ঢাকা, শনিবার, ১৫ আষাঢ় ১৪৩২, ২৮ জুন ২০২৫, ০২ মহররম ১৪৪৭

আন্তর্জাতিক

পাকিস্তানের পরমাণু বোমার জনক ‘একিউকে’, দেশে নায়ক বিদেশে খলনায়ক

আন্তর্জাতিক ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩:৩১, জুন ২৭, ২০২৫
পাকিস্তানের পরমাণু বোমার জনক ‘একিউকে’, দেশে নায়ক বিদেশে খলনায়ক ‘একিউকে’ বলে পরিচিত আব্দুল কাদীর খান

আব্দুল কাদীর খান পাকিস্তানের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় নাম। পরিচিত ‘একিউকে’ নামে।

 তিনি পাকিস্তানের পারমাণবিক কর্মসূচির স্থপতি এবং পাকিস্তানকে বিশ্বের প্রথম ইসলামি পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্রে পরিণত করার ক্ষেত্রে তার অবদান অনস্বীকার্য।

এজন্য পাকিস্তানে তিনি জাতীয় বীর। যদিও ইসরায়েলসহ পশ্চিমা বিশ্বের কারও কারও কাছে তিনি খলনায়ক। তারা তাকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ ও অবৈধ পারমাণবিক প্রযুক্তি পাচারকারী হিসেবে দেখতো।

১৯৩৬ সালের ১ এপ্রিল অবিভক্ত ভারতবর্ষের ভূপালে জন্ম নেওয়া আব্দুল কাদীর খান ছোটবেলা থেকেই বিজ্ঞান ও প্রকৌশলে আগ্রহী ছিলেন। ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ বিভক্তির সময় তার পরিবার পাকিস্তানে চলে যায়।

তিনি ১৯৬০ সালে করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে স্নাতক সম্পন্ন করেন। এরপর জার্মানির বার্লিনে মেটালার্জিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াশোনা করেন এবং পরে নেদারল্যান্ডস ও বেলজিয়ামে পারমাণবিক প্রযুক্তি ও ধাতুবিদ্যায় উচ্চতর প্রশিক্ষণ নেন।

সত্তরের দশকে পাকিস্তানের পারমাণবিক কর্মসূচি গড়ে তোলার সময় তিনি ইউরোপে ‘ইউরেনকো’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন। ১৯৭৬ সালে তিনি নেদারল্যান্ডস থেকে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের জন্য ব্যবহৃত  সেন্ট্রিফিউজের নকশা পাকিস্তানে নিয়ে আসেন, যা দেশটির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো তাকে এই প্রকল্পের দায়িত্ব দেন। ১৯৭৮ সালের মধ্যে তার নেতৃত্বে পাকিস্তান সফলভাবে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করতে সক্ষম হয়। ১৯৮৪ সালের মধ্যে পারমাণবিক বিস্ফোরণের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়। ১৯৯৮ সালে পাকিস্তান প্রথমবার পারমাণবিক পরীক্ষা চালায়, যা ছিল দেশটির শক্তির প্রকাশ এবং ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।

এই পরীক্ষার কারণে পাকিস্তান আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়ে এবং দেশের অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। খান তখন বলেন, পাকিস্তানের ইচ্ছা ছিল না পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করার, তবে প্রতিবেশী ভারত যেহেতু এরই মধ্যে পরমাণু বোমা বানিয়ে ফেলেছিল, তাই তারা বাধ্য হয়।

আব্দুল কাদীর খানের বিরুদ্ধে পশ্চিমাবিরোধী শক্তি হিসেবে পরিচিত ইরান, লিবিয়া ও উত্তর কোরিয়ায়ও পারমাণবিক প্রযুক্তি পাচারের অভিযোগ ছিল। এজন্য ২০০৪ সালে তাকে ইসলামাবাদে গৃহবন্দি করা হয় এবং ২০০৯ সালে তিনি মুক্তি পেলেও তার চলাফেরার ওপর কঠোর নজরদারি ছিল। তিনি ইসলামাবাদের বিলাসবহুল এলাকায় বসবাস করতেন এবং বাইরে বের হলেই সরকারি বাহিনী থাকত তার সঙ্গে।

২০০১ সালে প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফ যুক্তরাষ্ট্রের চাপের মুখে তাকে কাহুতা রিসার্চ ল্যাবরেটরির চেয়ারম্যান পদ থেকে সরিয়ে বিশেষ উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেন।  

ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সাবেক প্রধান শাবতাই শাভিত বলেছিলেন, যদি আব্দুল কাদীর খানের প্রকৃত উদ্দেশ্য তারা সঠিকভাবে বুঝতে পারতেন, তাহলে তিনি মোসাদের দল পাঠিয়ে খানকে হত্যার পরিকল্পনা করতেন।

ইসরায়েলি অনুসন্ধানী সাংবাদিক যোসি মেলম্যান হারেৎজ পত্রিকায় লেখেন, খান শুধু পাকিস্তানের জন্য পারমাণবিক বোমা তৈরি করেননি, তিনি ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিতে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন এবং লিবিয়ার মুয়াম্মার গাদ্দাফির পারমাণবিক প্রকল্পেও সহায়তা করেছিলেন।

মেলম্যান জানান, মোসাদ খানের মধ্যপ্রাচ্যে ঘন ঘন যাতায়াত লক্ষ্য করলেও তারা বুঝতে পারেনি তিনি কী করছেন। শাভিত বলেছিলেন, যদি তারা বুঝতে পারতেন, তাহলে তারা ইতিহাস বদলে দিতে খানকে হত্যার পরিকল্পনা করতেন।

মেলম্যান আরও দাবি করেন, ইরান খানের কাছ থেকে পাকিস্তানের পি-১ ও পি-২ মডেলের সেন্ট্রিফিউজের নকশা সংগ্রহ করেছিল। পরে ইরান এগুলো নিজেদের নামে ‘আইআর-১’ ও ‘আইআর-২’ হিসেবে তৈরি করে।

লিবিয়ার নেতা গাদ্দাফি ২০০৩ সালে ইরাক যুদ্ধের পর নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ ও ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এমআই-সিক্সের কাছে খানের পারমাণবিক নেটওয়ার্কের সমস্ত তথ্য ফাঁস করে দেন। ফলে তিনি পশ্চিমা দেশগুলোর চোখে অপরাধী হয়ে ওঠেন।

মার্কিন গোয়েন্দারা ১৯৭৫ সালেই খানের কাজ সম্পর্কে জানতেন, কিন্তু তারা পাকিস্তানের পারমাণবিক কর্মসূচি থামাতে উদ্যোগ নেননি বলে দাবি করেন মেলম্যান। ওই সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার কারণে পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্র বলয়ে থাকায় এই সুবিধা পেয়ে যায় বলে মনে করা হয়। মেলম্যান আরও বলেন, পাকিস্তান ১৯৯৮ সালে পারমাণবিক পরীক্ষা চালালেও খান অনেক আগেই দেশের পারমাণবিক সক্ষমতা অর্জন করিয়েছিলেন।

২০১২ সালে খান ‘তেহরিক-ই-তাহাফুজ পাকিস্তান’ নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। তবে ২০১৩ সালের নির্বাচনে দলটির কোনো প্রার্থী জিততে পারেনি। পরে দলটি বিলুপ্ত হয়।

খান এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, পরমাণু বোমার অধিকারী বানিয়ে আমি পাকিস্তান একবার রক্ষা করেছি। (এরপর বিদেশে প্রযুক্ত পাচারের) সব দায় আমার ঘাড়ে নিয়ে আবার রক্ষা করেছি।

এই বিজ্ঞানী মনে করতেন, পরমাণু প্রতিরক্ষাই সবচেয়ে বড় প্রতিরোধশক্তি।

সব বিতর্কের মাঝেও খান পাকিস্তানে এক সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি নিয়মিত বৈজ্ঞানিক শিক্ষার গুরুত্ব নিয়ে লেখালেখি করতেন এবং তার নামে বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গবেষণা কেন্দ্র ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

২০২১ সালে কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে ইসলামাবাদের এক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ৮৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুতে পাকিস্তানজুড়ে শোকের ছায়া নেমে আসে। আব্দুল কাদীর খানের জীবন, কর্ম এবং বিতর্ক পাকিস্তানের আধুনিক ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে লেখা রয়েছে।

আরএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।