ঢাকা: যে ওষুধ দরকার ছিল না, সে ওষুধ খাইয়েছেন তিনি; যে চিকিৎসা দরকার ছিল না, সে চিকিৎসা দিয়েছেন তিনি; যার ক্যান্সার ছিল না, তাকে ক্যান্সারের রোগী বানিয়েছেন তিনি। যার কোনো রোগই ছিল না, তাকেও রোগী বানিয়েছেন তিনি।
যুক্তরাষ্ট্রের ডেট্রয়েট এলাকার ওই ‘কসাই’ ডাক্তারের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে শুক্রবার (১০ জুলাই) তাকে এ দণ্ড দিয়েছেন স্থানীয় বিচারিক আদালত। আদালতের আইনজীবীদের বরাত দিয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম শনিবার (১১ জুলাই) এ খবর জানিয়েছে।
সংবাদমাধ্যম জানায়, ৫০ বছর বয়সী ডা. ফারিদ ফাটা নামে ওই ‘কসাই’ ডাক্তারের বিরুদ্ধে রোগীদের ভুল চিকিৎসা, নীরোগকে ক্যান্সারের রোগী বানানোসহ ১৩টি চিকিৎসা জালিয়াতি, একটি ঘুষ জালিয়াতি ও দু’টি অর্থপাচারের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। লোমহর্ষক এসব অপরাধের স্বীকারোক্তি দিয়েছেন ‘কসাই’ ডা. ফাটাও।
সরকারি কৌঁসুলিরা তাকে ‘দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় খলনায়ক প্রতারক’ বলে অভিহিত করেছেন। তারা বলেছেন, ‘ডা. ফাটার কাছে রোগীরা মানুষ ছিল না, ছিল অর্থ উৎপাদন কেন্দ্র’।
সরকারি কৌঁসুলিদের হিসাব মতে, ডা. ফাটা ৫৫৩ জনেরও বেশি রোগীকে ভুলভাল চিকিৎসা দিয়েছেন। এর মাধ্যমে তিনি হাতিয়ে নিয়েছেন ১ কোটি ৭৬ লাখেরও বেশি মার্কিন ডলার।
ভুয়া চিকিৎসার শিকার রোগী ও রোগীদের স্বজনরা মিশিগানের ইস্টার্ন ডিস্ট্রিক্টের আদালতে মামলা দায়ের করলে গত ৭ জুলাই ‘কসাই’ ডাক্তার ফাটাকে গ্রেফতার করা হয়। নিরলস ও দ্রুত তদন্ত এবং ফাটার সরল স্বীকারোক্তি শেষে চার দিনের মাথায় রায় দিলেন জেলা আদালত।
রায় প্রদানের আগে ‘কসাই’ ফাটার শিকার রোগী ও রোগীর স্বজনদের নির্যাতনের বর্ণনায় পুরো এজলাসকক্ষ স্তম্ভিত হয়ে পড়ে। চোখ দিয়ে অশ্রু গড়ায় খোদ ‘কসাই’ ফাটারই।
গেরালডিন পারকিন নাম্নী এক রোগীর স্ত্রী জানান, ডা. ফাটার অধীনে চিকিৎসাধীন থেকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন তার স্বামী। শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তাকে নির্যাতন করা হয়েছিল। চিকিৎসার নামে তাকে ভয় দেখানো হতো, কোনো আকুতি-মিনতিতে কাজ হতো না।
রবার্ট সোবিয়ারে নামে এক রোগী বলেন, অসুস্থতা অনুভব করে আমি ডা. ফাটার কাছে গিয়েছিলাম। আড়াইবছর তিনি আমাকে কেমোথেরাপি দিলেন।
তিনি বলেন, ফাটার কেমোথেরাপি ভীষণ যন্ত্রণাদায়ক ছিল। যন্ত্রণার কথা তাকে বলাও যেতো না, তিনি আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ার ভয় দেখাতেন। তার চিকিৎসার কারণে আমাকে সত্যিই অসুস্থ হয়ে যেতে হয়েছে। আমার শক্ত দাঁতগুলো পড়ে যেতে থাকলো, পরিবর্তন হয়ে যেতে থাকলো মুখের আকৃতি। কিন্তু ক’বছর পর আমি জানতে পারলাম, আসলে আমার কোনো ক্যান্সারই ছিল না। কিন্তু ততদিনে আমার একটিমাত্র দাঁত ছাড়া সব পড়ে গেছে। সুস্থ আমি অসুস্থ হয়ে গেলাম।
সোবিয়ার বলেন, আমি বুঝতে পারলাম না কেন আমার সঙ্গে এমন করা হলো, কেন? আমি জানি না, এখন তাকে কী বলবো বা তার সঙ্গে আমার কী আচরণ করা উচিত।
শরীরে রক্তকোষের সংখ্যা কম ছিল বিধায় ২০১০ সালে এক পরিচিতজনের পরামর্শে ডা. ফাটার শরণাপন্ন হন প্যাটি হেস্টার।
‘অভিজ্ঞ’ ডাক্তার ফাটা অসহায় হেস্টারকে পেয়েই বলতে থাকেন, আপনার মিলোডিসপ্লাস্টিক সিনড্রোম (অকেজো রক্তকোষের কারণে শরীরে দেখা দেওয়া বিভিন্ন ধরনের অসুখ) দেখা যাচ্ছে। জরুরি ভিত্তিতে ক্যামোথেরাপি নিতে হবে, জরুরি।
কিন্তু ‘অতি চতুর’ ফাটার সঙ্গে বিতর্ক করে বেরিয়ে যান সচেতন হেস্টার। তিনি সাফ বলে দেন, রক্তকোষ কম থাকলেও সেগুলো অকেজো নয়, যে কারণে আমি এখনও স্বাভাবিক আছি, চলাফেরা করছি। ফাটা সতর্ক করলেও বেরিয়ে আসেন হেস্টার। পরদিন তার নজরে পড়ে টেলিভিশনে খবর বলা হচ্ছে, ‘ভুয়া চিকিৎসার অভিযোগে ডাক্তার ফাটা গ্রেফতার’।
২০১০ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ফাটার কাছে চিকিৎসা নিয়ে চলে যাওয়ার পর তার সঙ্গে আর দেখা হয়নি ক্রিস স্নিয়ারির। ৭ জুলাই ফাটাকে গ্রেফতারের পর আদালতে দেখা হয়। ‘অভিজ্ঞ’ ডাক্তারের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ শুনে বুকভরে শ্বাস নেন ক্রিস। তিনি স্মরণ করেন, তিন বছরে তাকে ৪০ দিনের কেমোথেরাপি, ১৪ দিনের হাইড্রেশন থেরাপি এবং আরও অনেকগুলো চিকিৎসা দেওয়া হয়েছিল।
স্নিয়ার আদালতে বলেন, আমি, আমার পুরো পরিবার তার ওপর পূর্ণ বিশ্বাস রেখেছিলাম। কিন্তু তিনি আমাকে অনেক বেশি অপ্রয়োজনীয় চিকিৎসা দিয়েছেন, ব্যয়বহুল ও যন্ত্রণাদায়ক থেরাপি দিয়েছেন। সার্বক্ষণিক ভয়ের মধ্যে রেখেছেন। আমাদের বিশ্বাসের পুরো ফায়দা লুটেছেন ডা. ফাটা।
পারকিন-সোবিয়ার-হেস্টার-স্নিয়ারদের এ ধরনের নিষ্ঠুরতার বর্ণনায় কাঠগড়ায় নতশির হয়ে পড়েন হেমাটোলজিস্ট-অঙ্কোলজিস্ট ডা. ফাটা।
নিজের এ ধরনের গর্হিত কাজে লজ্জাবোধের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি চিকিৎসকের শপথ ভঙ্গ করেছি, আমার রোগীদের বিশ্বাস নষ্ট করেছি। আমি জানি না, কীভাবে আমি তাদের এই ক্ষতিপূরণ করবো। আমি জানি না, এই দুঃখজনক ও লজ্জাকর ঘটনার জন্য কী বলবো। ’
বর্বর ‘ফাটা’ লজ্জাবোধের কথা প্রকাশ করলেও তার নির্যাতনের শিকার রোগী ও রোগীদের স্বজনরা বলেন, ‘এই ক্ষমা প্রার্থনা কিছুই নয়। ফাটার অপ্রয়োজনীয় ও অগ্রহণযোগ্য চিকিৎসার পরিণতি বয়ে অনেকে প্রাণ হারিয়েছেন, অনেকে বয়ে বেড়াচ্ছেন, সারাজীবন তাদের সেই ক্ষত বয়ে বেড়াতে হবে’।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৫৬ ঘণ্টা, জুলাই ১১, ২০১৫
এইচএ