ঢাকা: সভ্যতার শুরু থেকেই শত শত যুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী মানুষ। বলা যায়, যেদিন থেকে মানব সভ্যতার গোড়াপত্তন হয়েছে, সেদিন থেকেই সভ্যতার সঙ্গে জড়িয়ে গেছে যুদ্ধের ইতিহাস।
তেমনি এই একুশ শতকে লিবিয়ায় ত্রিপোলির পতনও হয়েছে এক বিশ্বাসঘাতকের কারণে।
গাদ্দাফির পতনের জন্য দায়ী সেই বিশ্বাসঘাতক এক খাবার সরবরাহকারী। আবদেল মজিদ ম্লেগতা নামের ওই খাবার সরবরাহকারী লিবিয়া সরকারের সব মন্ত্রণালয়েই খাবার সরবরাহ করতেন। এমনকি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়েও খাবার সরবরাহের খাতিরে তার ছিল অবাধ যাতায়াত। লিবিয়ায় বিদ্রোহ শুরু হওয়ার দুই মাস পরেই তিনি গাদ্দাফি বধের জন্য ন্যাটোর হাতে তুলে দেন গাদ্দাফি প্রশাসনের সব তথ্যসমৃদ্ধ তিনটি মেমোরি কার্ড।
সেই ম্লেগতার কণ্ঠেই উঠে এসেছে সেই কথা। বেশ কিছুদিন আগে একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘আমার জন্য কাজটি ছিল খুবই সোজা। কারণ আমি কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক তৈরি করেছিলাম। আমি দেশের সেবা করতে চেয়েছিলাম। ’
লিবিয়ায় বিদ্রোহ শুরু হওয়ার কয়েক সপ্তাহ পরেই দেখা গেল তিনি বিদ্রোহীদের হয়ে কাজ করছেন। গাদ্দাফি প্রশাসনের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার সময়ে তিনি একে একে ভিন্নমতাবলম্বীদের জড়ো করতে থাকেন। একেবারে কেন্দ্রীয় পর্যায়েও তিনি কিছু লোক নিয়োগ করেন। গাদ্দাফি প্রশাসনের দুর্বল জায়গাগুলো চিহ্নিত করেন এবং ত্রিপোলির কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সম্পর্কে সম্যক তথ্যাদি তিনি পাচার করেন বিদ্রোহী নেতাদের কাছে। তার এই সাহায্যের কারণেই পতন হয় লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলির, পতন হয় গাদ্দাফির।
প্রথমত তিনি গাদ্দাফির গোয়েন্দা এবং নিরাপত্তা বিভাগ সম্পর্কে তথ্য পাচার করেন। এ সময় তিনি রাজধানী ত্রিপোলির সাতটি মূল অপারেশন এলাকার যাবতীয় তথ্য ফাঁস করে দেন। এরমধ্যে ছিল নিরাপত্তা ব্যবস্থা, গাদ্দাফির বিপ্লবী কমিটি, গাদ্দাফির জনপ্রিয় মিলিশিয়া বাহিনী এবং সামরিক গোয়েন্দা বিভাগ সম্পর্কিত তথ্য।
এমনকি ওই তথ্যগুলোতে ওই ইউনিটগুলোর কমান্ডারদের নাম-ঠিকানাসহ যাবতীয় তথ্য ছিল। প্রতিটি ইউনিটে কতজন কাজ করে এবং ইউনিটগুলোতে গাড়ির সংখ্যা ও গাড়ির নম্বর কতো, এরকম বিশদ বর্ণনায় তিনি তথ্য পাঠান বিদ্রোহীদের কাছে। এছাড়া কিভাবে প্রতিটি ইউনিট গোয়েন্দা প্রধান আবদুল্লাহ আল সেনুসি এবং গাদ্দাফিপুত্র সাঈফ আল-ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাও তিনি জানিয়ে দেন।
ম্লেগতা গোপন তথ্যসম্বলিত যে তিনটি মেমোরি কার্ড ন্যাটোর কাছে হস্তান্তর করে, ওই তথ্যের ভিত্তিতে এবং মাঠ পর্যায়ের তদন্তের প্রেক্ষিতে ন্যাটো গোপনে ত্রিপোলির কাছে বিদ্রোহীদের কাছে অস্ত্র সরবরাহ করে এবং যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নেয়। ত্রিপোলির কমান্ড কাউন্সিল, সেইফ হাউজ, সেনাবাহিনীর ব্যারাক, পুলিশ স্টেশন, সাজোয়া যান, রাডার এবং টেলিযোগাযোগ কেন্দ্রগুলো ধ্বংসের পরিকল্পনা নেয় বিদ্রোহীরা। এরপরেই বিদ্রোহীরা চর্তুদিক দিয়ে আক্রমন করে বসে ত্রিপোলির।
বিদ্রোহীরা এই অপারেশনকে ‘ডন মারমেইড’ বা ‘ভোরের জলপরী’ নাম দেয়।
বিদ্রোহীরা হুট করেই আক্রমন করেনি রাজধানীতে। আক্রমনের আগে রাজধানীর ভেতরে নিজেদের সমর্থকদের বিভিন্ন জায়গায় মোতায়েন করে। নানা কায়দায় অস্ত্র চোরাচালান করে মজুদ করে।
ব্রিটিশ সামরিক কর্মকর্তারা বিমান হামলায় সহযোগিতার জন্য রেডিও সরঞ্জাম স্থাপন করেছিল ত্রিপোলির কাছে। নতুন অস্ত্র সরবরাহ এবং তা চালনার জন্য প্রশিক্ষণ দেয় ফ্রান্স। আর ওয়াশিংটন চালকবিহীন বিমান দিয়ে সাহায্য করে বিদ্রোহীদের। অপরদিকে আরব বিশ্বও বসে ছিল না। দুবাই এবং কাতার অস্ত্র এবং অর্থ সহায়তা থেকে শুরু করে ট্রেনিং পর্যন্ত দিয়েছে বিদ্রোহীদের।
এত কিছুর পরেই বিদ্রোহীরা ত্রিপোলিতে আক্রমন চালানোর সাহস পায়। জয়ের ব্যাপারে তারা এতোটাই নিশ্চিত ছিল যে, তারিখ এবং দিনক্ষণ ঘোষণা দিয়ে তারা ত্রিপোলিতে আক্রমন চালায়। আগস্ট মাসের ২০ তারিখ (শনিবার) ভোর আটটায় তারা হামলা চালায়। সে সময় ছিল রমজান মাস।
ত্রিপোলি আক্রমন বিষয়ে বিদ্রোহীদের রাজনৈতিক বিভাগের নেতা মোহাম্মদ গুলা বলেন, ‘আমরা কোনো গোপনীয়তা রাখিনি। আমরা বলেছি, আমরা ত্রিপোলির রাস্তায় আসছি। কিন্তু মানুষ তখন আমাদের কথা বিশ্বাস করেনি। কিন্তু তারা এখন আমাদের বিশ্বাস করছে। ’
বিদ্রোহ শুরু হওয়ার দুইমাস পর থেকেই মূলত ত্রিপোলি জয়ের পরিকল্পনা শুরু হয়। তিউনিশিয়ার শহর জেরবাতে বিদ্রোহী নেতা মাহমুদ জিব্রাইল এবং অন্য তিন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা কয়েক দফা গোপন বৈঠক করেন। এদের মধ্যে ছিলেন ত্রিপোলি থেকে পলাতক ম্লেগতা, আহমেদ মুস্তফা আল মাজবারি এবং ওসমান আবদেল জলিল। ওসমান একজন বিজ্ঞানী এবং ত্রিপোলি জয়ের মূল পরিকল্পনাকারী তিনি।
ম্লেগতা ত্রিপোলি থেকে পালান বিদ্রোহ শুরু হওয়ার দুই মাস আগে। এই দুই মাসে তিনি তথ্য পাচার এবং গাদ্দাফি অনুগত বাহিনী সৃষ্টিতে কাজ করেন। প্রথমত গাদ্দাফি প্রশাসনের ১৪ জন কর্তকর্তা তাকে সাহায্য করার জন্য রাজি হয়। শেষমেষ সাহায্যকারীর সংখ্যা দ্বাড়ায় ৭২ জনে। ম্লেগতা বলেন, ‘আমরা নিয়মিত আলোচনায় বসতাম আমার বাসায় এবং মাঝে মধ্যে অন্য কর্মকর্তাদের বাসায়ও বসতাম। আমরা কাজের গোপনীয়তা বজায় রাখতাম এবং সার্বক্ষনিক এনটিসির কার্যকরী কমিটির সঙ্গে যোগাযোগ রাখতাম। ’
বিদ্রোহীদের মূল অপারেশন সেন্টারের কমান্ডার বিগ্রেডিয়ার জেনারেল আবদুল সালাম আলহাসি বলেন, ‘লিবিয়ার পুলিশ, নিরাপত্তা বাহিনী, সেনাবহিনী এবং মন্ত্রীসভা থেকে কিছু সদস্যও আমাদের সাহায্য করেছে। তারা আমাদের তথ্য এবং নির্দেশনা দিয়েছেন। যেকোনো ভাবে তারা এই অভ্যুত্থাণকে সমর্থন জুগিয়েছেন। ’
এরকমই একজন হলেন আল বারানি আশকাল। ত্রিপোলিতে গাদ্দাফির সেনাবাহিনী কম্পাউন্ডের নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধান ছিলেন তিনি। অন্যদের মতো আশকালও ত্রিপোলিতে বিদ্রোহীদের ঢুকতে সাহায্য করে।
আস্তে আস্তে আরও লোক যোগ দিতে থাকে বিদ্রোহীদের পক্ষে। এদের মধ্যে অন্যতম হলেন ত্রিপোলি ব্রিগেডের প্রধান কমান্ডার হিশাম আবু হাজার, ত্রিপোলির বেশকিছু বিভাগের প্রধান ওসামা আবু রাশ এবং রাশেদ সুয়ান। রাশেদ বিদ্রোহীদের আর্থিকভাবে সহায়তা দিয়েছে।
ম্লেগতা ও হিশাম বুহাগিয়ারের মতে, ‘বিদ্রোহীরা ত্রিপোলির ১২০টি অংশ দিয়ে আক্রমন চালানোর পরিকল্পনা করে এবং অভিযানের মূলভাগে রাখে ন্যাটোকে। ’
এপ্রিলের ২০ তারিখ বিদ্রোহী নেতারা তাদের পরিকল্পনা এলিসি প্রাসাদে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজির কাছে পেশ করেন। পুরো এপ্রিল জুড়ে এরকম পাঁচটি বৈঠক হয় প্যারিসে। আর সবগুলো বৈঠকেই উপস্থিত ছিলেন ন্যাটোর চিফ অব স্টাফ।
ন্যাটোর সঙ্গে ত্রিপোলি অভিযানের আদ্যোপান্ত পেশ করার পর ম্লেগতা ওই তিনটি মেমোরি কার্ড হস্তান্তর করে ন্যাটো বরাবর। একটার মধ্যে ছিল ত্রিপোলির সব তথ্য, অন্যটিতে ছিল গাদ্দাফি প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ কিছু স্থানের বর্ণনা ও গাদ্দাফি প্রশাসনের ভেতর কাজ করা ৬৫ জন বিদ্রোহীদের অনুগত অফিসারের নামের তালিকা এবং সর্বশেষ মোমোরি কার্ডে ছিল ত্রিপোলি জয়ের মূল পরিকল্পনা। ওই ৬৫ জন অফিসারকে ন্যাটো রেডিওফোন সরবরাহ করেছিল সার্বক্ষণিক যোগাযোগের জন্য। সে সময় ত্রিপোলি জয়ের ওই পরিকল্পনার ব্যাপারে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন প্রেসিডেন্ট সারকোজি।
বিদ্রোহী কর্নেল বুহাগিয়ার বলেন, ‘বিদ্রোহীদের নেতৃবৃন্দ ত্রিপোলিতে আঘাত হানার লক্ষ্যস্থল ১২০ থেকে নামিয়ে এনে ৮২ করে এবং দুই হাজার সশস্ত্র ব্যক্তিকে ত্রিপোলিতে ঢুকতে বলা হয়। এছাড়াও ছয় হাজার অস্ত্রহীন মানুষকে রাস্তায় নামতে বলা হয় বিদ্রোহীদের সমর্থন আদায়ে। ’ বুহাগিয়ার ন্যাশনাল ফ্রন্ট ফর দ্য সালভ্যাশন অব লিবিয়াতে ১৯৮১ সালে যোগদান করেন। তিনি দীর্ঘদিন যুক্তরাষ্ট্রে বাস করেছেন এবং সুদান এবং ইরাক দুই জায়গাতেই তিনি বিশেষ বাহিনীর প্রশিক্ষক ছিলেন।
তবে এনটিসির একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, ‘এরইমধ্যে রাজধানী ত্রিপোলির ভেতর গাদ্দাফি বিরোধী কিছু গ্রুপ গড়ে উঠেছিল। তার যে কোনো মুহূর্তে আক্রমন শুরু করে দিতে পারতো। কিন্তু সমস্যা হলো আমাদের আরও কিছু সময়ের দরকার ছিল। আমাদের অস্ত্র এবং নৌকা চোরাচালানের জন্যও কিছু সময় দরকার ছিল। ’
বেশিরভাগ অনুপ্রবেশকারী মাছ ধরা নৌকায় করে ত্রিপোলিতে পৌঁছেছে বলে জানান আলহাসি। তারা সবাই রাইফেল এবং সাব-মেশিনগানের মতো হালকা অস্ত্রে সজ্জিত ছিল। এছাড়াও তাদের সঙ্গে ছিল গ্রেনেড ও রেডিও।
আলহাসি আরও বলেন, ‘আমরা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারতাম। তারা বেশিরভাগই ছিল স্বেচ্ছাসেবক ও প্রাবাসী লিবীয়। প্রত্যেকেই লিবিয়ার মুক্তির জন্য কিছু করতে চাইছিল। ওই সকল স্বেচ্ছাসেবকদের ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে পশ্চিমের পাহাড়ে। কিন্তু ফ্রান্সের গোয়েন্দা কর্মকর্তা এরিক ডিনেন্স জানান, বিদ্রোহীদের এলিট ফোর্সের ট্রেনিং লিবিয়ার ভেতরে এবং বাইরে দুই জায়গাতেই হয়েছে। এছাড়াও ন্যাটোর ঘাটিতে এবং পশ্চিমাদের ঘাঁটিতেও অনেক ট্রেনিং হয়েছে। ট্রেনিং পরবর্তী তাদের লিবিয়াতে পাঠানো হয়েছে। ডিনেন্সের মতে, ১০০-২০০ বিদেশি কর্মকর্তা ট্রেনিং দেওয়ার জন্য লিবিয়াতে গিয়েছিল। ম্লেগতাও এই পরিসংখ্যানের পক্ষেই বলেন।
গাদ্দাফির জন্মশহর সিরতে, বানি ওয়ালিদে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে এখনও প্রতিরোধ জারি রেখেছে গাদ্দাফি অনুগতরা। গত শুক্রবার গাদ্দাফি বাহিনীর হাতে মার খেয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পিছু হটেছে বিদ্রোহী সৈন্যরা। সিরতেও প্রতিরোধের মুখোমুখি হচ্ছে বিদ্রোহীরা। লিবীয় নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফি কোথায় আছে তা কেউ জানে না। তবে তিনি এখনও বিভিন্ন মাধ্যমে দেশের জনগণকে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার জন্য সাহস জুগিয়ে যাচ্ছেন।
এখনও যুদ্ধ চলছে লিবিয়ায়। প্রতিদিন ন্যাটো যুদ্ধ বিমানের বোমার শব্দে ঘুম ভাঙে লিবীয়বাসীর। প্রতিদিনই অনেক বেসামরিক মানুষ নিহত হচ্ছে বিদ্রোহী ও ন্যাটো বিমানের হামলায়। রাজধানী ত্রিপোলির হাসপাতালগুলোর অবস্থা নরকের মতো। নেই কোনো ডাক্তার, ওষুধ কিংবা অপারেশনের ব্যবস্থা। সবকিছুই ন্যাটোর বোমা হামলায় ধ্বংস হয়ে গেছে। কিন্তু এতোকিছুর পরেও থেমে নেই তেল নিয়ে আলোচনা। কত দ্রুত তেল উত্তোলন করা যায় এবং তেল রপ্তানিতে কত দ্রুত নতুন দেশ পাওয়া যায়, তা নিয়ে পশ্চিমা নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বিভিন্ন ফোরামে চলছে বিদ্রোহীদের দেনদরবার।
তারপরও প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায়, কেন আর কিসের জন্য লিবিয়ায় যুদ্ধ?
সূত্র: রয়টার্স
বাংলাদেশ সময়: ১৬৩২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০১১