কোরবানিতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার প্রতিও আমাদের বিশেষ যত্ন নিতে হবে। কোরবানি আমার, এর রক্ত ও বর্জ্য পরিষ্কারের দায়িত্বও আমার- এই মনোভাব আমাদের লালন করতে হবে।
যেহেতু প্রিয় পশু কোরবানির মাধ্যমে আমরা মহান আল্লাহর নিকটবর্তী হই, এজন্য একে কোরবানি বলা হয়। মূলত কোরবানির বিধানের নেপথ্যে রয়েছে আত্মত্যাগের এক বিস্ময়কর আখ্যান। মহান আল্লাহর প্রিয় নবী হজরত ইবরাহিম (আ.) জীবনে অনেক বড় বড় পরীক্ষার মুখোমুখি হয়েছিলেন। নিজ পুত্রকে কোরবানি করা ছিল সেই পরীক্ষাগুলোর অন্যতম। ইবরাহিম (আ.) দীর্ঘজীবন নিঃসন্তান ছিলেন। শেষ বয়সে তাঁর ঔরসে জন্ম নেন হজরত ইসমাইল (আ.)। স্বপ্নে আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর সন্তানকে কোরবানি করার নির্দেশপ্রাপ্ত হন ইবরাহিম (আ.)। এত বড় পরীক্ষা, তবু দ্বিধা করেননি তিনি। আল্লাহর নির্দেশে সন্তানকে কোরবানি করতে প্রস্তুত হন তিনি। কিন্তু চূড়ান্ত মুহূর্তে ইসমাইলের (আ.) পরিবর্তে জান্নাত থেকে আসা একটি প্রাণী দুম্বা জবাই হয়ে যায়।
মূলত ইসমাইল (আ.) কে কোরবানি করা আল্লাহর উদ্দেশ্য ছিল না। আল্লাহর উদ্দেশ্য ছিল হজরত ইবরাহিমকে (আ.) কে পরীক্ষা করা। সেই পরীক্ষায় তিনি সফলভাবে উত্তীর্ণ হয়েছেন। ইবরাহিম (আ.)-এর সেই অমূল্য স্মৃতি আজও বেঁচে আছে আমাদের পশু কোরবানির ভিতরে।
কোরবানির উপর্যুক্ত ঘটনা আমরা কমবেশি সবাই জানি। কিন্তু এর পেছনে ত্যাগের যে অনন্য শিক্ষা সুপ্ত রয়েছে, তা আমরা উপলব্ধি করি না। এ ঘটনা আমাদের শেখায়, ইবরাহিম (আ.) যে একনিষ্ঠতা নিয়ে সন্তানের গলায় ছুরি ধরেছিলেন, সেই একই নিষ্ঠা ও নিয়ত আমাদের কোরবানির ভিতর থাকতে হবে। কোরবানির মূল লক্ষ্য ত্যাগ; কিন্তু আমাদের কোরবানি ভোগসর্বস্ব হয়ে উঠছে। কোরবানিতে আল্লাহ আমাদের তাকওয়া দেখতে চান। কিন্তু আমরা কোরবানি দিই লৌকিকতা, মাংস খাওয়া, প্রভাব জাহির ইত্যাদি উদ্দেশ্যে। অথচ তাকওয়াটাই কোরবানি। আল্লাহ বলেছেন- আল্লাহর কাছে এগুলোর রক্ত-মাংস পৌঁছে না; বরং তাঁর কাছে পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া [হজ-৩৭]। মহান আল্লাহ হাবিল-কাবিলের কোরবানি প্রসঙ্গে সুরা মায়িদার ২৭ নম্বর আয়াতে বলেছেন, আল্লাহ তো মুত্তাকিদের কাছ থেকেই (কোরবানি) কবুল করেন।
পরিমাণে কম হলেও অন্যান্য ইবাদতে নিষ্ঠা ও ইখলাস বিদ্যমান থাকে কিন্তু অধিকাংশের কোরবানিতে সেটুকুও থাকে না। প্রধান কারণ, কোরবানি এমন এক ইবাদত, যার পার্থিব লাভ তৎক্ষণাৎ পাওয়া যায়। সেই লাভ হলো মাংস; পাশাপাশি নাম-যশ-প্রভাব প্রদর্শনের সুযোগ থাকেই। এ কারণে কোরবানির তাকওয়া ধরে রাখা খুব কঠিন হয়ে যায়।
অনেক কারণে আমাদের কোরবানি অর্থহীন হয়ে যেতে পারে। তার একটি হলো পশুর সঙ্গে অমানবিক আচরণ। অল্প সময়ে অধিক লাভে বিক্রির জন্য পশুর গায়ে মাংস বর্ধিতকরণ ইনজেকশন দেওয়া হয়। বিক্রির সময় বলপূর্বক পানি খাইয়ে পেট ফোলানো হয়। আবার পরিবহনের সময়ও তাদের ওপর জুলুম করা হয়। ট্রাকের অল্প জায়গায় গাদাগাদি করে অসংখ্য গরু দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। কখনো গরুর চোখে মরিচ দেওয়া হয়, যেন ঘুমে-ক্লান্তিতে শুয়ে পড়তে না পারে। আবার জবাইয়ের সময়ও অনেক ক্ষেত্রে ভোঁতা ছুরি ব্যবহার করা হয়, গলার রগের ভিতর খোঁচানো হয়। এসবই অমানবিক আচরণ। রসুল (সা.) বলেছেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ প্রত্যেক জিনিসের প্রতি দয়া করাকে আবশ্যক করেছেন। অতএব, যখন তোমরা হত্যা কর (শরিয়তসম্মত), তখন উত্তমভাবে হত্যা কর। আর যখন তোমরা জবাই কর, তখন উত্তমভাবে জবাই কর। তোমাদের প্রত্যেকে যেন তার ছুরিটি ধার করে নেয় এবং যেন সে তার জবাইকৃত প্রাণীকে কষ্ট না দেয় (মুসলিম)।
অনেকে কসাইকে বিনিময় হিসেবে কোরবানির মাংস প্রদান করেন। এটা ঠিক নয়। কোরবানির পশুর প্রতিটি অংশই আল্লাহর জন্য উৎসর্গিত। এর কোনো অংশই বিক্রয়যোগ্য নয়। আপনি যখন পারিশ্রমিক হিসেবে কসাইকে মাংস দেন, যেন সেটা আপনি কসাইয়ের পাওনা টাকার বিনিময়ে বিক্রি করলেন। আলি (রা.)-এর প্রতি রসুল (সা.) নির্দেশ দিয়েছিলেন, তিনি যেন কোরবানির মাংস কসাইকে না দেন (বোখারি)। এই কাজ থেকে আমাদের বিরত থাকতে হবে। আমরা কসাইকে তার পূর্ণ পারিশ্রমিক অর্থের মাধ্যমে দেব, কোরবানির মাংসের মাধ্যমে নয়। নতুবা আমাদের কোরবানি অর্থহীন হয়ে যেতে পারে।
কোরবানিতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার প্রতিও আমাদের বিশেষ যত্ন নিতে হবে। কোরবানি আমার, এর রক্ত ও বর্জ্য পরিষ্কারের দায়িত্বও আমার- এই মনোভাব আমাদের লালন করতে হবে। জবাইয়ের পর আমরা রক্ত মাটিতে পুঁতে ফেলব। নাড়িভুঁড়ির বর্জ্য আমরা সুনির্দিষ্ট স্থানে ফেলব। আমাদের কোরবানির বর্জ্যে যেন পথচারী, প্রতিবেশী কারও কোনো কষ্ট না হয়, খেয়াল রাখব। ইমাম সাহেবরা এ বিষয়ে জোরালো ভূমিকা রাখতে পারেন। ঈদের খুতবায় জনসাধারণকে সজাগ করার পাশাপাশি মসজিদের লোকবল ব্যবহার করে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় তাঁরা বিশেষ উদ্যোগ নিতে পারেন। ফলে ইমামদের প্রতি জনসাধারণের আস্থা, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা আরও বাড়বে। পাশাপাশি মসজিদগুলো হয়ে উঠবে কল্যাণকর সামাজিক কাজের কেন্দ্রবিন্দু।
পশুত্বকে দমন করে ইবরাহিমি চেতনায় কোরবানি করার তাওফিক আল্লাহ আমাদের দান করুন।
লেখাটি শায়খ আহমাদুল্লাহর বক্তব্য থেকে নেওয়া।
এসআই