প্রকৃত ধর্মের শিক্ষা এমন এক শক্তি, যা পুরো সমাজকে পরিবর্তন করতে পারে। আল্লাহর পক্ষ থেকে যে দীন এসেছে, তার মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে মানুষের কল্যাণ সাধন।
মানুষের অকল্যাণ হয় এমন কোনো কিছুই ধর্মের অন্তর্ভুক্ত নয়। বর্তমানে ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা সমাজে বর্তমান না থাকার কারণে আমরা দেখতে পাই কীভাবে অন্যায়, অত্যাচার, অবিচার সমাজে ধাই ধাই করে বাড়ছে। শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা পৃথিবী আজ অন্যায়, অবিচার, অশান্তিতে পরিপূর্ণ। অথচ মানুষ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তাদের ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতাগুলো পালন করছেন। ধর্ম পালন আজ আনুষ্ঠানিকতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। প্রকৃতপক্ষে মানুষ যদি তাদের ধর্মের শিক্ষাগুলোকে নিজেদের মধ্যে ধারণ করত, তবে সমাজে তার প্রতিফলন দেখা যেত, সমাজ হত অনাবিল শান্তিময়।
বর্তমানে আমরা মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক জীবনের দিকে একটু লক্ষ্য করলেই দেখতে পাই অন্তর্কোন্দল, হানাহানি, বিভেদ, বিচ্ছেদ, সর্বোপরি আত্মিক শূন্যতা। স্বামী স্ত্রীকে অবহেলা করছে, স্ত্রীও স্বামীকে মানছে না, পিতা পুত্রকে খুন করছে, পুত্র পিতাকে। বাবা মেয়েকে ধর্ষণ করছে, নিজ সন্তানের হাতে খুন হচ্ছে বাবা-মা। এ অবস্থার পরিবর্তনের জন্য আইনকে কঠিন থেকে কঠিনতর করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখতে পাচ্ছি, সবচেয়ে আপন নিজ পরিবারের কাছেও একজন নারী আজ অনিরাপদ।
মানুষ যখন নিজের পরিবারের সদস্যদের দ্বারা আক্রান্ত হতে শুরু করে, তখন সেই সমাজকে শুধু আইন দিয়ে পরিবর্তন করা যায় না, প্রয়োজন হয়ে পড়ে মানুষের আত্মিক পরিবর্তনের। প্রকৃত ধর্মবিশ্বাসী কোনো মানব সমাজের চিত্র এমন হতে পারে না। আজ কেন মানুষের সমাজে এত অসন্তুষ্টি, এত বিশৃঙ্খলা, এত বিভক্তি? এর একটি মাত্র কারণ, তা হচ্ছে মানুষ তার ধর্ম পালন করছে না। সবার প্রথম জানা প্রয়োজন ধর্ম কী?
ধর্ম হচ্ছে কোনো পদার্থ বা প্রাণীর প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য। যেমন আগুনের ধর্ম পোড়ানো, পানির ধর্ম ভেজানো। ঠিক একইভাবে মানুষের ধর্ম হলো মানুষের অভ্যন্তরস্থ মানবীয় গুণাবলী। সৃষ্টির প্রতি সহানুভূতি, দয়া, মায়া, ভালোবাসা, মনুষ্যত্ব, মানবতা, সৌহার্দ্য, বিবেক, সহমর্মিতা, শৃঙ্খলা ইত্যাদি মানবীয় গুণাবলী হলো মানুষের ধর্ম। যতক্ষণ একজন মানুষ অন্যের ব্যথায় ব্যথিত হয়, অন্যের দুঃখে দুঃখী হয়, অন্যের আনন্দে আনন্দিত হয়, অপরকে সহযোগিতা করে, আত্মপীড়িতের পাশে দাঁড়ায়, ততক্ষণ সে ব্যক্তি ধার্মিক হিসেবে পরিগণিত হবার যোগ্য, কেননা তার ভেতরে মনুষ্যত্বের বৈশিষ্ট্যগুলো আছে।
প্রকারান্তরে কেউ যদি নামাজ, রোজা, হজ, পূজা-অর্চনা, উপাসনা ইত্যাদি নিয়ে দিনরাত ব্যাপৃত থাকে কিন্তু তার ভেতরে মানবতার গুণাবলী না থাকে, তাহলে সে প্রকৃত ধার্মিক নয়।
আল্লাহ কোরআনে বলেছেন- আমি মানুষকে আমার এবাদত ছাড়া আর কিছুই করার জন্য সৃষ্টি করিনি (সুরা যারিয়াত-৫৬)। এবাদত শব্দটির সঠিক অর্থ জানলেই আমরা বুঝতে পারব মানুষের কাজ কী। বর্তমানে এবাদত শব্দটিকে শুধু কিছু আনুষ্ঠানিকতা যেমন নামাজ, রোজা, হজ, যাকাত ইত্যাদি উপাসনা-প্রার্থনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ করা হয়েছে। এবাদতের ওই অর্থে মেনে নিলে মানুষের সমাজে মানুষ আর যা কিছুই করছে, সব কিছুই এবাদত বহির্ভূত হয়ে যায়! তবে উপাসনা ছাড়া অন্য আর কোনো কাজ মানুষের কর্তব্যের মধ্যে পড়বে না। কারণ আল্লাহ কোরআনে নিজেই বলেছেন, তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন শুধুমাত্র তার এবাদতের জন্য। তাহলে মানুষ অন্য সব কিছু করছে এবাদতের সংজ্ঞার বাইরে। তবে পৃথিবীতে একটাও মানুষ পাওয়া যাবে না, যিনি এবাদতের সংজ্ঞাতে ছিলেন বা আছেন। তাহলে কি মানুষের বেঁচে থাকার জন্য প্রাকৃতিক যত কাজ আছে সবকিছু এবাদত বহির্ভূত? অথচ আল্লাহর দেওয়া জীবন ব্যবস্থার আরেক নাম দীনুল ফিতরাত, অর্থাৎ প্রাকৃতিক দীন।
সহজভাবে এবাদতকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করতে পারি- আল্লাহ যাকে যে কাজের জন্য সৃষ্টি করেছেন, সে কাজ সঠিকভাবে করাই তার এবাদত। আগুন, পানি, বাতাস, বিদ্যুৎ, মাটি, দূর-দূরান্তের নক্ষত্র, গ্রহ- এগুলোর কোনোটাই মসজিদে, মন্দিরে, চার্চে, প্যাগোডায় গিয়ে এবাদত করে না, কিন্তু তারা নিরবচ্ছিন্নভাবে এক মুহূর্তেরও বিরতি ছাড়া আল্লাহর এবাদত করে যাচ্ছে। সূর্য তাপ, আলো বিকিরণ করছে, সে স্রষ্টার এবাদত করছে; চাঁদ সূর্য থেকে আলো নিয়ে তা প্রতিফলিত করে স্নিগ্ধ আলো বিলাচ্ছে, সে উপাসনা করছে। বাতাস মেঘপুঞ্জ পৃথিবীর এখান থেকে ওখানে নিয়ে গিয়ে আবহাওয়া সৃষ্টি করছে, এভাবে সে আল্লাহর এবাদত করছে।
আল্লাহ বলেছেন, তিনি যে এই বিশাল সৃষ্টি করেছেন, সেই সৃষ্টির ছোট-বড় প্রতি অণু-পরমাণু তারই এবাদত করে (সুরা নাহল-৪৮-৪৯)। এর অর্থ এই যে আল্লাহ তাঁর সৃষ্ট চাঁদ, সূর্য, আগুন, পানি, বাতাস, বিদ্যুৎ ইত্যাদি প্রত্যেক সৃষ্টি জিনিসকে যেটাকে যে কাজের জন্য সৃষ্টি করেছেন, সে নিয়ম বেঁধে দিয়েছেন- ঠিক সে মোতাবেক কাজ করা সেই জিনিসের জন্য এবাদত। মানুষকে আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন এবং তাকেও তিনি সৃষ্টি করেছেন এবাদত করার জন্য। কিন্তু অন্যান্য সব সৃষ্টির সঙ্গে তার একটা মৌলিক তফাৎ আছে। সেটা হলো- তার মধ্যে বিবেক থাকার কারণে তার নিজস্ব ইচ্ছাশক্তি আছে, অন্য কোনো সৃষ্টির যা নেই।
আল্লাহ কোরআনে মানুষকে তার প্রতিনিধি- “খলিফা” সম্বোধন করেছেন। তিনি কোরআনে বলেন- “স্মরণ কর, যখন তোমার রব মালায়েকদের ডেকে বললেন, নিশ্চয়ই আমি পৃথিবীতে আমার খলিফা সৃষ্টি করব” (সুরা বাকারা-৩০)। এখানে আল্লাহ আরবি “খলিফা” শব্দটি ব্যবহার করেছেন, যার অর্থ প্রতিনিধি। মানে আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর খলিফা, মানে প্রতিনিধি হিসেবে। প্রতিনিধির কী কাজ তা আমরা সবাই জানি। অতএব খুব সহজে বোঝা যাচ্ছে, আল্লাহ যে কাজ করেন সেই কাজের প্রতিনিধিত্ব করাই একজন মানুষের কাজ। সমগ্র সৃষ্টিকে আল্লাহ যেভাবে সুশৃঙ্খল, শান্তিপূর্ণ রেখেছেন, ঠিক সেভাবেই শুধুমাত্র পৃথিবীকে শান্তিপূর্ণ, সুশৃঙ্খল রাখার জন্য প্রতিনিধি হিসেবে আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। তাই মানুষের এবাদত হচ্ছে আল্লাহর হুকুম দিয়ে তাঁর আদেশ ও নিষেধ পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মানবজীবনে ন্যায়, সুবিচার, শৃঙ্খলা, শান্তি বজায় রাখা। এটাই মানুষের মূল এবাদত। শান্তি প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্যকে সামনে রেখে যা কিছু করা হবে, তার সবকিছুই এবাদতের অন্তর্ভুক্ত।
এই বিশাল, বিরাট দায়িত্বটি পালন করার জন্য যে শারীরিক-মানসিক-আধ্যাত্মিক শক্তির প্রয়োজন, তা অর্জনের জন্যই আল্লাহ বিভিন্ন রকম আমলের হুকুম দিয়েছেন। নামাজ, রোজা, হজ, যাকাত- এই সকল কিছু এবাদতের সেই লক্ষ্য অর্জনের প্রক্রিয়া বা মাধ্যম। এগুলো মূল এবাদতের অংশ। এই প্রত্যেকটি আমলের মধ্যে রয়েছে ঐক্যের শিক্ষা, শৃঙ্খলার শিক্ষা, আনুগত্যের শিক্ষা। মানুষ আল্লাহর মূল এবাদত “খেলাফত” অর্থাৎ তাঁর প্রতিনিধিত্ব করতে চাইলে সকল অন্যায় থেকে দূরে সরে এসে একটি সুশৃঙ্খল, ঐক্যবদ্ধ, আনুগত্যশীল জাতি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। নামাজ, রোজা, হজ, যাকাতের মতো আমলগুলো সেই বিশাল চরিত্র অর্জনের প্রক্রিয়া।
আল্লাহ কোরআনে বলেন- “মানবজাতির মধ্যে থেকে তোমাদের উত্থান ঘটানো হয়েছে সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করার জন্য” (সুরা আলে ইমরান-১১০)। অথচ আল্লাহর এই হুকুমের প্রকৃত শিক্ষা মানুষের মধ্যে না থাকার কারণে তারা ন্যায় প্রতিষ্ঠাকে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলাকে এবাদতই মনে করছেন না।
মানুষ যখন ধর্মের প্রকৃত সংজ্ঞা জানবে, এবাদতের মূল লক্ষ্য জানবে, তখন তারা আমলগুলো বুঝে বুঝে করবে এবং মানুষের চরিত্রে সেই আমলের শিক্ষাগুলো প্রতিফলিত হবে। আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব করার লক্ষ্য সামনে থাকলে কেউ আর অন্যায়ে লিপ্ত হবে না। কালেভদ্রে কোনো অন্যায় সংঘটিত হলেও আল্লাহর স্মরণ, প্রকৃত ধর্মের শিক্ষা, এবাদতের মূল অর্থ স্মরণ আবার অন্যায় থেকে বিরত রাখবে।
চৌদ্দশ’ বছর আগে রাসুলুল্লাহ এই শিক্ষা আরবে বাস্তবায়ন করেছিলেন বলেই সে জাতি হয়েছিল ঐক্যবদ্ধ, সুশৃঙ্খল, ভ্রাতৃত্বপূর্ণ। সকল মানুষ তাদের প্রকৃত ‘এবাদত’ কী, তা স্মরণে রেখেছিল বলে সেই সমাজের মানুষগুলো তখন দরজা খুলে ঘুমাতে পারত, দান গ্রহণ করার মতো কোনো মানুষ সে সমাজে খুঁজে পাওয়া যেত না, একজন তরুণী স্বর্ণালংকার পরিহিত অবস্থায় মাইলের পর মাইল যেতে পারত- কোনো নিরাপত্তাহীনতার প্রশ্নই ছিল না, কোনো জিনিস হারিয়ে গেলে একই স্থানে সে জিনিস পাওয়া যেত। শুধু প্রকৃত ধর্মের শিক্ষা এমন একটা সমাজ উপহার দিতে পেরেছিলেন। এটা প্রমাণিত যে প্রকৃত ধর্মের চর্চা একটি সমাজকে পরিবর্তন করবেই। এর মাধ্যমে মানুষ মানবজীবনের সার্থকতা খুঁজে পাবে। মানুষ হবে আত্মিকভাবে এবং চারিত্রিকভাবে পরিশুদ্ধ। আর এই প্রকৃত এবাদতই পারে মানুষের ইহকালীন ও পরকালীন জীবনে মুক্তি দিতে।
সুতরাং ধর্ম, এবাদত ইত্যাদি সম্পর্কে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি, আকিদা যতদিন পর্যন্ত পরিবর্তন না হবে, ততদিন মানুষের ধর্মবিশ্বাস সঠিক পথে প্রবাহিত হবে না। ধর্ম মানুষের কল্যাণে আসবে না। ধর্মবিশ্বাস জাতির বোঝা ও অকল্যাণের উপাদান হয়েই থাকবে। এ বিষয়গুলো যদি মানুষকে শিক্ষা দেওয়া যায়, তাহলে তাদের মানসিক অবস্থার শুভ পরিবর্তন হবে এবং সামাজিক অপরাধ অনেকাংশেই বন্ধ হবে।
এসআই