ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৫ ফাল্গুন ১৪৩১, ১১ মার্চ ২০২৫, ১০ রমজান ১৪৪৬

অন্যান্য

গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন

হাসিনার ‘ধ্বংসযজ্ঞের’ পর বাংলাদেশ পুনর্গঠনে ড. ইউনূস 

আন্তর্জাতিক ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৪৭ ঘণ্টা, মার্চ ১০, ২০২৫
হাসিনার ‘ধ্বংসযজ্ঞের’ পর বাংলাদেশ পুনর্গঠনে ড. ইউনূস 

গত আগস্টে যখন অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশে ফিরে এলেন, চারপাশের দৃশ্য ছিল ভয়াবহ। রাস্তায় তখনও রক্তের দাগ, আর পুলিশের গুলিতে নিহত হাজারেরও বেশি বিক্ষোভকারী ও শিশুর মরদেহ মর্গে স্তূপ হয়ে পড়েছিল।

১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনার সরকার ছাত্রদের নেতৃত্বে এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত হয়। সাধারণ মানুষের প্রতিশোধের ভয়ে তিনি হেলিকপ্টারে করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান, আর তার বাড়ি বিক্ষুব্ধ জনতা ভেঙে ফেলে।

নোবেল পুরস্কারজয়ী ৮৪ বছর বয়সী মুহাম্মদ ইউনূস, বহু আগেই রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন। তারপরও শেখ হাসিনার সরকারের দমন-পীড়নের শিকার হয়ে দীর্ঘদিন দেশের বাইরে থাকতে বাধ্য হন; তবে যখন ছাত্রনেতারা তাকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের অনুরোধ জানায়; যাতে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করা যায়; তিনি রাজি হন।

ড. ইউনূস বলেন, তিনি (হাসিনা) যে ক্ষতি করেছেন, তা অপরিসীম, বাংলাদেশ একদম ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। শুধু ভবন নয়, পুরো প্রতিষ্ঠান, নীতি, জনগণ, এমনকি আন্তর্জাতিক সম্পর্কও ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।  

শেখ হাসিনার শাসনামলে স্বৈরশাসন, সহিংসতা ও দুর্নীতির অভিযোগ ছিল ব্যাপক। তার শাসনের শেষ কয়েক মাস ছিল রক্তাক্ত—জুলাই ও আগস্টের বিক্ষোভে পুলিশের দমনপীড়নে ১৪০০-এর বেশি মানুষ নিহত হয়। জাতিসংঘ একে ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’ হিসেবে বিবেচনা করছে, যদিও হাসিনা অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

ইউনূসের ফেরাকে বাংলাদেশে নতুন যুগের সূচনা হিসেবে দেখা হয়েছিল। ছয় মাসের মধ্যে তিনি পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বিচারের আওতায় এনেছেন, যাদের বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ ছিল। গোপন বন্দিশিবির খালি করা হয়েছে, যেখানে হাসিনার সমালোচকদের নির্যাতন করা হতো বলে অভিযোগ রয়েছে। মানবাধিকার কমিশন গঠিত হয়েছে, আর হাসিনার বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা দায়ের হয়েছে, যদিও তিনি সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

ইউনূস ঘোষণা দিয়েছেন, ২০২৫ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের মার্চের মধ্যে বাংলাদেশে গত দুই দশকে প্রথমবারের মতো অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, তারপর তিনি ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন।

তবে ঢাকার রাস্তায় এখনো অনিশ্চয়তার বাতাস বইছে। ইউনূস এখনো জনপ্রিয় হলেও, তার প্রশাসনিক দক্ষতা এবং প্রতিশ্রুত সংস্কারের গতি নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।

বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের জন্য চাপ দিচ্ছে এবং ইউনূসের সরকারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। যেসব ছাত্ররা বিপ্লব ঘটিয়েছিল, তারা নিজেদের দলও গঠন করেছে।

বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, এই সরকার কেবলই একটি অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত কেউ দৈনন্দিন প্রশাসনের জন্য দায়বদ্ধ নয় এবং তাদের সংস্কার বাস্তবায়নের ক্ষমতা নেই। তাই যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন হওয়া দরকার।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি

শেখ হাসিনার শাসনামলে অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যাপক গণঅসন্তোষ ও মামলা হয়েছে, ফলে অনেক পুলিশ সদস্য দায়িত্বে ফিরে যেতে অনীহা প্রকাশ করে। এতে দেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি দ্রুত অবনতির দিকে চলে যায়। ঢাকার রাস্তায় গ্যাং অপরাধ বেড়েছে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বিভিন্ন ধরনের হয়রানির শিকার হচ্ছে।

অপরাধ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হওয়ায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর কুশপুত্তলিকা পুড়িয়ে বিক্ষোভকারীরা তার পদত্যাগের দাবি জানাচ্ছে।

ইউনূস যদিও দাবি করেছেন যে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি শেখ হাসিনার সময়ের চেয়ে খারাপ হয়নি, তবে সমালোচকরা সতর্ক করেছেন যে, এই পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। নতুন গঠিত ন্যাশনাল সিটিজেনস পার্টির (এনসিপি) প্রধান নাহিদ ইসলাম বলেছেন, এই পরিস্থিতিতে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।

হাসিনার পতন ও ইউনূসের প্রত্যাবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা সেনাপ্রধান, জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান এক ভাষণে বলেছেন, দেশ এক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে এবং যদি বিভাজন চলতে থাকে, তাহলে আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়বে।

ইউনূস অবশ্য বলছেন, সেনাবাহিনীর সঙ্গে তার সম্পর্ক ভালো এবং কোনো ধরনের চাপ নেই। তবে অনেকেই মনে করছেন, সেনাপ্রধানের বক্তব্য আসলে ইউনূসের নেতৃত্বের প্রতি কঠোর সমালোচনা, এমনকি সামরিক হস্তক্ষেপের সতর্কবার্তা হতে পারে।

ইউনূস মনে করেন, দেশের বর্তমান সংকটের মূল কারণ হাসিনার সরকার। তিনি বলেন, হাসিনার সরকার ছিল না, ছিল দস্যুদের পরিবার। নেতার একটা নির্দেশ, আর সেটা সাথে সাথে বাস্তবায়িত হতো। কেউ সমস্যা করছে? তাকে গুম করে দেওয়া হতো। নির্বাচন দরকার? নিশ্চিত করা হতো যে, তারা সব আসন জিতবে। টাকা দরকার? ব্যাংক থেকে কোটি কোটি ডলার ঋণ নেওয়া হতো, যা ফেরত দেওয়ার দরকারই পড়ত না।

হাসিনার শাসনামলে দুর্নীতি এতটাই গভীর ছিল যে, ব্যাংকিং খাত ধ্বংস হয়ে গেছে এবং অর্থনীতি সংকটে পড়েছে। তার আত্মীয়দের বিরুদ্ধেও অর্থ কেলেঙ্কারির অভিযোগ উঠেছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন যুক্তরাজ্যের লেবার পার্টির এমপি টিউলিপ সিদ্দিক। তিনি ব্রিটিশ ট্রেজারি থেকে পদত্যাগ করেছেন, কারণ তার সম্পদের সঙ্গে হাসিনার সরকারের দুর্নীতির যোগসূত্র খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তিনি অবশ্য সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও সুইজারল্যান্ডের আর্থিক কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া প্রায় ১৭ বিলিয়ন ডলার উদ্ধারের চেষ্টা করছে। তবে এটি কত দ্রুত দেশে ফেরত আনা সম্ভব হবে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে।

ইউনূসের আরেকটি চ্যালেঞ্জ হলো, সাম্প্রতিক সময়ে কট্টর ইসলামপন্থিদের উত্থান। হাসিনার আমলে ইসলামপন্থি দলগুলো একপ্রকার নিষিদ্ধই ছিল, যেমন জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধ হয়েছিল তার আমলের শেষদিকে এবং তাদের নেতারা দমন-পীড়নের শিকার হন। এখন তারা আবার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালানোর সুযোগ পাচ্ছে এবং তাদের জনসমর্থনও বেড়েছে।

এ ছাড়া, আগে নিষিদ্ধ থাকা উগ্রপন্থি গোষ্ঠীগুলোর তৎপরতাও বাড়ছে। সম্প্রতি ঢাকায় হিযবুত তাহরীরের শত শত কর্মী খেলাফত প্রতিষ্ঠার দাবিতে মিছিল করলে, পুলিশ টিয়ার গ্যাস ছুড়ে তা ছত্রভঙ্গ করে। এমনকি গ্রামাঞ্চলে কট্টরপন্থিরা কিশোরীদের ফুটবল ম্যাচ পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছে।

এই পরিস্থিতিতে ইউনূসকে বহুমুখী সংকট মোকাবিলা করতে হচ্ছে—নিরাপত্তা হুমকি, অর্থনৈতিক ধস, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সামরিক হস্তক্ষেপের আশঙ্কা। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, “দেশকে গণতন্ত্রের পথে ফিরিয়ে আনাই আমার প্রধান লক্ষ্য”।  তবে সামনে যে চ্যালেঞ্জগুলো অপেক্ষা করছে, তাতে এই পথ মোটেও সহজ হবে না।

ইউনূস ট্রাম্পের সমর্থন চাইছেন

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার পরিচালনায় ইউনূস শুধু অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি নন, বাইরের বিশ্ব থেকেও চাপ আসছে। শেখ হাসিনা ভারতের ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিলেন, এখন সেই দেশেই আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু হাসিনার পতনের পর থেকে দুই দেশের সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। ভারত কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না এই সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের, বরং সম্প্রতি দিল্লি অভিযোগ করেছে যে, বাংলাদেশ ‘সন্ত্রাসবাদের স্বাভাবিকীকরণ’ করছে।

ডিসেম্বরে, বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতকে হাসিনাকে ফেরত পাঠানোর অনুরোধ জানায়। তবে এখনো পর্যন্ত ভারত সরকার কোনো সাড়া দেয়নি। ইউনূস বলেছেন, ‘হাসিনা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য বিচারের মুখোমুখি হবেন, এমনকি যদি তা তার অনুপস্থিতিতেও হয়’।

এদিকে, হাসিনা এখনো সক্রিয়ভাবে ইউনূসের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে চলেছেন। সম্প্রতি তিনি ইউনূসকে ‘গডফাদার’ বলে আখ্যা দিয়ে অভিযোগ করেছেন যে, ‘তিনি দেশে সন্ত্রাসীদের উসকে দিচ্ছেন’।

ইউনূস স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন যে, ভারত যদি তাকে আশ্রয় দেয়, সেটা সহ্য করা যাবে, কিন্তু তাকে ব্যবহার করে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার সুযোগ দেওয়া হবে না।

যুক্তরাষ্ট্রের মন জয় করতে ইউনূস নতুন কৌশল নিয়েছেন—তিনি ট্রাম্পের অন্যতম প্রভাবশালী সমর্থক ও বিলিয়নেয়ার উদ্যোক্তা ইলন মাস্ককে বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। মাস্কের স্টারলিংক স্যাটেলাইট ইন্টারনেট পরিষেবা বাংলাদেশে আনার প্রস্তাব দিয়েছেন ইউনূস এবং সূত্র বলছে, এপ্রিলের মধ্যেই মাস্ক বাংলাদেশ সফরে আসতে পারেন।

ইউনূস আশাবাদী, ট্রাম্প বাংলাদেশকে একটি লাভজনক বিনিয়োগের সুযোগ ও বাণিজ্যিক অংশীদার হিসেবে দেখবেন। তিনি বলেন, ‘ট্রাম্প একজন ব্যবসায়ী, তাই আমি তাকে বলছি— আসুন, আমাদের সঙ্গে চুক্তি করুন’।  তবে যদি ট্রাম্প এতে আগ্রহী না হন, তাহলে বাংলাদেশ কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, কিন্তু গণতন্ত্রের যাত্রা থেমে যাবে না।

বাংলাদেশ সময়: ২১৪৫ ঘণ্টা, মার্চ ১০, ২০২৫
এমএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।