ঢাকা, শুক্রবার, ২ শ্রাবণ ১৪৩২, ১৮ জুলাই ২০২৫, ২২ মহররম ১৪৪৭

আন্তর্জাতিক

ইসলামের মূল ধারা থেকে সরে যাওয়া এক জাতির নাম দ্রুজ

আন্তর্জাতিক ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫:১২, জুলাই ১৭, ২০২৫
ইসলামের মূল ধারা থেকে সরে যাওয়া এক জাতির নাম দ্রুজ

সিরিয়ায় সম্প্রতি নতুন করে সহিংসতার ঢেউ বইছে, যার পেছনে রয়েছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় দ্রুজদের সঙ্গে সুন্নি বেদুইনদের সংঘর্ষ এবং ইসরায়েলের সামরিক হস্তক্ষেপ। সিরিয়ার ভঙ্গুর নিরাপত্তা পরিস্থিতি ও নতুন সরকারের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা এই সহিংসতার পটভূমি তৈরি করেছে।

গত ১৩ জুলাই দক্ষিণ সিরিয়ায় দ্রুজ সম্প্রদায়ের এক ব্যবসায়ী অপহৃত হন বলে অভিযোগ উঠে। এরপরই দ্রুজ মিলিশিয়া ও সুন্নি বেদুইন যোদ্ধাদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ শুরু হয়। পরে ১৫ জুলাই ইসরায়েল সামরিকভাবে হস্তক্ষেপ করে। তারা দাবি করে, দ্রুজদের রক্ষার স্বার্থে এবং যেসব সরকারপন্থী বাহিনী তাদের ওপর হামলা চালিয়েছে, তাদের লক্ষ্য করে অভিযান চালানো হয়েছে।

মানবাধিকার পর্যবেক্ষক সংস্থা ‘সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস’ বলছে, ১৩ জুলাই থেকে শুরু হওয়া সংঘর্ষে সুয়েইদা প্রদেশে অন্তত ৩৫০ জন নিহত হয়েছেন। এই অঞ্চলে এর আগে এপ্রিল ও মে মাসে দ্রুজ যোদ্ধা ও সিরিয়ার নতুন নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে সংঘাতের ঘটনা ঘটেছিল, যাতে বহু মানুষের প্রাণ যায়।  

এর আগেও, মার্চ মাসে সিরিয়ার উপকূলীয় এলাকায় সংঘর্ষে আলাউই সম্প্রদায়ের শত শত সদস্য নিহত হন। ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ এই সম্প্রদায়েরই সদস্য ছিলেন।

বর্তমানে সিরিয়া দীর্ঘ গৃহযুদ্ধের ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে বিদ্রোহীরা রাজধানী দামেস্ক দখল করে নেন। নতুন সরকার গঠন করেন বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর সাবেক এক নেতা। তার নাম আহমেদ আল-শারা। তিনি সিরিয়ার সব সংখ্যালঘুর সুরক্ষা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবে সহিংসতা কমছে না।

ইসরায়েলের সামরিক হামলার কারণে এই সহিংসতা আরও বিস্তৃত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সিরিয়ায় শান্তি ও স্থিতিশীলতা এখন বড় প্রশ্নের মুখে, যেখানে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা, ধর্মীয় বিভাজন এবং প্রতিবেশী দেশের হস্তক্ষেপ জটিল পরিস্থিতি তৈরি করেছে।

দ্রুজ কারা?

সিরিয়া, লেবানন, ইসরায়েল এবং দখলকৃত গোলান মালভূমির পাহাড়ি অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা এক রহস্যময় জাতিগোষ্ঠীর নাম দ্রুজ। আরবি ভাষায় কথা বলা এই সংখ্যালঘু গোষ্ঠী ধর্মীয়ভাবে শিয়া ইসলামের শাখা থেকে উদ্ভূত হলেও, তাদের নিজস্ব বিশ্বাস, রীতিনীতি ও পরিচয় রয়েছে—যা মূলধারার ইসলাম থেকে অনেকটাই আলাদা।

প্রায় ১০ লাখ অনুসারীর মধ্যে অর্ধেকের ঠিকানা সিরিয়া। দেশটির মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩ শতাংশ এই সম্প্রদায়ের, যারা দীর্ঘদিন ধরেই রাজনৈতিকভাবে এক অস্থির ও অনিরাপদ অবস্থানের মধ্যে রয়েছেন।

ইসরায়েলে বসবাসরত দ্রুজরা তুলনামূলকভাবে আলাদা। দেশটির প্রতি তাদের আনুগত্য চোখে পড়ার মতো, বিশেষ করে সেনাবাহিনীতে তাদের অংশগ্রহণ ইসরায়েলি রাষ্ট্রের সঙ্গে এক ধরনের আত্মিক বন্ধন গড়ে তুলেছে। ইসরায়েল ও দখলকৃত গোলান মালভূমিতে দ্রুজদের সংখ্যা এখন প্রায় এক লাখ ৫২ হাজার। সরকারি হিসাব এমনটাই বলছে।

তবে সিরিয়ার বাস্তবতা আলাদা। প্রায় ১৪ বছর ধরে চলা গৃহযুদ্ধে এই সম্প্রদায় নিজেদের টিকিয়ে রাখতে গঠন করেছে নিজস্ব মিলিশিয়া, যারা দক্ষিণ সিরিয়ায় সক্রিয়ভাবে কাজ করে আসছে।

গত ডিসেম্বরে বাশার আল-আসাদের পতনের পর পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে। দক্ষিণ সিরিয়ার উপর কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টাকে অনেক দ্রুজ গ্রুপ সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছে। কেউ কেউ নতুন শাসকদের নিয়ে সংরক্ষিত মনোভাব দেখালেও সুয়েইদার মতো এলাকায় রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর উপস্থিতির বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ উঠে এসেছে। অনেকেই সরকারি সেনাবাহিনীতে যুক্ত না হয়ে নিজেরাই তৈরি করছে প্রতিরক্ষা গোষ্ঠী।

এদিকে সিরিয়ার সরকার প্রকাশ্যে দ্রুজদের ওপর হামলার নিন্দা জানালেও, বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। যুক্তরাজ্যভিত্তিক যুদ্ধ-পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস জানাচ্ছে—সরকার-সমর্থিত বাহিনী নিজেরাই কখনো কখনো এই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর বর্বরতা চালাচ্ছে। দ্রুজ জনগোষ্ঠীর সদস্যদের ওপর “তাৎক্ষণিক হত্যা” বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা উদ্বেগ বাড়াচ্ছে।

এইসব হামলা এবং নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে দিয়ে রাজধানী দামেস্কের প্রতি বহু দ্রুজ নাগরিকের অবিশ্বাস দিন দিন আরও গভীর হয়ে উঠছে। শিকড়ে টিকে থাকতে এখন তারা নির্ভর করছে নিজেদের হাতেই গড়ে তোলা প্রতিরক্ষা বলয়ের ওপর।

আসাদের আকস্মিক পতনের পর ইসরায়েল তার উত্তর সীমান্তবর্তী দ্রুজ সম্প্রদায়ের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়েছে সিরিয়ার সংখ্যালঘুদের সঙ্গে জোট গড়ে তোলার লক্ষ্যে। ইসরায়েল এখন নিজেকে সিরিয়ায় কুর্দি, দ্রুজ ও আলাউইতসহ আঞ্চলিক সংখ্যালঘুদের রক্ষাকর্তা হিসেবে উপস্থাপন করছে, যদিও পাশাপাশি তারা সিরিয়ার সামরিক ঘাঁটিগুলোতেও হামলা চালিয়ে যাচ্ছে।

গত মে মাসের সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ চলাকালে ইসরায়েল দামেস্কে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের কাছে হামলা চালায়—যা তারা দ্রুজদের ওপর হামলার বিরুদ্ধে ‘সতর্কবার্তা’ বলে দাবি করে। তবে সিরিয়া ও লেবাননের কিছু দ্রুজ নেতার অভিযোগ, ইসরায়েল ইচ্ছাকৃতভাবে সাম্প্রদায়িক বিভাজন উসকে দিচ্ছে—নিজেদের সম্প্রসারণবাদী লক্ষ্য পূরণের জন্য।

ইসরায়েল এখন কেন সিরিয়ায় হামলা চালাচ্ছে?

সাম্প্রতিক হামলাগুলো মূলত সিরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে সরকারি বাহিনীর উপস্থিতির বিরুদ্ধে সতর্কতা এবং প্রতিরোধ হিসেবে পরিচালিত হয়েছে। ইসরায়েল চায় সীমান্তবর্তী অঞ্চলটিকে ‘নিরস্ত্রীকৃত এলাকা’ হিসেবে গড়ে তুলতে। বিশেষ করে ইসলামপন্থী যোদ্ধাদের উপস্থিতি নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন। এই  যোদ্ধারা ইসরায়েল-অধিকৃত গোলান মালভূমির কাছাকাছি অবস্থান করছে।

১৫ জুলাই ইসরায়েলি বিমান হামলা সীমাবদ্ধ ছিল সুয়েইদায় নিরাপত্তা বাহিনী ও যানবাহন লক্ষ্য করে। কিন্তু ১৬ জুলাই হামলার পরিসর বাড়িয়ে ইসরায়েল দামেস্কের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও সেনাবাহিনীর সদর দপ্তরে আঘাত হানে। সিরিয়া এই হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে।

২০২৪ সালের ডিসেম্বরের পর এই হামলা সিরিয়ায় ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় সামরিক উত্তেজনা। তখন তারা দেশজুড়ে শত শত সামরিক স্থাপনা ধ্বংস করে এবং জাতিসংঘের নিয়ন্ত্রিত বাফার জোন দখলে নেয় গোলান মালভূমিতে।  

এসব হামলার লক্ষ্য ছিল নতুন সিরিয়ান প্রশাসনের সামরিক সক্ষমতা গড়ে তোলার প্রচেষ্টা ব্যাহত করা। এই সক্ষমতাকে ইসরায়েলের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে দেখা হয়।

১৬ জুলাই দামেস্কে হামলা শুরু হওয়ার পরপরই ইসরায়েলি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ সামাজিক মাধ্যমে লেখেন: দামেস্কের জন্য সতর্কবার্তা শেষ—এখন আসবে যন্ত্রণাদায়ক আঘাত।

সিরিয়ার রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন চ্যানেল ‘সিরিয়া টিভি’ সদর দপ্তরের সামনের দিক থেকে এই হামলার সরাসরি সম্প্রচার করে, যেখানে এক পর্যায়ে উপস্থাপককে স্টুডিও ছেড়ে পালাতে দেখা যায়।

বিশ্ব কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে?

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও বলেন, এই সহিংসতা নিয়ে আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। তিনি ১৬ জুলাই জানান, আমরা একমত হয়েছি, আজ রাতেই এই ভীতিকর পরিস্থিতার অবসানের জন্য নির্দিষ্ট কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

লেবানন, ইরাক, কাতার, জর্ডান, মিসর ও কুয়েতসহ একাধিক আরব দেশ সিরিয়ার সরকারি ও নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর ইসরায়েলি হামলার নিন্দা জানিয়েছে। সৌদি আরবের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একে ইসরায়েলের নির্লজ্জ আগ্রাসন বলে আখ্যা দিয়েছে। ইরান বলেছে, এই হামলাগুলো ছিল পুরোপুরি অনুমেয়।

তুরস্ক এই হামলাকে সিরিয়ার শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে এক ষড়যন্ত্রমূলক পদক্ষেপ  হিসেবে বর্ণনা করেছে।

জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসও সুয়েইদা ও দামেস্কে ইসরায়েলের উত্তেজনাকর হামলার নিন্দা করেছেন।

এখন কী হতে পারে?

এই সহিংসতা সিরিয়ার যুদ্ধ-পরবর্তী নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক কাঠামোর ভঙ্গুরতা আরও স্পষ্ট করে তুলেছে। সাম্প্রতিক হামলা ও সংঘর্ষ নতুন করে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার আশঙ্কা বাড়িয়েছে।

সিরিয়ার নতুন প্রেসিডেন্ট শারার নেতৃত্বাধীন ইসলামপন্থী সরকার দেশটিকে একত্রিত করতে এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোর আস্থা অর্জনের চেষ্টা চালাচ্ছে। তবে দীর্ঘদিনের গৃহযুদ্ধের জেরে দেশজুড়ে যে বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে, তা নিরসন করা সহজ হবে না।  

নতুন প্রশাসনের সঙ্গে দূরত্বে থাকা বিভিন্ন গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের সঙ্গে ইসরায়েলের জোট গড়ার প্রবণতা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলতে পারে। এর সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলে ইসলামপন্থী যোদ্ধাদের উপস্থিতিকে ইসরায়েল অনেকটা হুমকি হিসেবে দেখছে।

আরএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।