পৃথিবীর উদার চিন্তাশীল মহল একবাক্যে তার অবদান ও আদর্শের কথা স্বীকার করে। মার্কিন লেখক মাইকেল এইচ হার্ট যুক্তিসঙ্গত কারণেই মহানবী (সা.)-কে ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানবের স্থান দিয়েছেন।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ-প্রদেশের অমুসলিমরাও মহানবী (সা.)-এর বন্দনায় মেতেছেন। ভারতের প্রচুর হিন্দু ঠাকুর ও ধর্মীয় পণ্ডিত মহানবী (সা.)-এর সম্মানে কবিতা রচনা করেছেন। নিজেরা আবার অনুষ্ঠানে আবৃত্তি করেছেন। হিন্দু ধর্মীয় গুরু পণ্ডিত শ্রী আচার্য্য প্রমোদ কৃষ্ণ ও পণ্ডিত রাম সাগর পৃথ্বিপাল ত্রিপাঠীসহ অনেক অমুসলিম ধর্মবেত্তার মহানবী (সা.)-এর সম্মানে কবিতা পাঠের বেশ কিছু ভিডিও ইউটিউবে রয়েছে।
রাসুল-কবি সাহাবি হাসসান বিন সাবিত (রা.) এক কবিতায় বলেছেন, ‘মা ইন মাদাহতু মুহাম্মাদান বি কাসিদাতি, ওয়া লাকিন মাদাহতু কাসিদাতি বি মুহাম্মাদি.. ’
অর্থাৎ: আমি যখনই কবিতার মাধ্যমে মুহাম্মদের স্তুতি-গান গেয়েছি, ততবারই আমি মুহাম্মদের মাধ্যমে আমার কবিতাকে প্রশংসিত করেছি।
যারা মহানবী (সা.)-কে নিয়ে আলোচনা করেছেন, কবিতার পঙক্তি গেঁথেছেন কিংবা শব্দের মঞ্জিমা তৈরি করেছেন, তারা সতত প্রশংসিত হয়েছেন। তাদের নিয়ে ইতিহাস কথা বলেছে। যুগ পরম্পরায় তারা আলোচিত হয়েছেন।
মধ্যযুগীয় চীনা মিং সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট হংগুউ মহানবী (সা.)-এর প্রশংসা করে কবিতা লিখেছেন। তার স্তুতি-কবিতাটি বাইযিযান (百字讃) নামে পরিচিত। একশত শব্দের কাঠামো-বন্ধনে তিনি চীনা ভাষায় স্তুতিগাথাটি রচনা করেছেন।
কবিতাগুলি ঐতিহাসিকভাবে ইসলামের সৌন্দর্যকে পৃথিবীর দিগক-দিগন্তে কতটা বিস্তৃত করেছিল, তার একটি গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু অসামান্য স্বীকৃত অনুস্মারক হয়ে রয়েছে।
সম্রাট হংগুউয়ের আসল নাম ঝ ইউয়ানজাং। তিনি ১৩৬৮ সালে চীনে মিং সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। ১৩৯৮ সাল পর্যন্ত তিনি চীন শাসন করেন। দীর্ঘকালীন মঙ্গোল-নেতৃত্বাধীন ইউয়ান রাজবংশের অবসান ঘটিয়ে মিং সাম্রাজ্যের যাত্রা শুরু করেছিলেন।
মিং রাজবংশের সম্রাট হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার পরে, সম্রাট হংগুউ প্রাচীন ইউয়ান সাম্রাজ্যের রাজধানী খানবালিককে মিং সাম্রাজ্যের নতুন রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। সেই খানবলিক বর্তমান রাজধানী বেইজিং।
সম্রাট হংগুউয়ের শাসনকাল বিভিন্নভাবে বৈপ্লবিক ছিল। তিনি সমগ্র চীনজুড়ে নতুন জমি ও কৃষিক্ষেত্রে বেশ উন্নয়ন করেছিলেন। কৃষকদের থেকে কর হ্রাস করেছিলেন। রাজনৈতিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে পতন কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন। এ কৃষকদের অধিকার রক্ষাকারী নতুন আইন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এছাড়াও উল্লেখযোগ্যভাবে ব্যক্তিগত দাসত্ব নিষেধ করেছিলেন এবং সমাজের দরিদ্র স্তরের লোকদের অধিকৃত জমি পুনরায় ফেরত দিয়েছিলেন।
সম্রাট হংগুউ ঝিজিং, নানজিং ও চীনের দক্ষিণাঞ্চলীয় ইউংনান, ফুজিয়ান এবং গুয়াংডংয়েও মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। এছাড়াও তার শাসনামলে চীনে মুসলমানদের উপস্থিতি বৃদ্ধি পায় বলে জানা যায়।
তার হান্ড্রেড-ওয়ার্ড ইউলজি, ইসলাম ও মহানবী (সা.)-এর প্রশংসা হিসেবে, মধ্যযুগে ইসলামের গুরুত্ব ও প্রসারের অন্যতম-অনন্য উদাহরণ হয়ে রয়েছে।
কবিতাটি পাঠ করলে বুঝা যায়, সম্রাট হংগুউ ইসলাম ও মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি কতটা বিমুগ্ধ ও সম্মোহিত ছিলেন। তবে তার ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কে ইতিহাসের গ্রন্থগুলোতে নিশ্চিত কোনো বর্ণনা পাওয়া যায়না।
রাসুল-মুগ্ধতায় রচিত তার কবিতাটি এখানে তুলে ধরা হলো,
《百字讚》寫道:“乾坤初始,天籍注名。傳教大聖,降生西域。授受天經,三十部冊,普化眾生。億兆君師,萬聖領袖。協助天運,保庇國民。五時祈祐,默祝太平。存心真主,加志窮民。拯救患難,洞徹幽冥。超拔靈魂,脱離罪業。仁覆天下,道冠古今。降邪歸一,教名清真。穆罕默德,至貴聖人。”《百字讚》
কবিতাটির অনুবাদ নিম্নরূপ-
জগত সৃষ্টির সূচনা থেকে
সৃষ্টিকর্তা নিযুক্ত করে রেখেছেন
তার মহান বাণী-বিশ্বাসের প্রচারক,
সুদূর পশ্চিমে তার জন্ম,
এবং পবিত্র ত্রিশ পারায় বিভক্ত কিতাব গ্রহণ করে নেন
সমগ্র সৃষ্টিকে পথ দেখাতে,
সব শাসকের অধিপতি
সব পুণ্যাত্মার নেতা,
জান্নাত থেকে সাহায্য নিয়ে
নিজ জাতিকে রক্ষা করেন।
দৈনিক পাঁচ ইবাদত-প্রার্থনায়
নিরব-নিভৃতে শান্তির কামনা করেন;
তার হৃদয়-আত্মা আল্লাহর কাছে আবদ্ধ-নিবেদিত,
দরিদ্রের দুর্দশা-দুর্বিপাক দূর করে
তাদের মনে দেন শক্তি,
পাপীর অদৃশ্যকে পরখ করে
তাকে মুক্তি দেন দুরাত্মা থেকে,
বিশ্বের জন্য ক্ষমা-মার্জনা নিয়ে
সুদূর অতীত থেকে পথ চলছেন
সব রকমের মন্দ দূর করার মহাসড়কে,
তার ধর্ম পরিশুদ্ধ ও সর্ব সত্য
মুহাম্মদ, মহান পবিত্র।
সম্রাট হংগুউয়ের কবিতাটির বিভিন্ন লিপি আজও নানজিংয়ের বিভিন্ন মসজিদে সংরক্ষিত রয়েছে। মিং শাসনামলে চীনের ওপর ইসলামের প্রভাবের এটি বৃহত্তর এক নিদর্শন।
রাজবংশের গোড়ার দিকে, এমনকি সুদূর চীনের কোণে কোণে ইসলামের প্রভাব-রূপের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্মারকাংশ হয়ে দীপ্তি ছড়াচ্ছে।
-দ্য মুসলিম ভাইব অবলম্বনে (০২ নভেম্বর, ২০১৯)
ইসলাম বিভাগে আপনিও লিখতে পারেন। লেখা পাঠাতে ই-মেইল করুন: [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১৬২১ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৬, ২০১৯
এমএমইউ