ঢাকা, রবিবার, ৯ ফাল্গুন ১৪৩১, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৩ শাবান ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

জার্মানিতে জাতীয় নির্বাচন রোববার, শঙ্কায় অভিবাসীরা

সাগর আনোয়ার, বার্লিন (জার্মানি) থেকে | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৪৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২২, ২০২৫
জার্মানিতে জাতীয় নির্বাচন রোববার, শঙ্কায় অভিবাসীরা

জার্মানির জাতীয় নির্বাচন রোববার (২৩ ফেব্রুয়ারি)। সম্ভাব্য ক্ষমতায় আসতে যাওয়া দলগুলোর অভিবাসন নীতি পর্যালোচনা ও অভিবাসন সংকোচনের ঘোষণায় এবারের নির্বাচন বাংলাদেশি কমিউনিটিসহ সারাবিশ্ব থেকে আসা অভিবাসীদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।

 

গত বছরের শেষে মধ্যবামপন্থী এসপিডি, পরিবেশবাদী গ্রিন পার্টি ও উদার অর্থনীতির এফডিপি নেতৃত্বাধীন তিনদলীয় জোট সরকারের পতনের পর আগাম এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এবারের নির্বাচনে প্রায় ৬ কোটি  ভোটার ২৯৯টি আসনে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। পোস্টাল ভোট আগে থেকে শুরু হলেও কালকের ভোটেই মূলত নির্ভর করছে আগামী চার বছরের জন্য কারা সরকার গঠন করতে চলেছে। কোন কোন দল যাচ্ছে জার্মানির পার্লামেন্ট বুন্টেসটাগে।

বাংলাদেশ ও বিভিন্ন দেশের অভিবাসীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, অন্যান্য বছর নির্বাচনে তাদের খুব একটা আগ্রহ না থাকলেও এবারের নির্বাচনে অভিবাসীরা অনেক বেশি আগ্রহ নিয়ে ভোটের জরিপের খোঁজ-খবর রাখছেন। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে রক্ষণশীল দল রিপাবলিকান পার্টি ক্ষমতায় আসার পর জার্মানিতেও অভিবাসী বিরোধী বিভিন্ন দলের প্রচার প্রচারণা বৃদ্ধি পাওয়ায় এই আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে।  

জানা গেছে, জার্মানির অভিবাসন ও উদ্বাস্তুবিরোধী এবং মুসলিম বিদ্বেষী দল হিসেবে পরিচিত এএফডি (অলটারনেটিভ ফর ডয়েসল্যান্ড) সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছে। আর তাদের নির্বাচনী প্রচারণার মুখ্য বিষয়ই হচ্ছে অভিবাসন নীতির পর্যালোচনা ও সংকোচন। তাদের এমন প্রচারণায় ব্যাপক জনসমর্থন থাকায় বিভিন্ন জরিপে এগিয়ে থাকা দল সিডিইউ ও (ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন) অভিবাসন নীতি সংকোচনের ঘোষণা দেওয়ায় অভিবাসীদের মধ্যে অনেকটা শঙ্কারও সৃষ্টি করেছে।  

অন্যদিকে মার্কিন ধনকুবের ইলন মাস্কের সাথে অতি রক্ষণশীল দল এএফডির দলনেতা আলিস ফিডেলের কয়েক দফা বৈঠকের পর অভিবাসীরা তাদের ভবিষ্যত নিয়েও অনেক বেশি আগ্রহী হয়ে উঠেছে। এবারের নির্বাচনে জার্মানির অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের চেয়ে অভিবাসন ইস্যুটিই বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আর এতে বিভক্ত হয়ে পড়েছে জার্মান ভোটাররা।

সম্প্রতি অভিবাসন ইস্যুটি জার্মানির নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া প্রধান এজেন্ডা হওয়ার কারণ সম্পর্কে বাংলাদেশি জার্মান অভিবাসী রতন ইসলাম জানান, প্রায় কয়েক মিলিয়ন টার্কিস অভিবাসী র্দীর্ঘদিন ধরে জার্মানিতে বসবাস করছেন। গত দশ বছরে সিরিয়া থেকে প্রায় ১২ লাখ শরণার্থী জার্মানিতে এসেছেন। এছাড়া ইরাক, আফ্রিকা, আফগানিস্তান ও সম্প্রতি প্রায় ২০ লাখ ইউক্রেনীয় উদ্বাস্তু জার্মানিতে আসায় জার্মানদের মধ্যে বিদেশিদের নিয়ে বিরক্তি সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে উদ্বাস্তুদের পেছনে সরকারকে বিপুল পরিমান অর্থ ব্যয় করতে হয়। এতে করে জনগণের ওপর কর বৃদ্ধি পাচ্ছে আর চাপ বাড়ছে অর্থনীতিতে। এছাড়া সম্প্রতি বিভিন্ন শহরে গাড়ি চাপা দেওয়া, ছুরিকাঘাতের মতো অপরাধ বৃদ্ধি ও এসবে অভিবাসীদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ সামনে আসায় সাধারণ মানুষের মধ্যেও ভীতির সৃষ্টি হয়েছে। এসব কারণে হয়তো নির্বাচনে অভিবাসন ইস্যুতে প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছে।  

তিনি আরো যোগ করে বলেন, বিভিন্ন দেশ থেকে বিপুল সংখ্যক শরণার্থী ও উদ্বাস্তুদের ব্যাপকভাবে তাদের সংস্কৃতির লালন-পালন ও প্রকাশের কারণেও জার্মানদের মধ্যে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থেকে হয়তো তারা অভিবাসন নিয়ন্ত্রণের পক্ষে কথা বলছেন।

তবে নাইজেরিয়া থেকে জার্মানিতে পড়তে আসা শিক্ষার্থী চিনাকো জানান, যারা বিদেশিদের ঘৃণা করে তারা আগেও ছিল এখনও আছে। সংখ্যার তারতম্য পরিস্থিতির কারণে কমে বা বাড়ে। আমাদের সমাজে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে যাতে তরুণ প্রজন্ম এই ঘৃণার অংশ না হয়। তাহলেই পৃথিবীটা সুন্দর হবে। অন্যদিকে আমারাও যে দেশে থাকবো সেই দেশের সংস্কৃতি ও মানুষদের সম্মান জানাতে হবে। তাহলেই পারষ্পরিক সম্মান ও শ্রদ্ধা নিয়ে থাকতে পারবো।  

তবে যে দলই ক্ষমতায় অংশ হোক, নিয়মিত অভিবাসী ও যারা জার্মানিতে আইনিভাবে বসবাস করছেন তাদের কোনো সমস্যা হবে না। এমনকি তাদের পারিবারিক পুনর্মিলনী ভিসাতেও কোনো প্রভাব পড়বে না বলে জানান বাংলাদেশি কমিউনিটির সংগঠক রতন ইসলাম।   

জার্মানির গণমাধ্যম ও নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, ১৬টি রাজ্যে বিভক্ত জার্মানিতে এবারের নির্বাচনে ৬ কোটি ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবে। প্রধান ৬টি দলের মধ্য থেকেই এবার নির্ধারণ হবে কারা সরকার গঠন করছে। বিশ্লেষকদের মতে, প্রায় ৩ যুগের ধারাবাহিকতায় এবারও জার্মানিতে জোট সরকার গঠনের সম্ভাবনাই বেশি।  

বিভিন্ন জরিপ সূত্রে জানা গেছে, এবারের নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি ভোট পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে ফ্রেডেরিখ মার্সের নেতৃত্বাধীন সিডিইউয়ের (ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন)। ৬০ বছরের পুরনো দলটির অধিকাংশই সমর্থকই মধ্যবিত্ত বয়স্ক যারা ধর্ম-কর্ম পালন করেন ও গ্রামে বসবাস করেন। সাবেক দীর্ঘ সময়ের জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেলের নেতৃত্বে ২০২১ সালে দলটি ২৪.১ শতাংশ ভোট পেয়েছিল এবং ২০১৭ সালে পেয়েছিল ৩২.৯ % ভোট। সম্প্রতি দলটি অভিভাসন নীতির সমালোচনা ও সংকোচনের ঘোষণা দেওয়ায় দলটির ক্ষমতায় আসা সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। জরিপগুলো বলছে, সিডিইউ ৩০ শতাংশের বেশি ভোট পেতে পারে। তবে এককভাবে কোনো জরিপই দলটিকে ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা দেখাচ্ছে না।

অন্যদিকে বর্তমান চ্যান্সেলর ওলাফ শলসের নেতৃত্বাধীন এসপিডির (সোশাল ডেমোক্রেটিক পার্টি) সমর্থন আশঙ্কাজনকভাবে কমেছে। অভিবাসন, অর্থনৈতিক ইস্যুতে দলটিকে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে। তবে অভিবাসী, জার্মানির শ্রমিক শ্রেণী ও শহুরে মধ্যবিত্তের কাছে এখনও দলটির আবেদন রয়েছে। জরিপে দেখা যাচ্ছে, দলটি ২০ শতাংশের কম ভোট পাবে। ২০২১ সালে এসপিডি পেয়েছিল ২৫.৭ % আর ২০১৭ সালে পেয়েছিল ২০.৫ % ভোট।  

ওলাফ শলসের নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের গুরুত্বপূর্ণ শরীক ল গ্রিন পার্টি। পশ্চিম জার্মানির তরুণ শহুরে মধ্যবিত্ত ও শিক্ষিত শ্রেণীর কাছে ব্যাপক জনপ্রিয় এ দল। বিশেষ করে পরিবেশ ইস্যুতে কঠোর অবস্থান দলটির শহুরে তরুণদের ব্যাপক সমর্থন এনে দিয়েছে। তবে অথর্নীতি, ইউক্রেন যুদ্ধ ও অভিবাসন ইস্যুতে দলটির ভোট কমার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। ভাইস চ্যান্সেলর রবার্ট হাবেক কে সামনে রেখে দলটি কিভাবে ঘুরে দাঁড়ায় সেটাই এখন দেখার বিষয়। পরিবেশবাদী এ দলটি ২০২১ সালে পেয়েছিল ১৪.৮ % ভোট আর ২০১৭ সালে পেয়েছিল ৮.৯%।  

এবারের নির্বাচনে সবচেয়ে আলোচিত ল এএফডি( অলটারনেটিভ ফর জার্মানি)। অতি রক্ষণশীল ও ডানপন্থী  হিসেবে পরিচিত দলটির সমর্থন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে জার্মানিতে। আলিস ভিডেলের নেতৃত্বাধীন অতিডানপন্থী দলটি পূর্ব জার্মানিতে ব্যাপক জনপ্রিয়। ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত দলটি ২০২১ সালে পেয়েছিল মাত্র ১০.৩ % ভোট। এবার জরিপ বলছে, তারা ২০ শতাংশের বেশি ভোট পেতে পারে। তবে জার্মানির সকল দল অলিখিতভাবে এই দলটির সাথে কোনো ধরনের জোট বা সমঝোতা না করার নীতি মেনে চলায় তারা কখনো জোটববদ্ধভাবে সরকারের অংশ হতে পারবে না বলে ধারণা করা হয়। এবার জার্মানির সকল দল ঐক্যবদ্ধভাবে দলটির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। এএফডি জার্মানির ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকা এমনকি অভিন্ন ইউরোপীয় মুদ্রানীতিরও বিরোধী। এবার তাদের নির্বাচনী প্রচারণায় যুক্ত হয়েছে মুসলিম ও অভিবাসন বিরোধীতা। দলটি অভিবাসী ও উদ্বাস্তুদের তাদের নিজ ফিরিয়ে দেওয়ার পক্ষে।  

জার্মান নির্বাচনে অতি বাম ও অতি ডানপন্থী সমর্থকরে নিয়ে গঠিত একটি দল ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। সারা ভাগেননেকটের নেতৃত্বাধীন দলটির নাম বিএসভি। সাবেক বাম থেকে উগ্র ডানপন্থীদের মিলিত দলটি ব্যাপক জনতুষ্টিবাদী কথা বলে ভোটারদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছে। তবে বর্তমান ভেঙে যাওয়া জোটের শরিক এফডিপি (ফ্রি ডেমোক্রেটিক পার্টি) ও ডি লিংকের (বামদল) মতো তারাও ৫ শতাংশ ভোট পাবে না বলে ধারণা করা হচ্ছে।  জার্মানিতে ৫ শতাংশের কম ভোট পেলে পার্লামেন্টে আসন নিশ্চিত হয় না।  

নির্বাচন সূত্রে জানা গেছে, প্রায় ৬ কোটি ভোটারের এবারের নির্বাচনে অর্ধেকের বেশি ভোটার নারী। এছাড়া প্রায় ২৫ লাখ ভোটার প্রথমবারের মতো ভোটাধিকার প্রয়োগ করবে, যা মোট ভোটারের প্রায় ৪%। এছাড়া অভিবাসী ভোটার রয়েছে প্রায় ৭০ লাখ। নারী, নতুন ও অভিবাসী এই ভোটারদের ভোটই মূলত নির্ধারণ করবে এবারের জার্মান সরকারের গতি-প্রকৃতি।  

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।