ঢাকা, সোমবার, ৬ মাঘ ১৪৩১, ২০ জানুয়ারি ২০২৫, ১৯ রজব ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

গর্ভ ভাড়া ও দুই মায়ের গল্প

কল্লোল কর্মকার, আন্তর্জাতিক ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৫৯ ঘণ্টা, জুলাই ৩০, ২০১১
গর্ভ ভাড়া ও দুই মায়ের গল্প

গুজরাট: প্রতিটি নারীর কাছে তার সন্তান অমূল্য ধন। সেই জন্যই বুঝি বলা হয়- সন্তান নাড়ি ছেঁড়া ধন।

সন্তান জন্ম দিতে না পারলে ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সব নারীই তার জীবনকে বৃথা মনে করে। তাই নিজের সন্তান না হলেও দত্তক নিয়ে সন্তানের তৃষ্ণা মেটায় অনেক নারী।

কিন্তু আধুনিক যুগের সন্তান ধারনে অক্ষম নারীদের সন্তানের মা হওয়ার ধরন পাল্টেছে। দিন যত এগুচ্ছে প্রযুক্তি ততোই মানুষের অপূর্ণতাকে পূর্ণতার দিকে নিয়ে আসছে। তাই জমি ভাড়া নিয়ে ফসল উৎপাদনের মতো মায়ের গর্ভ ভাড়া নিয়ে সন্তান উৎপাদন আজ আর অবাক হওয়ার কোনো বিষয় নয়।

সে রকমই একটি ব্যবস্থা গর্ভ ভাড়া বা সারোগেশন। সারোগেশনের অর্থ হলো গর্ভধারণে সমর্থ মায়ের ভ্রুণে শুক্রানু প্রতিস্থাপন করে সন্তান লাভ।

প্রযুক্তির কল্যাণে এভাবে সন্তান উৎপাদন সম্ভব হলেও এতে এক মায়ের বুক যেমন আনন্দে ভরে ওঠে, ঠিক তেমনি ব্যথা, বেদনা আর কান্নায় ভারি হয়ে ওঠে গর্ভধারিণী মায়ের বুক।

ইউরোপ-যুক্তরাষ্ট্রে সারোগেশনের ব্যয় খুব বেশি। আর তাই ইউরোপ-যুক্তরাষ্ট্রের সন্তান ধারণে অসমর্থ নারীরা সারোগেশনের জন্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর দিকে ঝুঁকছে বেশি।

আয়ারল্যান্ডের নারী ক্যারোলিন। ২১ বছর বয়সে ক্যান্সারের কারণে তার গর্ভাশয়ের একটি অংশ অপসারণ করতে হয়। এতে চিরদিনের মতো সন্তান ধারণে অক্ষম হয়ে পড়েন তিনি। কিন্তু তার যে একটা সন্তান চাই। খুঁজতে খুঁজতে ভারতের গুজরাটের সোনালের সঙ্গে টাকার বিনিময়ে সারোগেশনের জন্য যোগাযোগ করেন তিনি। সোনাল রাজিও হন।

কিন্তু ২৬ বছর বয়সী সোনাল তার জন্ম দেওয়া সন্তানকে দেখতে না পাওয়ায় আক্ষেপ করে বললেন, ‘যখন আমার সন্তান জন্মায়, তখন আমি অচেতন ছিলাম। আর এরই মধ্যে তারা আমার সন্তাকে নিয়ে যায়। আমি একবারের জন্যও আমার সন্তানকে দেখতে পাইনি। আমার মা আমাকে জানালো, আমার একটি মেয়ে সন্তান হয়েছিল। ’

সোনালের বাড়ি গুজরাটের পশ্চিমে। বাড়িতে তার স্বামী-সন্তানকে ফেলে সন্তান জন্মদানের কয়েক মাস আগে থেকেই সোনাল গুজরাটের আনন্দ শহরের আকসানা ক্লিনিকে ছিলেন। ক্লিনিকটিতে এমন অসংখ্য নারী ভাড়ায় সন্তান ধারনের জন্য আসেন।

সোনালের স্বামী ফল বিক্রেতা। প্রতি মাসে তার আয় মাত্র ১৫০০ রুপি। সোনালের স্বামীর এই স্বল্প বেতন তার ছেলের পড়ালেখার খরচ মেটানোর জন্য যথেষ্ট নয়।

এটা ছিল সোনালের জন্য দ্বিতীয়বারের মতো ভাড়ায় গর্ভধারণ। আর এই গর্ভধারণের ফলে সোনাল আয় হয়েছে তিন লাখ রুপি।

টাকা পেয়ে তাই সোনাল আগামী সোনালী দিনের স্বপ্নে বিভোর হয়ে বললেন, ‘এখন আমার একটা ঘর হবে এবং আমি সন্তানের সঙ্গে আরামে সেই ঘরে থাকতে পারবো। আমি তাকে পড়ালেখা করাবো। ’

২০০২ সালেই ভারতে সারোগেশণকে বৈধতা দেওয়া হয় কিন্তু তারপরও এটা এখনও বিতর্কিত।

যখন সোনাল তার স্বামীকে সারোগেশনের ব্যাপারে বলেন, তখন তার স্বামী তাকে এটা করতে মানা করে। কারণ তার স্বামীর যুক্তি ছিল, সমাজ এটা গ্রহণ করবে না। কিন্তু শেষমেষ সোনাল তার স্বামীকে রাজি করায়।

‘যখন আমার প্রথম সারোগেট সন্তান হলো, তখন আমি তাকে শুধু তিনদিনের জন্য খাইয়েছিলাম। কিন্তু যখন ওকে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন আমি তা মানতে পারিনি। টানা তিন দিন কেঁদেছিলাম আমি ওর জন্য। আমি এখনও ওকে অনুভব করি। ’

‘এবার যখন ক্যারোলিন সন্তান নিয়ে গেল, তখন মনে হচ্ছিল যেন সে আমার নিজের সন্তানকেই নিয়ে গেলো। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সান্ত¡না দিলাম, সন্তানটা আমার নয়, ক্যারোলিনের। আমাকে ওই সন্তানের কথা ভুলে যেতে হবে। ’ কথাগুলো সারোগেট মা সোনালের।

ভারতে সারোগেশন নিয়ে অনেক সমালোচনা চালু আছে। সেই সমালোচনাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আকসানা ক্লিনিকের চিকিৎসক নয়না প্যাটেল বলেন, ‘যখন আপনি দেখবেন যে সারোগেশনের একটা সন্তান ধারণে অসমর্থ দম্পতির মুখে হাসি ফুটছে। সারোগেশনের কারণে কারও পরিবারের স্বচ্ছলতা ফিরে আসছে তখন কোনো সমালোচনাই আপনাকে আহত করতে পারবে না। ’

সন্তান জন্মানোর সময় কিছু অসংগতির কারণে সন্তানটিকে মায়ের দুধ খাওয়ানো বাধ্য হয়ে পড়ে। আর তাই ক্যারোলিনা সন্তানের জন্য সোনালকে বুকের দুধ পাঠাতে বললে সোনাল তা প্রত্যাখ্যান করে।

কারণ হিসেবে সোনাল বলেন, ‘আমি তাকে বলেছিলাম, যদি তুমি সন্তানকে দেখাশোনার জন্য কাউকে রাখতে পারো তাহলে তুমি তাকে খাওয়ানোর জন্যও কাউকে রাখতে পারবে। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, কেন আমি এখান থেকে তার জন্য দুধ পাঠাবো। কেন আমি আমার সন্তানের সঙ্গে থাকতে পারবো না?’

যদিও সোনাল কাউকেই বলেননি যে তিনি এখন কোথায় আছেন। শুধুমাত্র তার স্বামী জানে সে কোথায় আছে। যদি সমাজের কেউ তাকে সন্তান ধারণের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করে, তাহলে সন্তান ধারণের কথা অস্বীকার করবে বলেও জানায় সোনাল।

কিন্তু এই ক্ষতি মেনে নিয়েও সোনাল তার বাচ্চার জন্য বিলাপ করে ওঠে, ফেরত চায় নিজের সন্তানকে।

তাইতো আকুতি নিয়ে বলে ওঠে সোনাল, ‘আমার কোনো অনুতাপ নেই। যদি এই সমাজ আমাকে ঢুকতে না দেয়, যদি তারা আমাকে মেনে নাও নেয়, তাহলেও আমি পরোয়া করি না। আমি কোনো খারাপ কাজ করিনি। আমি এসব আমার সন্তানের জন্য করেছি। আমি এখন আর কিছুই চাই না, শুধু আমার সন্তানকে চাই। ’

বাংলাদেশ সময়: ১৮০৫ ঘণ্টা, জুলাই ৩০, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।