আগামী শীতে ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় গ্যাসের ঘাটতির সঙ্গে সমন্বয়ের জন্য বেশ কিছু পরিকল্পনা নিয়েছে যুক্তরাজ্য সরকার। এ সময় দেশটি বিদ্যুতের চাহিদা সমন্বয়ের জন্য শিল্পকারখানাসহ আবাসিকেও লোডশেডিংয়ের ঘোষণা দিতে যাচ্ছে বলে জানিয়েছে ব্লুমবার্গ।
যুক্তরাজ্য সরকার জানায়, ‘যুক্তিসঙ্গত সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি’ মোকাবিলা করতে গিয়ে বিদ্যুতের সরবরাহে ঘাটতি হতে পারে। প্রাথমিক অনুমান অনুসারে, মোট চাহিদার প্রায় ৬ শতাংশ পর্যন্ত ঘাটতি হতে পারে শীত মৌসুমে। কিছুদিন আগে দেশটির জরুরি কয়লা কেন্দ্রগুলি পুনরায় চালু করা হয়েছে, এই ঘাটতি মোকাবিলায়। কিন্তু নরওয়ে এবং ফ্রান্স থেকে বিদ্যুৎ আমদানি হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হওয়া এবং আসন্ন জানুয়ারিতে তীব্র শীত হলে গ্যাস সংকট মোকাবিলায় বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে অন্যান্য স্থানে গ্যাস সরবরাহ সচল রাখা হবে। এ ক্ষেত্রে লোডশেডিংয়ের মুখে পড়বে দেশটি।
সরকারি ডিপার্টমেন্ট ফর বিজনেস, এনার্জি অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্ট্র্যাটেজি (বিইআইএস) এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, আসলে পরিস্থিতি এমন হবে বিষয়টি আমাদের জানা ছিল না। গৃহস্থালি, ব্যবসা এবং শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো এই আস্থা রাখতে পারে যে, তাদের জন্য (আবশ্যিক) প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ এবং গ্যাস সরবরাহ করা হবে।
যুক্তরাজ্য তার নিয়মিত চাহিদা অনুসারে কীরকম ঘাটতি হতে পারে, তার সঠিক মূল্যায়ন এখনো করতে পারেনি। তবে এটি স্পষ্ট পরবর্তীতে বরিস জনসনের স্থলে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঋষি সুনাক বা লিজ ট্রাস যেই আসুক, তার জন্য কঠিন এক শীত মৌসুম অপেক্ষা করছে। পরিস্থিতি খারাপ হলে বর্তমানে ২০০০ হাজার পাউন্ডের বদলে বার্ষিক বিদ্যুতের খরচ বাড়িয়ে ৪২০০ পাউন্ড পরিশোধের পরও লোডশেডিংয়ের সম্মুখীন হতে পারে ব্রিটিশরা। এতে দেশটির ইতোমধ্যে চলমান মুদ্রাস্ফীতি আরও বাড়বে।
ব্রিটেনে প্রথমবারের মতো বার্ষিক বিদ্যুৎ বিল ৪ হাজার পাউন্ডের বেশি হচ্ছে। যদি এবারের শীত মৌসুম অতিরিক্ত ঠাণ্ডা হয়, তাহলে ব্রিটেনকে গ্যাসের জন্য ইউরোপের মূল ভূখণ্ডের গ্যাস পাইপলাইনে ওপর নির্ভর করতে হবে, যা রাশিয়ার কারণে এরই মধ্যে বেশ ম্লান সম্ভাবনা দেখাচ্ছে গ্যাস পাওয়ার। আর এখানে যুক্তরাজ্যের সবচাইতে বড় সংশয়। কেননা দেশটিতে গ্যাস সংরক্ষণ করে রাখার মতো তেমন বড় ব্যবস্থাপনা নেই। আর এ কারণেই দেশটি গ্রীষ্মে প্রচুর গ্যাস রফতানি করে, যেন শীতকালে আমদানি সুবিধা পায়।
এদিকে ইউরোর বিপরীতে পাউন্ডের মূল্য বিগত দুই সপ্তাহের মধ্যে সবচেয়ে কম অবস্থায় আছে। ডলার বিনিময়েও যেই উন্নতি হয়েছিল, তা বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ১.২০৮০।
বিইআইএস বিবৃতিতে জানায়, যুক্তরাজ্য রাশিয়ার গ্যাস সরবরাহের ওপর নির্ভরশীল নয়। দেশটির উত্তর সাগর নিজস্ব গ্যাস মজুদের ব্যবস্থাপনা চলছে, যা ইউরোপের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম। এছাড়াও নির্ভরযোগ্য অংশীদারের কাছ থেকে গ্যাস পাওয়ার বিষয়টিও নিশ্চিত করা হয়েছে। গ্যাস সরবরাহ ও মজুদের জন্য একটি দুর্দান্ত চুক্তির আওতায় আসতে যাচ্ছে ব্রিটেন।
এদিকে যুক্তরাজ্যের গ্যাসের প্রধান বিকল্প ছিল ব্রিটেনের বৃহত্তম প্রাকৃতিক গ্যাস স্টোরেজ সাইট কোম্পানি ‘রাফ’। এর মালিক সেন্ট্রিকা পিএলসি বলেছেন, এই শীতে পরিষেবা ১০টি এলএনজি কার্গোর সমান হবে। তবে এটি আসলে মোট ঘাটতির তুলনায় উল্লেখযোগ্য কোনো ভূমিকা রাখবে না। দেশটি তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের কার্গোর জন্যও আন্তর্জাতিক বাজারে তীব্র প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি জানান, যুক্তরাজ্যের জরুরি পরিকল্পনার প্রথম পর্যায়ে নেটওয়ার্ক অপারেটর সিস্টেমে গ্যাসের প্রবাহ করা হবে এবং এ ক্ষেত্রে বেশ কিছু বাণিজ্যিক চুক্তিকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হবে। আর এই পরিকল্পনার দ্বিতীয় পর্যায়ে, গ্যাস নির্ভর বেশ কিছু পাওয়ার স্টেশনে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করা হবে, যার ফলে শিল্প এবং আবাসিক ব্যবহারকারীদের জন্য পরিকল্পিত লোডশেডিং শুরু হবে।
ব্রিটেনের এই পরিস্থিতি আরও নাজুক হয়ে যাবে যদি ফ্রান্স, নরওয়ে, বেলজিয়াম এবং নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে সংযুক্ত তাদের বিশাল তারের সংযোগে বিদ্যুতের সরবরাহ কমে যায়। এদিকে নরওয়ে সোমবার জানিয়েছে, তারা নিজেদের অভ্যন্তরীণ ঘাটতি রোধে শীতকালে বিদ্যুৎ রফতানি সীমিত করার বিষয়ে ভাবছে। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রেও বিপদে পড়তে যাচ্ছে যুক্তরাজ্য।
অরোরা এনার্জি রিসার্চের ভাষ্যানুসারে, নরওয়ের তুলনায় যুক্তরাজ্যে বিদ্যুতের দাম বেশি। আর ব্রিটেন (বিদ্যুৎ) আমদানির ওপর নির্ভর করে। আর এ কারণেই যে কোনো ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ আমদানি কম হলে ন্যাশনাল গ্রিডকে সচল রাখতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে সচল করতে বাধ্য হবে যুক্তরাজ্য।
ইলেক্ট্রিসিটি দে ফ্রান্স এসএ জানিয়েছে, বিদ্যুৎ রপ্তানিতে ঘাটতি থাকতে পারে তাদের। কেননা তাদের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর অর্ধেকের কিছু কমগুলোতে এখনো রক্ষণাবেক্ষণের কাজ চলছে। আর এটি প্রত্যাশিত সময়ের থেকে বেশি সময় লাগছে সম্পন্ন হতে।
এদিকে ব্রিটেনের ন্যাশনাল গ্রিড এরই মধ্যে জানিয়েছে, বিদ্যুতের দাম হবে আকাশচুম্বি। আর এক্ষেত্রে আবাসিক গ্রাহকদের জন্য ৪০০ পাউন্ড ভর্তুকি যথেষ্ট হবে না, যা রাজস্ব বিভাগের চ্যান্সেলর থাকা অবস্থায় সুনাক ঘোষণা করেছিলেন।
এ বিষয়ে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের মুখপাত্র এই সপ্তাহে জানান, সামনে যিনি ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হবেন তাকে যে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য সাহায্য করা হবে। বরিস জনসন মঙ্গলবার ডাউনিং স্ট্রিট সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে অতিথিদের জানান, তিনি ‘পুরোপুরি নিশ্চিত’ যে, তার উত্তরসূরি যিনি হবেন আবাসিক গ্রাহকদের জন্য আরও সহায়তা ঘোষণা করতে চাইবেন। ব্রিটেনের কাছে এটি করার জন্য ‘ফিসকাল ফায়ারপাওয়ার’ রয়েছে।
এদিকে আসন্ন নেতৃত্বের প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকা ট্রাস, অবিলম্বে ট্যাক্স হ্রাস এবং এনার্জি বিল থেকে সবুজ শুল্ক অপসারণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এর ফলে বছরে আবাসিকদের ১৫৩ পাউন্ড সাশ্রয় হবে। এদিক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হবার দৌড়ে থাকা সুনাক বলেছেন, একবার এনার্জি বিলের ওপর নতুন মূল্যসীমা সম্পর্কে অবগত হবার পর তিনি বিদ্যমান সরকারি প্যাকেজের মধ্য থেকেই নতুন ঘোষণা দেবেন।
ব্রিটেনে বিদ্যুতের মূল্য কত বাড়ানো হচ্ছে, এ বিষয়ে আগস্টের শেষে ঘোষণা দেবে এ বিষয়ক নিয়ন্ত্রক সংস্থা অফজেম। এটি অক্টোবরে কার্যকর হবে। কিন্তু এবার ৬ মাসের পরিবর্তে ৩ মাসের জন্য মূল্য ঘোষণা করা হবে। অর্থাৎ জানুয়ারিতে এই মূল্য আবার বাড়তে পারে।
বাংলাদেশ সময়: ১৭১১ ঘণ্টা, আগস্ট ১০, ২০২২
এমজেএফ