ঢাকা, সোমবার, ২৯ পৌষ ১৪৩১, ১৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১২ রজব ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

সিআইএর চোখ ফাঁকি দিয়ে যেভাবে কিউবায় পৌঁছে চে গেভারার ডায়েরি

আন্তর্জাতিক ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬১০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৩, ২০২৫
সিআইএর চোখ ফাঁকি দিয়ে যেভাবে কিউবায় পৌঁছে চে গেভারার ডায়েরি আর্নেস্তো চে গেভারা

মার্কসবাদী বিপ্লবী আর্নেস্তো চে গেভারার একটি ডায়েরি যুক্তরাষ্ট্রের গুপ্তচর সংস্থা ‘সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি’ চরম গোপনীয়তার সঙ্গে নিজেদের কব্জায় রেখেছিল।  

তবে সেই ডায়েরির একটি কপি বা অনুলিপি বের করে আনতে পারেন কিউবার সাবেক প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রো।

ঘটনা ১৯৬৮ সালের মাঝামাঝি সময়ের।  

তখন কাস্ত্রো জানান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গুপ্তচর সংস্থা সিআইএকে তারা রীতিমত বোকা বানিয়েছেন। চে’র ডায়েরি হাতে পেতে একটি পয়সাও খরচ করতে হয়নি।

কিন্তু সিআইএর চোখে ধুলো দিয়ে কীভাবে ডায়েরিটা কিউবায় পৌঁছেছিল, তা অবশ্য তখন খোলাসা করেননি চে গেভারার দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ এই বন্ধু।

ওই বছরই সেই ডায়েরি বই আকারে প্রকাশ পায়। এর নাম দেওয়া হয় ‘দ্য বলিভিয়ান ডায়েরি’। পরে অবশ্য ডায়েরি উদ্ধারের ঘটনাগুলো ধীরে ধীরে প্রকাশ পেতে থাকে।

কী ছিল ডায়েরিতে?

বিপ্লবের স্বপ্ন নিয়ে ১৯৬৬ সালের নভেম্বরে বলিভিয়ায় যান চে গেভারা। গেরিলা বাহিনী গড়ে তুলে লড়াই শুরু করেন বলিভিয়ার তৎকালীন সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে।  

১৯৬৬ সালের ৭ নভেম্বর থেকে শুরু করে সামরিক বাহিনীর হাতে ধরা পড়ার আগের দিন, অর্থাৎ ১৯৬৭ সালের ৭ অক্টোবর পর্যন্ত ডায়েরি লেখা অব্যাহত রেখেছিলেন তিনি।

সেখানে তিনি নিজের গেরিলা বাহিনী ও সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই নিয়ে যেমন লিখেছেন, তেমনি লিখেছেন সহযোদ্ধা এবং বলিভিয়ার তৎকালীন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের সম্পর্কেও।

এর বাইরে ডায়েরিতে একটি বইয়ের তালিকা ছিল। সেগুলো যুদ্ধের মধ্যেই গেভারা পড়ছিলেন বলে ধারণা পাওয়া যায়।  

এ ছাড়া বলিভিয়ার সরকারি বাহিনীর সঙ্গে গেরিলাদের প্রথম সম্মুখ যুদ্ধের একটি বিবরণ ডায়েরিতে পাওয়া যায়, যেটি সংঘটিত হয়েছিল ১৯৬৭ সালের ২৩ মার্চ।

মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সিআইএর সহায়তায় ১৯৬৭ সালের ৮ অক্টোবর বলিভিয়ার সামরিক বাহিনী চে গেভারাকে বন্দী করে এবং পরদিন তাকে হত্যা করা হয়।

কীভাবে সিআইএর হাতে যায়?

গেভারাকে ধরার ক্ষেত্রেও সিআইএর এজেন্টরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন, যাদের একজন ফেলিক্স রড্রিগেজ। হত্যা করার আগে তিনি গেভারার ব্যক্তিগত জিনিসপত্র সংগ্রহ করেন।

রড্রিগেজ এক সাক্ষাৎকারে বলেন, একটি স্কুলে গেভারাকে বন্দি রাখা হয়েছিল। সেখানে একটি ঘরে ঢুকে দেখলাম তাকে বেঁধে এক কোনায় মেঝের উপর ফেলে রাখা হয়েছে।

ওই ঘরের মধ্যে রড্রিগেজ একটি ঝোলা খুঁজে পান, যার মধ্যেই ছিল বলিভিয়া অভিযানের সময় লেখা চে গেভারার ব্যক্তিগত ডায়েরি। জীবিত চে গেভারার কাছ থেকে তথ্য বের করার মিশনে ব্যর্থ হয়ে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা তখন মনোযোগ দেয় তার ডায়েরির দিকে।  

কোনোভাবেই যেন হাতছাড়া না হয়, সেজন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টার সময় ব্যয় করে ডায়েরির প্রতিটি পাতার ছবিও তুলে রাখে সিআইএ। যদিও ডায়েরির মূল কপি পরে বলিভিয়ার সেনাবাহিনীর কাছে চলে যায়।

অপারেশন ‘তিয়া ভিক্টোরিয়া’

গেভারার মৃত্যুর পর থেকেই সিআইএর কাছ থেকে তার ডায়েরি উদ্ধারের চেষ্টা চালাচ্ছিলেন কিউবার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রো। সেই লক্ষ্যে একটি গোপন অভিযান শুরু হয়, যার নাম অপারেশন ‘তিয়া ভিক্টোরিয়া’।

১৯৬৭ সালের ডিসেম্বরে বলিভিয়ার তৎকালীন সরকার একটি আদেশ জারি করে, এর মাধ্যমে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে উদ্ধার করা চে গেভারার ডায়েরিসহ অন্যান্য মালামালের দায়িত্ব দেশটির সামরিক বাহিনীর হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়।

তখন বলিভিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন আন্তোনিও আরগুয়েডাস। তিনি একসময় বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বলিভিয়ায় তিনিই ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা।

কিন্তু পরে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশটির ক্ষমতা দখলকারী জেনারেল রেনে ব্যারিয়েন্টোসের মন্ত্রিসভায় তাকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভূমিকায় দেখা যায়। যদিও পরে তিনি ‘বামপন্থাবিরোধী’ তকমা পান।

সিআইএর সঙ্গে তার বেশ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তিনিই পরে চে গেভারার ডায়েরি উদ্ধারে বামপন্থীদের প্রধান সহায়তাকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন।

বলিভিয়া থেকে হাভানা

ডায়েরির যে ছবিগুলো সিআইএ তুলেছিল, সেটির একটি কপি (মাইক্রোফিল্ম) ‘অপারেশন তিয়া ভিক্টোরিয়া’র সদস্যদের হাতে তুলে দেন আরগুয়েডাস।

কপি পাওয়ার পর ১৯৬৮ সালের গোড়ার দিকে তা চিলিতে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন গোপন অভিযানের অন্যতম সদস্য ভিক্টর জ্যানিয়ার।   

নিরাপদে কীভাবে ডায়েরির কপি বলিভিয়া থেকে কিউবায় পাঠানো হবে, সেই পরিকল্পনা করতেই কয়েক মাস চলে যায়। সব ঠিকঠাক করার পর ১৯৬৮ সালের এপ্রিলের দিকে তা প্রথমে চিলিতে পাঠানো হয়।

ভিনাইল রেকর্ডের ছয়টি খামে লুকিয়ে ডায়েরির মাইক্রোফিল্ম বা টেপগুলো তখন চিলির রাজধানীতে নেওয়া হয়। এরপর সেটি কাস্ত্রোর কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়।

হার্নান উরিবে নামের একজন সাংবাদিকও ‘অপারেশন তিয়া ভিক্টোরিয়া’র সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি ১৯৮৭ সালে একই নামে একটি বইও প্রকাশ করেন।

সেখানে তিনি লেখেন, এ দফায় ভিনাইল রেকর্ডের খামে লুকিয়ে টেপগুলো প্রথমে মেক্সিকো, তারপর কিউবায় নিয়ে যান চিলির বামধারার পত্রিকা পুন্তো ফিনালের তৎকালীন পরিচালক মারিও ডিয়াজ ব্যারিয়েন্টোস।

এরপর ১৯৬৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে টেপগুলো পৌঁছে যায় চে গেভারার বন্ধু ও সহযোদ্ধা ফিদেল কাস্ত্রোর কাছে।

বিবিসি বাংলা অবলম্বনে

বাংলাদেশ সময়: ১৬০০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৩, ২০২৫
আরএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।