিল আঘাতের। কারণ, মনে করা হয়ে থাকে, এ দেশে ভারতের ‘আস্থাভাজন’ ছিলেন শেখ হাসিনা। তাকে ক্ষমতায় রাখতে ভারত সর্বোচ্চ চেষ্টা করলেও তা ব্যর্থতায় পর্যবেসিত হয়েছে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে।

২০১৪ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হন নরেন্দ্র মোদী। তার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে প্রতিবেশী সব দেশের সরকারপ্রধানরা ভারত সফর করেন। মোদীও প্রধানমন্ত্রী পদে বসে প্রতিবেশী বেশ কয়েকটি দেশ সফর করেন। তার এ সফর থেকে বোঝা যাচ্ছিল, ভারতের বিদেশনীতিতে প্রতিবেশী দেশগুলোর প্রতি গুরুত্ব থাকবে সবচেয়ে বেশি। আনুষ্ঠানিকভাবে ওই নীতিকে ‘নেইবারহুড ফার্স্ট’ বা ‘প্রতিবেশীই প্রথম’ নাম দেয় নয়াদিল্লি।

ভারত সরকার চেয়েছিল আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, মালদ্বীপ, মিয়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কার মতো প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে দৃঢ় সম্পর্ক গড়ে তুলতে। কিন্তু ২০২৪ সাল পর্যন্ত কয়েকটি দেশের সঙ্গে তার সম্পর্ক বরং খারাপ হয়েছে। সর্বশেষ বাংলাদেশের প্রতি তাদের বর্তমান দৃষ্টিকোণ তেমন ভালো নয়। বাংলাদেশ যদিও ‘ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক আগের মতোই রয়েছে’ বলে আসছে; কিন্তু দেশটির বর্তমান পরিস্থিতি বা রাজনৈতিক অবস্থান তা বলে না।

প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর নরেন্দ্র মোদী দুইবার বাংলাদেশ সফর করেছেন। সর্বশেষ ২০২১ সালের ২৬ মার্চ এদেশের স্বাধীনতা দিবস উদযাপনে এসেছিলেন। সে সময় করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব চলছিল। তার এ সফর ও বাংলাদেশ সরকারের ব্যবস্থাপনা প্রশ্নের শিকার হয়েছিল। প্রথমবার ২০১৫ সালের ৬ জুলাই বাংলাদেশ সফর করেন মোদী।

গত জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান হয়। সরকার অভ্যুত্থান ঠেকাতে অস্ত্রের ব্যবহার করে। আন্দোলনকারীদের ভাষ্যে, সেসময় ইতিহাসের অন্যতম ‘গণহত্যা’ হয়। শেখ হাসিনা চেয়েছিলেন ক্ষমতায় থাকতে। কিন্তু ৫ আগস্ট পুরো বাংলাদেশের জনগণ রাস্তায় নেমে আসে শেখ হাসিনার বাসভবন গণভবন ঘেরাও করতে। উপায় না পেয়ে পালান শেখ হাসিনা। গিয়ে ওঠেন ভারতে। এরপর থেকেই তিনি ভারতে অবস্থান করছেন।

আগস্টের আগেও বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক ‘অনন্য উচ্চতায়’ বলে আসা ভারত শেখ হাসিনার পতনের পর যেন অস্বস্তিতে পড়ে যায়। এ অস্বস্তি ঢাকতেই যেন তারা বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে অভিযোগ করে আসছে, এদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন চলছে। অন্তর্বর্তী সরকার হিন্দুসহ অন্যান্য সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছে না। যদিও সংখ্যালঘু নির্যাতন এবং তাদের সম্পত্তি দখলবাজির অভিযোগ আগেও ছিল এবং সেসব অভিযোগের তীর হাসিনার দল আওয়ামী লীগের নেতাদের বিরুদ্ধে ছিল। কিন্তু তখন এসব নিয়ে ভারত কোনো উচ্চবাচ্চ্য করেনি।

এছাড়া বাণিজ্য নিয়েও দেখা দিচ্ছে নানা শঙ্কা। দুই দেশের ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার সরাসরি প্রভাব পড়ছে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে। ভারতীয় শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩ সালের অগাস্টের তুলনায় ২০২৪ সালের আগস্টে ভারতের রপ্তানি ২৮ শতাংশ কমে গেছে।

দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের অধ্যাপক সঞ্জয় ভরদ্বাজ মনে করেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক উথাল-পাথাল সেদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। কিন্তু সে কারণে ভারতের নেইবারহুড ফার্স্ট নীতিতে কোনো বদল ঘটেনি। সব সময়েই ভারতের নীতি এটাই থেকেছে যে দেশের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিবেশী দেশগুলিও যাতে অর্থনৈতিকভাবে মজবুত হয় আর সেখানে রাজনৈতিক সুস্থিরতা বজায় থাকে।

তিনি মনে করেন, বাংলাদেশের সরকার পরিবর্তনের পর থেকে সেখানে জামায়াত এবং আওয়ামী লীগ-বিরোধী শক্তিগুলো মজবুত হয়েছে। ফলে তারা পাকিস্তানের কাছাকাছি চলে যাচ্ছে।

সঞ্জয় বলেন, তারা হচ্ছে সেই শক্তি, যারা চায়নি যে বাংলাদেশ কখনো পাকিস্তান থেকে আলাদা হোক। তাই এটা খুবই স্বাভাবিক যে পাকিস্তানের প্রতি এদের ঝোঁক থাকবে। আবার চীনের দিক থেকে যদি দেখা যায়, তাহলে শেখ হাসিনার সরকার ও বর্তমান সরকারের মধ্যে সেরকম কোনো ফারাক তো নেই। ড. মুহাম্মদ ইউনূসও চীনের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি চাইছেন।

পররাষ্ট্র বিষয়ক বিশেষজ্ঞ এবং দ্য ইমেজ ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ রবীন্দ্র সচদেভ মনে করেন, ২০২৪ সালে ভারত সবচেয়ে বেশি ধাক্কা খেয়েছে বাংলাদেশের ঘটনায়। এটা নেইবারহুড ফার্স্ট নীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে।

তিনি বলেন, শেখ হাসিনার বাংলাদেশে না থাকার ফলে উত্তর-পূর্ব ভারতে উগ্রপন্থী কার্যকলাপ বেড়ে যেতে পারে। কারণ, তার আমলে উগ্রপন্থীরা সে দেশে আশ্রয় পেত না। তবে এখন তারা নিজেদের অবস্থান মজবুত করার একটা সুযোগ পেল।

প্রসঙ্গ পাকিস্তান
মোদী সরকারে আসার পর একবারই পাকিস্তান সফর করেছিলেন। দেশটির প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের জন্মদিনে অংশ নিয়েছিলেন মোদী। এরপর পাঠানকোট, উরি, পুলওয়ামা ও বালাকোটের ঘটনায় পাকিস্তান-ভারত উত্তেজনা শুরু হয়। যা এখনও বিদ্যমান।  

২০২৪ সালে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা শুরু হয় পাকিস্তানে। এর মধ্যে সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশনের সম্মেলনে ভারতকে আমন্ত্রণ জানায় পাকিস্তান। ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর সেখানে অংশ নেন।

জয়শঙ্করের আগে ২০১৫ সালে পাকিস্তান সফর করেছিলেন সুষমা স্বরাজ।

রবীন্দ্র সচদেভ বলছেন, ভারত আর পাকিস্তানের সম্পর্ক বহু বছর ধরেই শীতল। ২০২৪ সালে সেই পরিস্থিতিতে বিশেষ কিছু পরিবর্তনও আসেনি। যতক্ষণ পাকিস্তান ভারত-বিরোধী প্রচারণা আর সীমান্ত থেকে সন্ত্রাসবাদ আটকাতে না পারবে, ততক্ষণ দুই দেশের সম্পর্ক সহজ হবে না।

নেপালে কোন হাওয়া?
প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর মোদী নেপাল সফর করেছেন পাঁচবার। দেশটির ক্ষমতায় কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল (সংযুক্ত মার্কসবাদী-লেনিনবাদী)। শীর্ষে আছেন দলটির সভাপতি কেপি শর্মা ওলি। তিনি ভারত বিরোধী বলে পরিচিত।

ভারতের সঙ্গে ১৭৫০ কিলোমিটার সীমান্ত থাকা নেপালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর সাধারণত তারা প্রথমে ভারত সফর করেন। কিন্তু ওলি চতুর্থবার সরকার প্রধান হয়ে তা করেননি। তিনি চীনে গিয়েছিলেন। ভারস বিষয়টি ভালোভাবে নেয়নি।

কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল ক্ষমতায় আসার পর চীনের উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের নতুন কাঠামোগত চুক্তিতে সামিল হয়। অধ্যাপক সঞ্জয় ভরদ্বাজ অবশ্য মনে করেন যে ভারত আর চীন – দুই দেশের সঙ্গেই সম্পর্ক ‘ব্যালেন্স’ করে চলার চেষ্টা করছে নেপাল।

তিনি বলেন, কেপি শর্মা ওলি চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক চান। কিন্তু ভারতকেও ছাড়তে চান না। চীন থেকে যেসব সুযোগ সুবিধা পাবে তার দেশ, সেগুলো হাতছাড়া করতে চাইছেন না তিনি।

নেপালের ভারতবিমুখ হওয়ার কারণগুলোও বেশ বড়। ২০১৯ সালে কালাপানি ও লিপুলেখ এলাকাগুলি ভারতের মানচিত্রে যুক্ত করা হয়। ২০২৩ সালে ভারতের সংসদ ভবনে নেপালসহ পুরো উপমহাদেশের মানচিত্র ভারতের ভেতরে দেখিয়ে টাঙ্গানো হয়। এ বিষয়গুলোয় নেপাল ক্ষুব্ধ হয়েছিল।

অধ্যাপক সঞ্জয় ভরদ্বাজের কথায়, বিগত কয়েক বছরে নেপালের সঙ্গে ভারতের বিরোধ সামনে এসেছে, কিন্তু ২০২৪ সালে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি বা বড় কোনো বিতর্কও সামনে আসেনি।

‘ইন্ডিয়া আউট’ মালদ্বীপে
২০২৩ সালের নভেম্বরে মালদ্বীপের রাষ্ট্রপতি হওয়ার আগে মোহামেদ মুইজ তার নির্বাচনী প্রচারণায় ‘ইন্ডিয়া আউট’ স্লোগান দিয়েছিলেন। তিনি ক্ষমতায় আসার পরে ভারত আর মালদ্বীপের মধ্যে সম্পর্কে চরম উত্তেজনা তৈরি হয়। নরেন্দ্র মোদী ২০২৪ সালে লাক্ষাদ্বীপে গিয়েছিলেন। সেখানকার কিছু ছবি শেয়ার করে মানুষকে সেখানে বেড়াতে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। এটি ছিল মালদ্বীপ থেকে তার দেশের পর্যটকদের মনোযোগ ঘোরানোর একটি উপায়।

এ ঘটনার পর মালদ্বীপের কয়েকজন মন্ত্রী ভারত ও মোদী সরকার নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করেন। শুরু হয় দুই দেশের মধ্যকার নতুন বিবাদ। রবীন্দ্র সচদেভ মনে করেন, মালদ্বীপের সঙ্গে ভারতের সুসম্পর্কই ছিল। কিন্তু মুইজ ক্ষমতায় আসার পরে তাতে চিড় ধরে। তিনি এমন সব ভারত-বিরোধী মন্তব্য করতে থাকেন, যা তার আগে কখনও কেউ করেননি। তা ছাড়া মালদ্বীপ সরকার চীনের দিকে ঝুঁকে ছিলই। ভারত এই প্রথমবার একেবারে ব্যাকফুটে চলে গেল। এটা ভারতের কাছে দুশ্চিন্তার বিষয়। মুইজ ক্ষমতায় আসার পর সেদেশে চীনের উপস্থিতি বেড়েছে। যা ভারতের পক্ষে উদ্বেগের বিষয়।

তিনি আরও বলেন সামাজিক মাধ্যমে যেসব বিবৃতি আসছিল, তাতে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। কিন্তু ভারত খুবই সুচিন্তিত বক্তব্য দিয়েছিল। পররাষ্ট্র মন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ২০২৪ সালের অগাস্টে তিনদিনের এক সফরে মালদ্বীপ গিয়েছিলেন। সেসময়ে বেশ কিছু চুক্তি সই হয়। এখন মনে হচ্ছে ভারতের ব্যাপারে মালদ্বীপ অনেকটা নমনীয় হয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৮৫২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২, ২০২৫
এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।