যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায়ের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে উত্তেজনা ছড়িয়েছে ইলন মাস্ক ও পিটার নাভারোর পরস্পর বিরোধী অবস্থান। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ দুই সহযোগী—টেসলার প্রধান নির্বাহী ইলন মাস্ক ও সাবেক বাণিজ্য উপদেষ্টা পিটার নাভারোর মধ্যে বাকযুদ্ধ এখন জনসমক্ষে তীব্র হয়ে উঠেছে।
সম্প্রতি সিএনবিসির কাছে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মাস্ককে ‘গাড়ি উৎপাদনকারী নয়, বরং যন্ত্রাংশ জোড়াতালি দিয়ে গাড়ি তৈরি করা অ্যাসেম্বলার’ বলে কটাক্ষ করেন নাভারো। তিনি অভিযোগ করেন, টেসলা সস্তা যন্ত্রাংশ আমদানি করে আমেরিকান অর্থনীতি ও জাতীয় নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলছে। টেক্সাসের টেসলা কারখানার উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, সেখানে জাপান, চীন ও তাইওয়ান থেকে আমদানি করা যন্ত্রাংশ দিয়ে গাড়ি অ্যাসেম্বল করা হয়। তার মতে, একজন প্রকৃত আমেরিকান গাড়ি প্রস্তুতকারক দেশিয় যন্ত্রাংশেই গাড়ি তৈরি করবেন।
নাভারোর এই মন্তব্যে পাল্টা জবাব দেন ইলন মাস্ক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ একাধিক পোস্টে তিনি নাভারোকে ‘নির্বোধ’ ও ‘গণ্ডমূর্খ’ বলে আখ্যায়িত করেন। এক পোস্টে মাস্ক তীব্র ভাষায় লেখেন, নাভারো এক বস্তা ইটের চেয়েও নির্বোধ। পরের পোস্টে আবারও কৌতুক করে যোগ করেন, ইটের কাছে ক্ষমা চাইছি—এই তুলনা ইটের বুদ্ধির অপমান।
মাস্ক দাবি করেন, যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি গাড়ির দিক থেকে টেসলা অন্য সব প্রতিষ্ঠানকে ছাড়িয়ে গেছে। তিনি বলেন, তার কোম্পানি দেশিয় উৎপাদনের প্রতি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়। অথচ নাভারোর বক্তব্য ভ্রান্ত এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
এই বাকযুদ্ধ মার্কিন রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। বিশ্লেষকদের মতে, মাস্ক-নাভারো বিরোধ কেবল ব্যক্তিগত নয়, বরং এটি ট্রাম্পের শুল্কনীতি ঘিরে দলের অভ্যন্তরে বিরাজমান মতবিরোধের বড় প্রতিফলন।
যদিও হোয়াইট হাউস এই বিষয়ে নিরপেক্ষ অবস্থান নেওয়ার চেষ্টা করেছে। প্রেস সচিব ক্যারোলিন লেভিট বলেছেন, তারা দুজন শুল্ক ও বাণিজ্যনীতি নিয়ে ভিন্নমত পোষণ করেন, এটা আমরা জানি। তবে ছেলেরা ছেলেদের মতো আচরণ করবে—এটা কোনো অস্বাভাবিক বিষয় নয়।
তবে এই বিবাদে ট্রাম্প এখনও প্রকাশ্যে কোনো মন্তব্য করেননি। দীর্ঘদিন ধরেই তার উপদেষ্টাদের মধ্যে মতভেদকে প্রশ্রয় দেওয়ার নীতিতে বিশ্বাসী তিনি। এমনকি অনেকে মনে করেন, এমন সংঘর্ষ ট্রাম্প ইচ্ছাকৃতভাবেই উৎসাহ দেন যাতে তিনি নিজেকে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে তুলে ধরতে পারেন।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাস্ক ও নাভারো—দুজনই ট্রাম্পের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সহযোগী হওয়ায় এ ধরনের প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব তাকে রাজনৈতিকভাবে চাপে ফেলতে পারে। ট্রাম্পের বিভিন্ন উদ্যোগে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থসাহায্য দিয়েছেন মাস্ক এবং প্রায় সব নীতির প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। যদিও শুল্কনীতি নিয়ে তিনি বরাবরই আপত্তি জানিয়ে এসেছেন। ইউরোপের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্যের পক্ষে তার অবস্থান স্পষ্ট।
অন্যদিকে, পিটার নাভারো ট্রাম্প প্রশাসনের প্রথম মেয়াদে বাণিজ্যনীতি প্রণয়নের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন। কংগ্রেসের তদন্তে সহযোগিতা না তিনি ‘কংগ্রেস অবমাননার’ অভিযোগে চার মাস কারাভোগ করেন। কারামুক্তির পরও তিনি ট্রাম্পের হয়েই প্রচারণায় সক্রিয় ছিলেন।
সাবেক এক উপদেষ্টা এনবিসি নিউজকে বলেন, নাভারো প্রেসিডেন্টের জন্য কারাবরণ করেছেন—এর চেয়ে বড় আনুগত্য আর কী হতে পারে? তার মতে, এই সম্পর্কের গভীরতা ট্রাম্পের কাছে অত্যন্ত মূল্যবান। তবে একইসঙ্গে তিনি এটাও স্বীকার করেন, ইলনও ট্রাম্পের খুব কাছের মানুষ। তাই এই বিরোধ কোথায় গিয়ে শেষ হবে, তা এখনই বলা কঠিন।
সব মিলিয়ে, মাস্ক-নাভারো দ্বন্দ্ব মার্কিন রাজনীতির অঙ্গনে একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে—যেখানে ব্যক্তিগত আক্রমণ, নীতিগত দ্বন্দ্ব এবং রাজনৈতিক কৌশল একসূত্রে গাঁথা হয়ে গেছে। এই সংঘর্ষ ভবিষ্যতের নীতিনির্ধারণে কী প্রভাব ফেলবে, তা এখন সময়ই বলে দেবে।
বাংলাদেশ সময়: ২১৩৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৪, ২০২৫
এমজে