ঢাকা, রবিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

উ. কোরিয়ার শরণার্থীর সন্তান দ. কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট!

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৫৩ ঘণ্টা, মে ১০, ২০১৭
উ. কোরিয়ার শরণার্থীর সন্তান দ. কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট! মুন জে-ইন উত্তর কোরিয়ার এক শরণার্থী ঘরের সন্তান

কোরিয়া যুদ্ধে তুমুল প্রাণক্ষয় চলছিল তখন। ১৯৫০ এর ডিসেম্বর। সংঘাতস্থল উত্তর কোরিয়ার বন্দর নগরী হাংনাম। মুখোমুখি চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের (রাশিয়া) সমর্থনপুষ্ট উত্তর কোরিয়া জোটের সামরিক বাহিনী এবং যুক্তরাষ্ট্র-জাতিসংঘ-ইউরোপসহ পশ্চিমা সমর্থনপুষ্ট দক্ষিণ কোরিয়া জোটের সামরিক বাহিনী। কিন্তু সংঘাতের মধ্যে উত্তর কোরীয় বাহিনীর সুবিধাজনক অবস্থানে খানিকটা বেকায়দায় পড়ে যায় দক্ষিণ কোরিয়া জোট। 

সেখানে আটকা পড়ে জাতিসংঘ ও দক্ষিণ কোরিয়ার সামরিক বাহিনী, একইসঙ্গে আটকা পড়ে উত্তর কোরিয়ার অনেক বেসামরিক লোকজনও। এই অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস ট্রুম্যান পদাধিকার বলে জরুরি অবস্থা জারি করেন সব সামরিক শক্তি ও বেসামরিক লোকজনকে সরিয়ে নেওয়ার।

সামরিক বাহিনী তাদের সুবিধামতো জায়গায় সরে যাওয়ার পাশাপাশি নানা কায়দায় সেখান থেকে সরিয়ে বেসামরিক উত্তর কোরিয়ানদের রাখে দক্ষিণ কোরিয়ার সবচেয়ে বড় বন্দরনগরী পুসানসহ বিভিন্ন স্থানে।

এই বেসামরিক শরণার্থীদের মধ্যে ছিলেন মুন ইয়ং-হিয়াং ও ক্যাং হ্যান-ওক নামে এক দম্পতিও। তারা পুসান থেকে অদূরে আরেকটি শহর জেওসে বসতি গড়েন। শরণার্থী ইয়ং-হিয়াং জীবিকার জন্য শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে থাকেন যুদ্ধকালীন কারাগার জেওসে পো ক্যাম্পে। তিন বছর পর ১৯৫৩ সালের ২৪ জানুয়ারি এই জেওসে’ই হিয়াং-ওক দম্পতির ঘর আলোকিত করে হাসে তাদের প্রথম সন্তান মুন জে-ইন।

তারপর হিয়াং-ওক দম্পতির সংসারে রচিত হয়েছে সংগ্রামের অনেক গল্প। সংগ্রাম করতে করতে দীর্ঘ ৬৪ বছর পর ওই শরণার্থী দম্পতির ঘরে জন্ম নেওয়া সেই জে-ইনই আজ পৌঁছে গেছেন প্রাযুক্তিক ও অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্টের আসনে। বুধবার (১০ মে) দক্ষিণ কোরিয়ার ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি বা জাতীয় সংসদে রাষ্ট্রটির সর্বোচ্চ কর্তা হিসেবে শপথ নিয়েছেন জে-ইন।

শপথ নিয়েই অভিষেক অনুষ্ঠানে অর্থনৈতিকভাবে স্থিতিশীলতা ফেরানোর অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন জে-ইন। তবে তার বক্তৃতায় প্রকাশ পেয়েছে ‘পিতৃভূমি’র সঙ্গে ‘জন্মভূমি’র ‘সংঘাতপূর্ণ’ অবস্থা নিরসনের আন্তরিক ও একাগ্র ইচ্ছে।

সম্প্রতি কোরীয় উপদ্বীপ ঘেঁষে প্রশান্ত মহাসাগরে সামরিক শক্তির পাল্টাপাল্টি প্রদর্শনীর প্রেক্ষিতে উত্তেজনা ছড়াতে থাকার পরও জে-ইন বলে ফেলেছেন, তিনি কোরীয় উপদ্বীপে শান্তি চান। শান্তি ফেরাতে প্রয়োজনে পিয়ংইয়ংও সফর করবেন তিনি।  

‘আমি বেইজিং থেকে টোকিও, সব জায়গায় যাবো। এমনকি সুবিধামতো সময়ে পিয়ংইয়ং (উত্তর কোরিয়ার রাজধানী) সফরেও যাবো। ...এই কোরীয় উপদ্বীপে শান্তি ফেরাবোই। ’

সম্প্রতি উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে উত্তেজনার বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে মিত্র দক্ষিণ কোরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর ক্ষেপণাস্ত্র বিধ্বংসী থাড সিস্টেম মোতায়েনের বিষয়েও ওয়াশিংটন ও বেইজিংয়ের সঙ্গে ‘তাৎপর্যপূর্ণ সমঝোতা’ করবেন বলে জানান জে-ইন।

একজন দক্ষিণী প্রেসিডেন্ট হিসেবে উত্তর সফরের ইচ্ছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের ‘থাড সিস্টেম’ সরিয়ে নিতে আলোচনার ইঙ্গিত নিকট-অতীতের বিরলতম ঘটনা হিসেবেই দেখছেন রাজনীতি বিশ্লেষকরা। গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্বের উদারমনা এ রাজনীতিক সত্যিকার অর্থেই ‘পিতৃভূমি’র সঙ্গে ‘জন্মভূমি’র বিরোধ নিরসনের বিরল নজির স্থাপন করতে পারবে কিনা সেটা সময়ই বলবে। কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়ার ১ নম্বর কর্তার আসনে তার আরোহণ যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের জন্য খুশির খবর নয় বলেই মনে করা হচ্ছে। কারণ, জে-ইন নাকি পিয়ংইয়ংয়ের ‘পছন্দের’ প্রার্থী ছিলেন সদ্যসমাপ্ত নির্বাচনে। তার আলাপ সেই আভাসই দিলো বৈকি!

এক নজরে মুন জে-ইন
জন্ম ১৯৫৩ সালের ২৪ জানুয়ারি, দক্ষিণ কোরিয়ার জেওসে শহরে, মুন ইয়ং-হিয়াং ও ক্যাং হ্যান-ওক শরণার্থী দম্পতির ঘরে। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে জে-ইন বড়। বেড়ে ওঠা জেওসে এবং পরবর্তী সময়ে পার্শ্ববর্তী পুসান শহরে।

প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পড়াশোনা পুসানের কিয়াংনাম হাইস্কুলে। স্নাতক পড়তে আইন বিষয়ে ভর্তি হন রাজধানী সিউলের খ্যাতনামা কিয়াংঘি ইউনিভার্সিটি থেকে। ১৯৭০ এর দশকে ওই ইউনিভার্সিতে পড়ার সময় সেসময়কার সামরিক শাসক পার্ক চুং-হির (ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট পার্ক জুন-হাইয়ের বাবা) বিরুদ্ধে গণআন্দোলনে অংশ নেওয়ায় প্রতিষ্ঠান থেকে বহিষ্কৃত হন এবং কারারুদ্ধ হন। কারাগার থেকে বেরোনোর পর তিনি সামরিক বাহিনীতে গবেষণামূলক কাজ করতে বাধ্য হন।

সামরিক বাহিনী থেকে অব্যাহতির পর জে-ইন বার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং জুডিশিয়াল রিসার্চ ও ট্রেইনিং ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন। এখান থেকে জে-ইন আইন বিষয়ে স্নাতক সম্পন্ন করেন। এরপর তার বিচারপতি বা সরকারি কৌঁসুলি হওয়ার সুযোগ থাকলেও সে সুযোগ পায়ে ঠেলে তিনি মানবাধিকার আদায়ে আইনি লড়াইয়ে অবতীর্ণ হন। এই লড়াইয়ের জন্যই জে-ইনের উদার ও নিরপেক্ষ ভাবমূর্তি গড়ে ওঠে।

মানবাধিকার আদায়ে আইনজীবী হিসেবে কাজ করতে থাকার পাশাপাশি জে ইন তার বন্ধু রোহ মু-হিউনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সহযোগিতা করেন। রোহ মু-হিউন পরে প্রেসিডেন্ট হন এবং ২০০৩ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৯ সালে মু-হিউন আত্মহত্যা করলে জে-ইন আবার মানবাধিকার আইনজীবী হিসেবে কাজ করতে থাকেন।

এরপর আবার নিজেই রাজনীতিতে যুক্ত হন। ২০১২ সালে তিনি ডেমোক্রেটিক ইউনাইটেড পার্টি থেকে প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। কিন্তু এতে পার্ক জুন-হাইয়ের কাছে হেরে যান। ডেমোক্রেটিক পার্টি থেকেই নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে ২০১৫ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত তিনি সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করছিলেন।

ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট পার্ক জুন-হাইয়ের দুর্নীতি কেলেঙ্কারিতে বিভাজিত দক্ষিণ কোরিয়ানদের ঐক্যবদ্ধ করার অঙ্গীকারে সর্বোচ্চ কর্তার আসনে বসা জে-ইন তার অভিষেক ভাষণেই মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন, এই মুগ্ধতা উত্তপ্ত কোরীয় উপদ্বীপে ক’দিন থাকে তা-ই দেখার অপেক্ষায় বিশ্ববাসী, সঙ্গে উত্তর কোরিয়া এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের যুক্তরাষ্ট্রও!

বাংলাদেশ সময়: ১৪৫৩ ঘণ্টা, মে ১০, ২০১৭
এইচএ/

আরও পড়ুন
দ. কোরিয়ার নতুন প্রেসিডেন্টের শপথ, সফরের ইচ্ছা উত্তরে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।