ঢাকা, মঙ্গলবার, ৭ মাঘ ১৪৩১, ২১ জানুয়ারি ২০২৫, ২০ রজব ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার বিতর্ক

জাহাঙ্গীর আলম, নিউজডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২৪৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৯, ২০১১
ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার বিতর্ক

ঢাকা: ১৯৪৭ সালে ভূখণ্ড হারিয়ে অরক্ষিত রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার পর এবার স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবি নিয়ে সরাসরি বিশ্ববাসীর দরবারে গেছে ফিলিস্তিন। গত ২০ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে পূর্ণ সদস্য পদের জন্য আবেদন করেছেন প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস।



এই আব্বাস, যাকে এতোদিন মনে করা হতো পুরোদস্তুর এক আমলাতান্ত্রিক লোক। ইসরায়েল ও তার সবচে ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের তীব্র বিরোধিতা উপেক্ষা করে আবু মাজেনের এই সাহসী পদক্ষেপের জন্য বিশ্লেষকদের প্রতিক্রিয়া মিশ্র।

কেউ মনে করছেন, নিষ্ফল শান্তি আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার চেয়ে, এটি ফিলিস্তিনের জন্য অনেক ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ফিলিস্তিন প্রশ্নে যেকোন প্রস্তাবে ভেটো দেওয়ার কথা সাফ জানিয়ে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। সুতরাং পূর্ণ সদস্য পদ পাওয়া হবে না সেটা প্রায় নিশ্চিত। এ কারণে অনেকে মনে করছেন, এ উদ্যোগ ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সমস্যার কোনো পরিবর্তন আনবে না।

তবে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার কৌশলে এটা একটা স্পষ্ট পরিবর্তন নিয়ে আসবে তাতে কারও সন্দেহ নেই। ওই দ্বিপক্ষীয় আলোচনা ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের জন্য এতোদিন কিছুই করতে পারেনি।

অনেক বিশ্লেষকই এ প্রশ্নে সন্দেহ পোষণ করেছেন, আবার কেউ নিরুত্তর থেকেছেন: ফিলিস্তিনের এই উদ্যোগ কি ইসরায়েলি দখলদারিত্বের অবসান ঘটাবে? এটা এই অঞ্চলে মার্কিন কূটনীতির বিকল্প হতে পারে?, বা এটা কি ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলকে আবার আলোচানার টেবিলে বসাবে? অথবা এই উদ্যোগ কি তৃণমূল পর্যায়ের ফিলিস্তিনিদের ঐক্যবদ্ধ করবে?

কয়েকজন কূটনীতিক ও বিশ্লেষকের কাছ থেকে এসব প্রশ্নের জবাব খোঁজার চেষ্টা করেছে আল জাজিরা।

আভি শ্লাইম

শ্লাইম অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক এবং সেইন্ট অ্যান্টোনিস কলেজের ফেলো। তার জন্ম ১৯৪৫ সালে ইরাকের রাজধানী বাগদাদে, বড় হয়েছেন ইসরায়েলে। আরব-ইসরায়েল দ্বন্দ্বের বিষয়ে বিশ্বজুড়ে তিনি একজন স্বীকৃত বিশেষজ্ঞ।

তিনি বলেন, জাতিসংঘে স্বীকৃতি নিতে যাওয়ার উদ্যোগের পেছনের প্রণোদনাটি হচ্ছে, ফিলিস্তিনিদের গত ২০ বছরের অভিজ্ঞতা। এই তিক্ত অভিজ্ঞতা সেই ১৯৯১ সালে আমেরিকার মধ্যস্থতায় এবং উদ্যোগে করা মাদ্রিদ কনফারেন্সের পর থেকে হজম করে আসছে তারা।

১৯৯৩ সালে অসলো শান্তিপ্রক্রিয়ার পর পরের দুই বছরের সময়ের অবস্থা থেকে আমেরিকা এখন অনেক দূরে সরে গেছে। ১৯৯৫ সালে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী আইজাক রবিন নিহত হলেন, আর এর পরই পুরো প্রক্রিয়াটি আরও খারাপের দিকে গেছে। প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ ফিলিস্তিনিদের জন্য এক দুঃস্বপ্ন। তিনি শ্যারনকে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে খেয়াল-খুশি মতো আচরণ করার পূর্ণ অধিকার দিয়েছেন।

এ অবস্থায় স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতির দাবি এই ভূখ-ে কোন পরিবর্তন আনবে না কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একটা কিছু তো হবেই। এটা বিতর্কের ভাব-ভাষায় পরিবর্তন আনবে এবং বিশ্বশক্তির সমর্থনের পাল্লা ফিলিস্তিনের দিকে হেলে পড়বে কিন্তু ইসরায়েলের বিপক্ষে যাবে। এটা আসলে একটা প্রতীকী পদক্ষেপ।

এখন পর্যন্ত পুরো শান্তি প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে আসছে আমেরিকা এবং ইসরায়েল। আলোচনা হতো ইসরায়েলের সুবিধা মতো শর্তের ভিত্তিতে। আর ফিলিস্তিনকে ওই শর্ত নিয়েই আলোচনায় বসতে হতো। এখন এই উদ্যোগ ওই মৌলিক জায়গাতে এবং মূলনীতিতে পরিবর্তন আনবে। এটা তো পরিষ্কার, দখলদারিত্ব বেআইনি আর ইসরায়েল একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের সীমানায় দালান তুলছে।

ফিলিস্তিনের জাতিসংঘে যাওয়ার এই উদ্যোগ কোনো পরবর্তনই যদি না আনতে পারে, তাহলে ইসরায়েল আর যুক্তরাষ্ট্র এতো উত্তেজিত হচ্ছে কেন? এ ব্যাপারে তারা গত ২০ বছর আগেও যেমন স্নায়ুবৈকল্যে ভুগত এখনও তেমনি করছে। শান্তি প্রক্রিয়াটি ছিল মার্কিন মধ্যস্থতায়, আর এটা ইচ্ছে করেই ধীর প্রক্রিয়া করা হয়েছে। এই সুযোগে ইসরায়েল সম্প্রসারণবাদী  এজেন্ডা চালিয়ে যাচ্ছিল আর একটা শান্তিপ্রক্রিয়ার মধ্যে থাকার ভান করছিল। এখন সেটা শেষ হয়ে গেল। এখন আর ভনিতা করার মতো কিছু থাকল না।

হাসান জাবারিন

জাবারিন একজন আইনজীবী। ইসরায়েলে আরব সংখ্যালঘুদের অধিকার সংরক্ষণে গঠিত আইনি সহায়তা কেন্দ্র আদালাহ’র প্রতিষ্ঠাতা মহাপরিচালক। ইসরায়েলি ল স্কুলে তিনি অতিরিক্ত প্রভাষক হিসেবে ১৯৯৮ সাল থেকে কর্মরত। ইসরায়েলে থাকা ফিলিস্তিনি নাগরিকদের আইনগত অবস্থান বিষয়ে তিনি পড়ান।

স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতির দাবিতে জাতিসংঘে যাওয়ার উদ্যোগটি ফিলিস্তিনের যে কোনো জাতীয় পদক্ষেপের ইতিহাসে আন্তর্জাতিকভাবে খুবই অস্বস্তিকর একটি আইনি পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হবে। আমি এই উদ্যোগের পক্ষে বা বিপক্ষে সেটা যাই হোক, আইনগত বিশ্লেষণে বুঝেছি, পিএলও এই উদ্যোগের আইনগত সবদিক বিবেচনা করেনি আর এর ফলাফল নিয়েও তারা ভাবেনি।

সেপ্টেম্বর ২০১১ তে জাতিসংঘে যে প্রস্তাব গৃহীত হতে যাচ্ছে তা ১৯৪৭ সালের বিভাজন প্রস্তাব (পার্টিশন রেজল্যুশন)-১৮১ এর সঙ্গে মিলিয়ে পাঠ করা উচিত। এই নতুন প্রস্তাব সেই প্রস্তাবের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়। আন্তর্জাতিক আইনের ব্যাখ্যার নিয়ম হলো, নতুন বিধান পুরনো বিধানের তুরুপ অথবা দুটি বিধান একই সঙ্গে মিলিয়ে পড়তে হবে।

রেজল্যুশন-১৮১ ইহুদি ও আরব নামে দুটি রাষ্ট্র গঠনের আহ্বান জানিয়েছে, যদিও আরবরা এর বিরোধিতা করেছে। কিন্তু এই প্রস্তাব সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েলের একটি আইনি ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছে। এর ভিত্তিতে ইসরায়েল রাষ্ট্রের সীমানা নির্ধারণ করা হয়ছে ১৯৪৭ সালের রোডম্যাপ অনুযায়ী, যা ভূখণ্ডের দিকে থেকে ফিলিস্তিনের অর্ধেক। এখন ইসরায়েল একটি স্বীকৃত স্বাধীন রাষ্ট্র যদিও এর স্বীকৃত কোন সীমানা নেই।

ফিলিস্তিনের এই নতুন উদ্যোগ ভৌগলিক বিবেচনায় ১৯৪৭ এর রেজুলেশনের আইনি দিকগুলোর পুনর্বিবেচনা করার সুযোগ সষ্টি করবে। অতএব ইহুদি রাষ্ট্র গঠিত হবে গ্রিন লাইনের সীমানার ওপর, যার ভৌগলিক আয়তন হবে ফিলিস্তিনের মোট ভূখণ্ডের ৭৫ শতাংশ।

ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের দাবিতে জাতিসংঘে যাওয়ার উদ্যোগ শরণার্থীদের ব্যাপারে কেমন প্রভাব ফেলবে?

১৯৪৮ সালে রেজুলেশন-১৯৪ অনুযায়ী ইসরায়েলে থাকা ফিলিস্তিনিদের ফিরে যাওয়ার এবং ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অধিকার সংরক্ষিত আছে। এই প্রস্তাবের (রাষ্ট্রের দাবি) একটি ব্যাখ্যা হল-১৯৪ বহাল থাকবে। অন্য ব্যাখ্যা হল- সেপ্টেম্বর-২০১১ প্রস্তাব দুটি নৃতাত্ত্বিক রাষ্ট্র সৃষ্টি করবে: ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েল কিন্তু কোনো ভাবেই ইহুদি-আরব রাষ্ট্র নয় এবং ফিলিস্তিন রাষ্ট্র কিন্তু কোনো ভাবেই ফিলিস্তিনি-ইহুদি রাষ্ট্র নয়। এখন এই নতুন নৃতাত্ত্বিক রাষ্ট্রে ক্ষতিপূরণ সহকারে ফিরে যাওয়ার অধিকার সংরক্ষিত হবে শুধু ফিলিস্তিন রাষ্ট্রে।

এটা হলে, ইসরায়েলে ফিলিস্তিনি নাগরিকদের কী হবে? এই নাগরিকদের সংস্কৃতি ও ভাষার অধিকার সংরক্ষণের জন্য ফিলিস্তিন রাষ্ট্রে যেতে হবে। দ্ইু বছর আগে ইসরায়েলের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী জিপি লিভনিও এরকম প্রস্তাব দিয়েছিলেন।

সুতরাং সেপ্টেম্বর-২০১১ প্রস্তাব ‘রাষ্ট্রের সব নাগরিকের সমান অধিকার’ এই আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের সঙ্গে নতুন দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করবে। হাস্যকর ব্যাপার হলো, ফিলিস্তিনিরা এই মানবাধিকারই চাইছে। জাতিসংঘের প্রস্তাবটি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যকার সম্পর্কেও প্রভাব ফেলবে।

ডানিয়েল লেভি

ইসরায়েল মন্ত্রিপরিষদের সাবেক উপদেষ্টা লেভি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিশ্লেষক। তিনি নিউ আমেরিকা ফাউন্ডেশনের মিডল ইস্ট টাস্ক ফোর্সের পরিচালক সেই সঙ্গে ফরেন পলিসি সাময়িকীর মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক সম্পাদক।

তার মতে, পিএলও’র এই উদ্যোগ কৌশলগত নয়। কিন্তু পদক্ষেপটি এসেছে আকস্মিকভাবে এবং তারা তাদের রাজনীতির ক্ষেত্রে কিছুটা পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছে। আমি মনে করি, এই উদ্যোগটি নেওয়া হয়েছে একটি কৌশলগত শূন্যতার মধ্যে। সুতরাং আমার বিশ্লেষণ হচ্ছে, এটা এসেছে একটা রাজনৈতিক হতাশা এবং উদ্বেগের ফলস্বরূপ, সেখানে ইচ্ছা ও উদ্দেশ্যের দায় খুবই নগণ্য।

একটা পরিষ্কার পরিকল্পনা না থাকা সত্ত্বেও, যদি ফিলিস্তিনিরা শুধুমাত্র সাধারণ পরিষদের ভোটে জিতে সামনে অগ্রসর হয় তাহলে আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোতে তারা খুব সামান্যই আশ্রয় পাবে।

যুক্তরাষ্ট্রের নিশ্চিত ভেটোর কারণে পূর্ণ সদস্য পদ পাবে না ফিলিস্তিন। নিরাপত্তা পরিষদের এই ব্যর্থতা এই প্রক্রিয়াকে আরও দীর্ঘায়িত করতে পারে। জাতিসংঘের যেকোনো আবেদন একটি টেকনিক্যাল কমিটি বিচার বিশ্লেষণ করে, এতেও অনেক সময় লাগতে পারে।

নুরা এরাকাত

এরাকাত একজন মানবাধিকার আইনজীবী ও লেখক। মধ্যপ্রাচ্যে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন বিষয়ে অতিরিক্ত অধ্যাপক হিসেবে বর্তমানে কর্মরত আছেন জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে। এছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক লিগ্যাল অ্যাডভোকেসি কোঅরডিনেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ফিলিস্তিনি শরণার্থী ও আবাসন অধিকার নিয়ে কাজ করে এমন একটি সংগঠন বাদিল সেন্টারের হয়ে।

তিনি বলেন, সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, এই উদ্যোগ ফিলিস্তিনি জনগণের মধ্যে একটা মেরুকরণ করেছে, আর এর পেছনে পিএলও’র উদ্দেশ্যটাও পরিষ্কার নয়।

তাত্ত্বিকভাবে কেউ বলতে পারে, এটা স্পষ্ট যে ফিলিস্তিনিরা নিজস্ব রাষ্ট্রের জন্য প্রকাশ্যেই কাজ করে যাচ্ছে, ১৯৮৮ সালে আলজিয়ার্সে পিএলও’র কসফারেন্সের পর থেকেই তারা এ ব্যাপারে তৎপর। জাতিসংঘে যাওয়ার ব্যাপারে পিএলও’র মধ্যে কোনো আলোচনা হয়নি, এটা হয়েছে প্রেসিডেন্টের একক নির্বাহী সিদ্ধান্তে। এই ঘটনা এখন বড় সন্দেহের সৃষ্টি করেছে যে, কেন এই উদ্যোগ, আর তার কৌশলই বা কি?
 
এই উদ্যোগকে এভাবে দেখা যায়: সম্পর্ক ছিন্ন করা এবং দ্বিপক্ষীয় আলোচনা থেকে এবার বহুপক্ষীয় ওকালতির দিকে যাত্রার একটি নতুন কৌশলগত অবস্থানের সূচনা। এই ধারণার কারণ হলো-এরকম কোনো ইঙ্গিত নেই যে, রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পাওয়ার পর ফিলিস্তিনিরা আবার দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় ফিরে আসবে।

আমি শুনেছিলাম, দাবি নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদে না গিয়ে সাধারণ পরিষদে যাওয়ার পক্ষেই জোর দেওয়া হয়েছিল। আমি ১১০ ভাগ নিশ্চিত যে, নিরাপত্তা পরিষদে যাওয়ার জন্য ফিলিস্তিনের বর্তমান নেতৃত্ব মোটেও প্রস্তুত নয়।

ফিলিস্তিনের এই উদ্যোগের ফলাফলকে নিশ্চিতভাবে শান্তি প্রক্রিয়া এবং দুইটি আলাদা রাষ্ট্র সমাধানের পথে ব্যর্থতায়ই বলা যাবে।

ডান গিলারমান

গিলারমান জাতিসংঘে নিযুক্ত ইসরায়েলের ১৩তম স্থায়ী প্রতিনিধি। এই দায়িত্বে তিনি ২০০২ সালের জানুয়ারি থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ছিলেন। এখন তিনি জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে নিউইয়র্কে অবস্থান করছেন।

আমি মনে করি, বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো ফিলিস্তিনিদেরও মূল উদ্দেশ্য হল স্বীকৃতি পাওয়া। কিন্তু এটাকে আমি প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের একটা প্রতীক হিসেবেও দেখি, কারণ সম্ভবত তারা (পিএলও) বুঝতে পারছে জনগণ তাদের কাছে কী চায়। সরাসরি বললে, আমি মনে করি তারা একটি গুরুতর ভুল করছে। আমি একটা বিষয় জানি যে, অনেক ফিলিস্তিনি নাগরিক, অনেক ফিলিস্তিনি নেতা এবং খোদ প্রধানমন্ত্রী সালমান ফায়েদ এটা একটা বাজে পরিকল্পনা বলেই মনে করেন।

এই মুহূর্তে নিজস্ব রাষ্ট্র পাওয়ার কোনো পথই নেই, কিন্তু একই সময় এই উদ্যোগ তাদের জনগণের মধ্যে উচ্চ প্রত্যাশার জন্ম দিতে পারে।

জাতিসংঘে একটা দস্তুরমতো নাটক হয়ে যাবে, আর নাটকের পর নাবলুস অথবা রামাল্লা বা জেনিনের সাধারণ ফিলিস্তিনিদের ঘুম ভাঙবে। তারা যখন তাকিয়ে দেখবে কোনো পরিবর্তনই অনুভুত হচ্ছে না, তখন হতাশার সাগরে নিমজ্জিত হবে। এই হতাশা থেকে সহিংসতার শুরু হতে পারে এবং আলোচনার টেবিলে বসতে ও শান্তি প্রক্রিয়া চালিতে নেওয়ার ক্ষেত্রে ফিলিস্তিনিদের দৃষ্টিভঙ্গি বিচ্যুতও হতে পারে।

ইসরায়েলি নেতারা সবসময়ই ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের কথা বলেছে। কিন্তু এটা তো একপক্ষের স্বাধীনতা ঘোষণা বা জাতিসংঘে একটা বড় উদ্যোগের মাধ্যমে অর্জন সম্ভব না। এটা সম্ভব আলোচনা ও সম্মতির ভিত্তিতে। শেষ পর্যন্ত হয়ত তারা জাতিসংঘের স্বীকৃতি পাবে কিন্তু তারা তো একটি স্বাধীন রাষ্ট্র পাবে না।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আমরা বক্তব্যের পিঠে বক্তব্য রাখার একটি পরিবেশের প্রত্যক্ষ সাক্ষী হয়ে গেছি। আমি মনে করি, সমস্যা হল শান্তি প্রক্রিয়াটি অনেক বেশি খোলামেলা বিষয়ে পরিণত হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এটা এখন শান্তি প্রক্রিয়া থেকে বরং সংবাদ সম্মেলনের রূপ নিয়েছে।

আমি মনে করি, মানুষের দুটি বিষয় কখনো জনসমক্ষে নিয়ে আসা ঠিক নয়। তা হলো: নারী-পুরুষের সহবাস আর শান্তি প্রক্রিয়া। এটা আবছা আলোতে হওয়াই ভাল। আমাদের খুবই গোপন, কৌশলী এবং নিবিড় ব্যাক চ্যানেল দরকার যা দুই পক্ষকে আলোচনার টেবিলে বসাবে এবং ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতির ব্যাপারে একটি সম্মতিতে পৌঁছানোর পথ উন্মুক্ত করবে।
 
হুসাম জুলমত

জুলমত ফাতাহর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা। তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা গাজার রাফা শরণার্থী শিবিরে। পরে রামাল্লার বিরজেইত বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়ার পর পিএইচডি করেছেন লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সে। এখন ৬৬তম জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে পিএলও’র প্রতিনিধ হিসেবে নিউইয়র্কে অবস্থান করছেন।

আমি এই উদ্যোগকে সমর্থন করি সেই সঙ্গে বিভিন্ন কারণে এর একটা অংশই হয়ে গেছি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে আমরা বহু বছর ধরেই জড়িত, এখন আমরা একটা রাষ্ট্রের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত।

এই উদ্যোগ প্রকৃতপক্ষে আমাদের, ফিলিস্তিনি জনগণ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে একটা চুক্তি আছে যার মাধ্যমে অবশেষে একটা সার্বভৌম রাষ্ট্র পাব আমরা। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ এবং জাতিসংঘের বিভিন্ন সংগঠনের মতে একটি স্বাধীন  রাষ্ট্রের জন্য আমরা প্রস্তুতি পর্বের সব কাজ করেছি। এটি হল চুক্তির প্রথম অংশ।

এখন সময় এসেছে চুক্তির অপর অংশের বাস্তবায়ন করা; সেটি হল আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যারা এতোদিন ফিলিস্তিনে আর্থিক সহযোগিতা দিয়েছে তারা আমাদের স্বীকৃতি দেবে। ফিলিস্তিন রাষ্ট্র যদি দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে না আসে তাহলে তা বহুপক্ষীয় ভাবেই হওয়া উচিত।

এই উদ্যোগের ফলে আমাদের লাভ হবে তিন দিক দিয়ে, আর এটাই আমাদের এই কাজে উৎসাহ দিয়েছে এবং পরিচালিত করেছে। বিষয় তিনটি হলো- আইনগত, রাজনৈতিক এবং কৌশলগত।

প্রথমত; রাষ্ট্র হিসেবে এটা একটা আইনগত ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করবে। এখানে মূল বিষয় প্রতিরক্ষা, আক্রমণ প্রতিরোধ করতে যা দরকার হবে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) এবং রাষ্ট্র হিসেবে কীভাবে তাদের স্মরণাপন্ন হওয়া যায় তা নিয়েও কথা হচ্ছে। আমাদের লক্ষ্য শুধু মামলা করা নয়, অব্যাহত অপরাধ বন্ধ করা।

আইনগত দিক থেকে, একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র হল একটি প্রতিরোধক অস্ত্র। আমরা ইসরায়েলের মতো প্রতি আক্রমণে যাচ্ছি না। আমাদের প্রতিরোধক অস্ত্র হচ্ছে আন্তর্জাতিক আইন। সীমান্তে একজন নারীর গায়ে আঘাত করার আগে ইসরায়েলি সেনারা দুইবার ভাববে।

রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে আমরা এই প্রক্রিয়ার অর্ধেক জিতেছি। ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা আন্তর্জাতিক আলোচনার বিষয়সূচিতে অন্তর্ভুক্ত করতে সক্ষম হয়েছি। ওই উদ্যোগের এটা একটা গুরত্বপূর্ণ কারণ, আর তা না হলে এটাকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নেওয়ার নিশ্চয়তা কেউ দিত না। এখন প্রত্যেক অধিকারকর্মী এবং সাংবাদিক ফিলিস্তিন নিয়ে কথা বলতে শুরু করেছে। সুতরাং আমাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল হয়েছে।

আর কৌশলগতভাবে, আমাদের উদ্দেশ্য হলো বিরাজমান পরিস্থিতিকে চ্যালেঞ্জ করা। আপনি জিজ্ঞেস করতে পারেন, সেটা কীভাবে। কীভাবে ইসরায়েল গত প্রায় ২০ বছর ধরে এমন পরিস্থিতি অব্যাহত রেখেছে? দ্বিপক্ষীয় আলোচনা কিছুই করতে পারেনি, আর এই পরিস্থিতি ধরে রাখার অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে এই শান্তি আলোচনা। আমরা কৌশলগত কারণেই এটা বন্ধ করেছি। পূর্বের শর্তের ভিত্তিতে আলোচনা করা মানে আলোচনা আরও দীর্ঘায়িত করা। আমরা পুরনো নির্বুদ্ধিতার দিনে ফিরে যেতে চাই না।

আমাদের লক্ষ্য জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্য পদ পাওয়া। এটাই আমাদের জন্য সবচেয়ে সহজ এবং সংক্ষিপ্ত পথ যা আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছে দেবে।

বাংলাদেশ সময়: ২২০৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৯, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।