ঢাকা, বুধবার, ৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ শাওয়াল ১৪৪৫

আইন ও আদালত

নারী অধিকারের আইনি সুরক্ষা

খাদেমুল ইসলাম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৪১ ঘণ্টা, মার্চ ৮, ২০২৩
নারী অধিকারের আইনি সুরক্ষা

শতাব্দীর পর শতাব্দী নারী সমাজে পরিপূর্ণ মানুষের মর্যাদা পায়নি। সন্তান জন্মদান ও গৃহস্থালীর কাজ করাই নারীর নিয়তি, এমন ধারণা প্রচলিত ছিল।

শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান কোনো কিছুতেই অংশগ্রহণ ছিল না নারীর। গৃহিণীর ভূমিকায় থাকা নারীকে তাই নীরবে সহ্য করতে হয়েছে নির্যাতন। নিয়তি ভেবে মেনে নিতে হয়েছে সবকিছু।  

কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছে। সমস্ত কর্মক্ষেত্রে পুরুষের পাশাপাশি নারীর সরব অংশগ্রহণ দৃশ্যমান। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান সবক্ষেত্রে নারীর পদচারণা যেমন বেড়েছে, তেমনি সমাজে নারীকে শক্তিশালী করতে তৈরি করা হয়েছে আইনি সুরক্ষা বলয়, যার ওপর দাঁড়িয়ে এখন নারী সংকটে সংগ্রাম করতে শিখেছে ও শিখছে।

বিশ শতকের শুরু থেকেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হয়। বিভিন্ন দেশে রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ ও ভোটাধিকার স্বীকৃতি পায় এই শতকে। বৈশ্বিকভাবে নারীকে শক্তিশালী করতে ১৯১০ সাল থেকে ৮ মার্চকে পালন করা হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে।  

জাতিসংঘের সার্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণায় নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমান মানবিক মর্যাদা, আইনের আশ্রয়লাভ, কর্ম বেছে নেয়া ও সামাজিক নিরাপত্তার অধিকারের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। বিবাহ, দাম্পত্য জীবন এবং বিবাহ বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে নারী পুরুষ ‍দুজনের সমান অধিকার এবং সাধারণ স্বাস্থ্য কল্যাণের পাশাপাশি মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের উপর জোর দেয়া হয়েছে।

বাংলাদেশের সংবিধানে মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্রের এসব অঙ্গীকারের প্রতিফলন রয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৭ নং অনুচ্ছেদে বলা আছে- 'রাষ্ট্র (ক) একই পদ্ধতির গণমুখী ও সার্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সকল বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের জন্য; কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন। ' 

এছাড়া সংবিধানের ১৯ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- 'জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে মহিলাদের অংশগ্রহণ ও সুযোগের সমতা রাষ্ট্র নিশ্চিত করবেন। ' ২৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আইনের দৃষ্টিতে সমতা, ৩১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকার এবং ৪০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী যোগ্যতার ভিত্তিতে পেশা বাছাইয়ের অধিকার নারী-পুরুষ উভয়ের রয়েছে। সংবিধানের ৬৫(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জাতীয় সংসদে ৫০টি আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত করা হয়েছে।

শুধু সংবিধান নয়, নারীর পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সর্বক্ষেত্রে সুরক্ষায় বিভিন্ন সময়ে তৈরি করা হয়েছে আইন ও বিভিন্ন নীতিমালা। যার মধ্যে রয়েছে শিশুআইন ২০১৩, শিশুশ্রম নিরসন নীতিমালা ২০১০, জাতীয় শিশুনীতি ২০১১, শিক্ষানীতি ২০১০, জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি ২০১১, নারীনীতি ২০১১, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধন ২০২০), বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন-২০১৭,  যৌতুক নিরোধ আইন ২০১৮, মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ ১৯৬১, এসিড-সন্ত্রাস দমন আইন ২০০২, পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন ২০১০ ইত্যাদি আইন করা হয়েছে।

নীতিমালা বাস্তবায়নে অনেক ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা থাকলেও নারীর অধিকার রক্ষা ও নির্যাতন রোধে আইন সমূহ বেশ কঠোরভাবেই প্রয়োগ হয়ে থাকে। যার ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্রে নারীর প্রতি বৈষম্য এবং পারিবারিকভাবে নারী নির্যাতন বা যৌতুকের মতো অপরাধের ক্ষেত্রে যথেষ্ট প্রতিকার পাচ্ছেন নারীরা। এসিড সহিংসতা আগের চেয়ে কমে এসেছে। বাল্যবিবাহ বন্ধ্যেও প্রশাসনিক পদক্ষেপ পরিলক্ষিত হচ্ছে।

আইনি সুরক্ষা সত্ত্বেও এখনও ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা ও ইভটিজিংয়ের মতো ঘটনা ঘটছে। কর্মক্ষেত্রে এখনও নারী শতভাগ স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে পারছে না। অনেক ক্ষেত্রে নারী সামাজিকতা বা লোকলজ্জার ভয়ে আইনি পদক্ষেপ নেন না। তাই নারীকে সমাজে টিকে থাকতে হলে আইনের আশ্রয় নিতে হবে। অনেক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও এসব আইন নারীকে আগের চেয়ে অনেক বেশি সুরক্ষিত করেছে। নারী দিবসে শুধু আইন নয়, সামাজিকভাবে সচেতন হলেই একটি নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা সম্ভব।

লেখক: অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।