ঢাকা, রবিবার, ২৬ আশ্বিন ১৪৩২, ১২ অক্টোবর ২০২৫, ১৯ রবিউস সানি ১৪৪৭

ইসলাম

মহানবী (সা.)-এর রাজনৈতিক শিক্ষার মূলকথা

উবাইদুল্লাহ নাঈম সিরাজী | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০:০৮, অক্টোবর ১১, ২০২৫
মহানবী (সা.)-এর রাজনৈতিক শিক্ষার মূলকথা মসজিদে নববী

মহানবী মুহাম্মদ (সা.) সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী। তাঁর গোটা জীবন বিশ্ববাসীর জন্য উত্তম আদর্শ ও অব্যর্থ মাইলফলক।

তাঁর জীবনের এমন কোনো দিক নেই যেখানে উম্মতের জন্য শিক্ষা নেই। ঘরসংসার থেকে শুরু করে রাষ্ট্র পরিচালনা সব ক্ষেত্রেই তাঁর আদর্শ আমাদের সামনে বিদ্যমান।

মিত্র-শত্রু, দাস-মনিব এবং এতিম-বিধবা সবার জন্য তিনি ইনসাফপূর্ণ, ন্যায়সংগত দৃষ্টান্ত তাঁর সফল জীবনে রেখে গিয়েছেন।

নবীজির রাজনৈতিক জীবনের সূচনা
নবীজি (সা.)-এর রাজনৈতিক জীবনের সূচনা হয় মদিনায় হিজরতের পর থেকে। তাঁর মাদানি জিন্দেগি ছিল আল্লাহ তাআলার হুকুম-আহকাম বাস্তবায়নের মোক্ষম সময়। মক্কি জিন্দেগি ছিল মন-মানস তৈরি ও প্রস্তুতির সময়।

প্রাক-নবুয়ত যুগ ও মাক্কি জীবনে তিনি প্রস্তুতি নিয়েছেন এবং মাদানি জীবনে তা বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছেন।
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। হিজরতের পর  একে একটি স্বতন্ত্র ও সর্বময় বিশ্বাস হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার দায়িত্ব ও কর্তব্যরূপে অর্পিত হয় রাসুল (সা.)-এর ওপর। এ দায়িত্ব অর্পণ করত আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন, ‘তিনিই সেই সত্তা, যিনি তাঁর রাসুলকে হিদায়াত ও সত্য ধর্ম দিয়ে পাঠিয়েছেন।

যাতে তিনি একে সব ধর্মের ওপর বিজয়ী করতে পারেন। যদিও মুশরিকরা তা অপছন্দ করে। ’ (সুরা : তাওবা, আয়াত : ৩৩)
আল্লাহ তাআলা আরো বলেন, ‘তিনিই সেই সত্তা, যিনি তাঁর রাসুলকে সরল পথ ও সত্য দ্বিনসহ পাঠিয়েছেন। যাতে তাঁকে সব দ্বিনের ওপর বিজয়ী করে তোলেন। আর সাক্ষ্যদাতা হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট। ’ (সুরা : ফাতহ, আয়াত : ২৮)

নবীজির রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য
নবী (সা.)-এর প্রধান রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যগুলো নিম্নরূপ—
১. চারিত্রিক ও নৈতিক শক্তি : এটি এমন এক বৈশিষ্ট্য, যা সব নবী-রাসুলের রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য ছিল। তাঁদের নিষ্কলুষ দিঘল জীবন যে পরোপকারের বৈশিষ্ট্য বহন করে তার দৃষ্টান্ত মেলা ভার। নবীজি (সা.)-এর রাজনীতি এই বৈশিষ্ট্যে ছিল সমুজ্জ্বল। তিনি বন্ধু-শত্রু-নির্বিশেষে সবার কল্যাণ ও মঙ্গল কামনা করতেন।

২. নিষ্কলুষ উদ্দেশ্য : তাঁর উদ্দেশ্য ছিল একমাত্র ইসলামের বাস্তবায়ন। ব্যক্তিগত কোনো স্বার্থ ছিল না তাঁর রাজনীতিতে। তা না হলে তিনি কুরাইশের প্রস্তাব মেনে ইসলাম থেকে বিমুখ হয়ে ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করতে পারতেন। (আল্লাহ পানাহ)

৩. কলুষমুক্ত উপায়-উপকরণ : তিনি কোনো অসৎ উপায় অবলম্বন করে রাজনীতি করেননি। সদাসর্বদা সত্য-সঠিক ও নির্ভেজাল উপায়-উপকরণ অবলম্বন করে গিয়েছেন। চরম শত্রুর বিরুদ্ধেও দয়া-স্নেহময় ও মানবিক আচরণ করতেন। কেউ ইসলাম গ্রহণ করলে তাঁর সমূহ অপরাধ ক্ষমা করে দিতেন।
বলাবাহুল্য, এগুলো এমন সব বৈশিষ্ট্য, যা বর্তমানের দুনিয়ালোভী ও স্বার্থপাগল রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের দ্বারা আদৌ সম্ভব নয়। এ বৈশিষ্ট্যাবলিই নবীজির রাজনীতিকে দুনিয়াপূজারি ও স্বার্থান্বেষীদের রাজনীতি থেকে পৃথক মর্যাদা দিয়েছে।

রাজনৈতিক দর্শন

ওপরের আলোচনা থেকে প্রতিভাত হয়—নবীজি (সা.)-এর রাজনীতির মূল লক্ষ্য ইসলাম ও মানবতা। ইসলামকে বিশ্বব্যাপী বাস্তবায়ন ও মানবতার পার্থিব ও পারলৌকিক তথা সামগ্রিক কল্যাণের লক্ষ্যেই তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সূচনা ও অস্তিত্ব লাভ। ইসলামের বিজয় ও মানবতার মুক্তিই ছিল তাঁর রাজনৈতিক দর্শনের কেন্দ্রবিন্দু।

ম্নে সংক্ষেপে তাঁর রাজনৈতিক দর্শনগুলো আলোচনা করা হলো—

এক. আল্লাহর সার্বভৌমত্ব
মহানবী (সা.) ন্যায়পরায়ণ, ইনসাফগার ও আল্লাহভীরু শাসক ছিলেন। স্বৈরাচার বা অত্যাচারী ছিলেন না। তাঁর রাজনৈতিক প্রধান দর্শন ছিল আল্লাহ তাআলার সার্বভৌমত্ব। পবিত্র কোরআনের ঘোষণা, ‘হুকুম তো কেবল আল্লাহরই। ’ (সুরা : ইউসুফ, আয়াত : ৪০)
এই আয়াত আল্লাহর সার্বভৌমত্বের ওপর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

দুই. ইনসাফভিত্তিক শাসনব্যবস্থা
নবীজি (সা.)-এর রাজনৈতিক দ্বিতীয় দর্শন ছিল ন্যায়বিচার ও সমতা তথা ইনসাফভিত্তিক শাসনব্যবস্থা।
শাসক-জনতা সবার মাঝে সমতা ও বৈষম্যহীনতা রক্ষা করা ছিল তাঁর রাজনৈতিক দর্শনের অন্যতম স্তম্ভ। তিনি রাজা-প্রজার মধ্যে কোনো বৈষম্য রাখেননি। তাঁর দ্ব্যর্থহীন উচ্চারণ ছিল—‘আল্লাহর শপথ, মুহাম্মদের কন্যা ফাতেমাও যদি চুরি করত আমি তার হাত কেটে দিতাম। ’ (সহিহ বুখারি, ৬৭৮৮; মুসলিম, ১৬৮৮
তিন. চুক্তিনির্ভর শাসনব্যবস্থা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আরেকটি দর্শন ছিল চুক্তিনির্ভর শাসনব্যবস্থা। তিনি মদিনা সনদ প্রণয়ন করেছিলেন, যা ইসলামের ইতিহাসে প্রথম লিখিত সংবিধান। এখানে ইহুদি-অমুসলিমসহ সব ধর্মের অধিকার সুরক্ষিত ছিল। এ থেকে প্রতিভাত হয়, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর শাসনব্যবস্থা একক ধর্মীয় ছিল না। ছিল বহুধর্মীয়।

মহান আল্লাহ বলেন, ‘যদি আপনি তাদের (অমুসলিমদের) মধ্যে বিচার করেন, তাহলে ন্যায়সংগতভাবে বিচার করুন। নিশ্চয়ই আল্লাহ ন্যায়পরায়ণদের ভালোবাসেন। ’ (সুরা : মায়িদা, আয়াত : ৪২)

চার. পরামর্শভিত্তিক শাসনব্যবস্থা
নবীজি (সা.) কোনো কাজের সিদ্ধান্ত নিতে প্রথমে সাহাবিদের পরামর্শ নিতেন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তাঁদের কার্যাবলি পরামর্শক্রমে পরিচালিত হয়। ’ (সুরা : শূরা, আয়াত : ৩৮

অন্য আয়াতে এসেছে, ‘এবং আপনি তাঁদের সঙ্গে পরামর্শ করুন। অতঃপর যখন কোনো বিষয়ে দৃঢ়সংকল্প করবেন তখন আল্লাহ তাআলার ওপর ভরসা করুন। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা (তাঁর ওপর) ভরসাকারীদের ভালোবাসেন। ’  (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১৫৯)

পাঁচ. আন্তর্জাতিক সম্প্রীতি ও কূটনৈতিকতা রাসুলুল্লাহ (সা.) কর্তৃক তত্কালীন বিভিন্ন দেশের বাদশাহদের নামে ইসলামের দাওয়াতসংবলিত চিঠি পাঠানো ছিল তাঁর আন্তর্জাতিক সম্প্রীতি ও কূটনীতিক বিচক্ষণতা। তিনি বিভিন্ন দেশের বাদশাহদের নামে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে চিঠি পাঠিয়েছেন। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, আত্মনির্ভরশীলতা এবং কূটনীতিক চুক্তির মাধ্যমে বহির্বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন তিনি।

তিনি যাঁদের কাছে চিঠি পাঠিয়েছিলেন তাদের অন্যতম হলেন—
১. হিরাক্লিয়াস (বাইজেন্টাইন সম্রাট)
২. কিসরা (পারস্য সম্রাট)
৩. নাজ্জাশি (ইথিওপিয়ার বাদশাহ)
৪. মুকাউকিস (মিসরের শাসক) প্রমুখ।

এরাসহ আরো অনেকের কাছে ইসলাম গ্রহণের দাওয়াতি চিঠি পৌঁছায়।

চিঠির মূল ভাষ্য ছিল এরূপ—
‘আল্লাহর বান্দা ও রাসুল মুহাম্মদের পক্ষ থেকে অমুক বাদশাহের প্রতি—সালাম তার প্রতি, যে হিদায়াতের অনুসরণ করে। আমি তোমাকে ইসলাম গ্রহণের আহবান জানাচ্ছি। ইসলাম গ্রহণ করো, নিরাপদ থাকবে। এবং আল্লাহ তোমাকে দ্বিগুণ প্রতিদান দান করবেন। আর যদি বিমুখ হও, তাহলে তোমার জাতির অপরাধ তোমারই ওপর বর্তাবে। ...’

মোটকথা, তাঁর চিঠিগুলো ইসলামের আন্তর্জাতিক দাওয়াতমূলক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করে। তিনি কঠোরতা না করে সরল ও সহজ ভাষায় তাঁদের আহবান জানিয়েছেন। যা তাঁর বিচক্ষণ কূটনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির উজ্জ্বল প্রমাণ।

ছয়. প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধনীতি
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর যুদ্ধ কখনো আগ্রাসনের জন্য ছিল না। সব যুদ্ধই ছিল শান্তি প্রতিষ্ঠা, আত্মরক্ষা ও নিরাপত্তার জন্য। যুদ্ধ তাঁর পেশা ছিল না। বরং এটিও ছিল আল্লাহর হুকুম ও ইবাদত। তাঁর যুদ্ধের বিশেষ নীতি ছিল, নারী, শিশু, বৃদ্ধ ও অক্ষম লোকদের হত্যা করা যাবে না। অযথা গাছপালা কাটা যাবে না। এবং হত্যা করা যাবে না বেসামরিক লোকদের।

সাত. দুর্বলদের অধিকার সুরক্ষা।
দুর্বল, অভাবী, এতিম-বিধবা ও অক্ষমদের অধিকার রক্ষা করাও ছিল তাঁর অন্যতম রাজনৈতিক দর্শন।
লেখক : শিক্ষক, জামিয়াতুল আবরার দারুল উলূম আল-ইসলামিয়া উরশিউড়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া

সূত্র: কালের কণ্ঠ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।