ঢাকা: সম্প্রতি ভেনিজুয়েলাভিত্তিক গণমাধ্যম তেলেসুরের দুই সাংবাদিক লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলি সফর করে দেশে ফিরেছেন। ভেনেজুয়েলার মাইকুয়েতা বিমানবন্দরে নেমেই তারা লিবিয়ার ঘটনা নিয়ে আন্তর্জাতিক মূলধারার গণমাধ্যমের করা সংবাদকে ‘মিথ্যার বেসাতি’ বলে অভিহিত করেন।
যখন শান্তিপূর্ণ উপায়ে লিবিয়ার সমস্যা নিরসন করা যেতো, তখন লিবিয়ার জনগণ যুদ্ধ, মৃত্যু যন্ত্রণায় উপদ্রুত। তেলেসুরের সাংবাদিক রোলান্দো সেগুরা এবং চিত্রগ্রাহক হেনরি পিল্লাজো বিগত চারমাস লিবিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে বেড়িয়েছেন।
সেগুরা এবং পিল্লাজো দু’জন মিলে মূলধারার গণমাধ্যমে ছাপা হয়নি এমন অনেক সংবাদ প্রকাশ করেছেন। তাদের ছাপা হওয়া সেসব সংবাদের মধ্যে রয়েছে- ‘ন্যাটো বেসামরিকদের লক্ষ্য করে বোমা নিক্ষেপ করছে’ , ‘বিদ্রোহীদের হাতে নির্বিচারে নিহত হচ্ছে কৃষ্ণাঙ্গ অভিবাসী শ্রমিক’ , ‘সরকার এবং বিরোধীদলের সমন্বয়ে সরকার গঠনের পক্ষে লাখো জনতার গ্রিন মার্চ’। এছাড়াও তারা দাবি করছে, গত মাসে ত্রিপোলির গ্রিন প্লাজার যে ভিডিও ফুটেজ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোতে দেখানো হয়েছে, তা মূলত তৈরি হয়েছে কাতারে। ওই ভিডিও দেখেই ন্যাটো সমর্থিত এনটিসিকে (জাতীয় অন্তর্বর্তী পরিষদ) লিবিয়ার নতুন সরকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয় অনেকে।
আগস্টের ৮-৯ তারিখে ন্যাটোর ছোঁড়া ক্ষেপণাস্ত্রে ৮৫ জন বেসামরিক মারা যায়। মৃতদের মধ্যে ৩৩ জনই শিশু। এরকমই ন্যাটো হামলায় নিহত একজনের ভাই আবু মিমিয়ারের সাক্ষাৎকার নেন সেগুরা। মিমিয়ার বলেন, ‘আমার ভাই একজন কৃষক ছিলেন। তাকে হত্যা করে তারা (ন্যাটো) কি ধরনের নিরাপত্তা দিতে চাইছে আমাদের? অথবা আমরা যারা গাদ্দাফিকে সমর্থন করি, তাদের কি নিরাপত্তার প্রয়োজন নেই?’
মঙ্গলবার ভেনেজুয়েলার রাজধানী কারাকাসে ‘কোরেও দেল অরিনোকো’ আয়োজিত আলোচনা অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেওয়া সেগুরার মতে, লিবিয়াতে ন্যাটোর বোমা হামলাতেই ১৮০০ মানুষ মারা গেছে এবং পুরো যুদ্ধে ন্যাটোর হাতে মৃতের সংখ্যা ৫০ হাজার।
তেলেসুরের ওই দুই সাংবাদিক গত সপ্তাহে লিবিয়া ছেড়ে রওনা দেয়। লিবিয়ার মালটা থেকে টানা ৩৬ ঘণ্টা নৌকায় করে দেশে ফেরেন তারা। নৌকাটিতে মোট ৫০ জন যাত্রী ছিল এবং যাত্রীরা সবাই যুদ্ধের কারণে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিতে অন্যত্র যাচ্ছিল।
মার্চ মাসের ১৬ তারিখ থেকে যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটো বাহিনী লিবিয়াতে দুই হাজারেরও বেশি সামরিক অভিযান চালিয়েছে। এছাড়া নয় হাজারের বেশি বিমান হামলা চালিয়েছে তারা। গত রোববার ন্যাটো ৫২ বার বিমান হামলা চালিয়েছে। আর এই হামলায় বেশ বড়সড় ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত স্থাপনার মধ্যে রয়েছে তেল শিল্প, পানি সরবরাহ নেটওয়ার্ক, খাদ্য গুদাম, যোগাযোগ যন্ত্রপাতি এবং জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা। যার ফলে খাদ্য, পানি এবং ওষুধ সংকট দেখা দিচ্ছে লিবিয়াতে।
সোমবার উল্লসিত জনতার সামনে ভেনিজুয়েলার যোগাযোগ এবং তথ্যমন্ত্রী আন্দ্রেস ইসারা লিবিয়াতে তেলেসুরের ভূমিকা নিয়ে প্রশংসা করে বলেন, ‘মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের দাদাগিরি চরিত্র ব্যবহার করে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের নতুন রূপ দাঁড় করিয়েছে। যেসব দেশ মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির বিরোধীতা করে, তাদের বিরুদ্ধেই চালানো হচ্ছে এই প্রক্রিয়া। ’
তিনি আরও বলেন, ‘যেসব দেশ মার্কিন সরকারের বিরোধীতা করে তাদের বিরুদ্ধে মার্কিন সরকার প্রচার করে, তাদের দেশে নাগরিকদের স্বাধীনতা নেই। যুক্তরাষ্ট্র তার এই নতুন ‘রূপ’কে বর্ণবাদ এবং বর্তমান সময়ের বসন্ত বিপ্লবকে উস্কানি দিতে কাজে লাগিয়েছে। তারা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ব্যবহার তো করেই উপরন্তু প্রয়োজন হলে সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপও করে। ’
ইসারার মতে, সার্বভৌম দেশগুলোকে আক্রমনের ক্ষেত্রে এই নতুন পদ্ধতি এরইমধ্যে লিবিয়াতে সফল হয়েছে। একই সঙ্গে সিরিয়ার জন্যও তা হুমকি স্বরূপ।
ন্যাটো লিবিয়ায় বোমা হামলা শুরু করার পরপরই লিবিয়ায় তেলেসুরের রিপোর্টার জর্ডান রডরিগজ রিপোর্ট করেছিলেন, লিবিয়ায় বোমা হামলার জন্য দায়ী ন্যাটো এবং লিবিয়ার সাধারণ জনগণকে হত্যার জন্য বহুজাতিক বাহিনী দায়ী। রডরিগজ লিবিয়ার জনবহুল স্থানে ন্যাটোর বোমাহামলা চিহ্নিত করে লেখেন, ‘সে সময় সিএনএন এবং বিবিসি ন্যাটোর বোমা থেকে লিবীয়দের বেঁচে যাওয়ার ঘটনা প্রচার করেছে। কিন্তু ওই বোমাবর্ষণের ফলে লিবীয়দের প্রত্যাহিক জীবনে যে প্রভাব পড়েছে, তা নিয়ে তারা সংবাদ করেনি। ’
রডরিগজের মতে, তেলেসুর যুদ্ধের বিপরীত অংশের চিত্র তুলে ধরেছে। তেলেসুর যখন লিবিয়ার বিভিন্ন এলাকায় ঘুরেছে, তখন সেখানে গাদ্দাফির পক্ষে অনেক সমর্থক দেখতে পেয়েছে।
বিদ্রোহীদের প্রশিক্ষণ, অস্ত্র দেওয়া এবং উস্কে দেওয়ার জন্য রডরিগজ যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটোকে অভিযুক্ত করে বলেন, বিদ্রোহীরা কোনো কারণ না দেখিয়েই শুধু বলছে, তারা গাদ্দাফির পতন চান।
তেলেসুর কারাকাসভিত্তিক ল্যাটিন আমেরিকার একটি গণমাধ্যম। এর প্রেসিডেন্ট প্যাট্রিসিয়া ভিলেগাস লিবিয়াতে ন্যাটোর কার্যক্রম পরিদর্শনের জন্য সাংবাদিক প্রেরণের পরিকল্পনা গ্রহন করেছিলেন। তার মতে, আমাদের উদ্দেশ্য হলো যুদ্ধের শিকার মানুষদের ভাষ্য প্রকাশ করা। আমরা লিবিয়াতে আক্রমনকারীদের সঙ্গে ঢুকিনি, আমরা গুলি নিয়েও ঢুকিনি। কিন্তু অন্যান্য গণমাধ্যমগুলো তা করেছে। অন্য গণমাধ্যম কর্মীরা বিদ্রোহীদের গাড়িতে চড়ে ঘুরে বেড়িয়েছে। তেলেসুর এ ধরেণের সাংবাদিকতার চর্চা করে না।
এদিকে তেলেসুরের সাফল্যে ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হুগো শ্যাভেজ বলেন, ‘একেই বলে সাহস। তেলেসুরের প্রতি রইলো আমাদের সমর্থন এবং শ্রদ্ধা। ’
বাংলাদেশ সময়: ১৬৫০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২১, ২০১১