ঢাকা: মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় অভিযুক্ত সেনা কর্মকর্তাদের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়েছে।
বুধবার (২২ অক্টোবর) সকাল ৭টার পরপরই রাজধানীর পুরাতন হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে অবস্থিত ট্রাইব্যুনালে সেনা কর্মকর্তাদের হাজির করা হয়।
জানা যায়, সকাল ৭টার পর বাংলাদেশ জেল প্রিজনভ্যানের একটি গাড়িতে সেনা কর্মকর্তাদের আনা হয়েছে। তারা সবাই সাধারণ পোশাকে রয়েছেন। কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে প্রিজনভ্যানে করে তাদের ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। তবে কতজনকে আনা হয়েছে তা এখনও জানা যায়নি।
মামলা তিনটির মধ্যে দুটি হচ্ছে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে গুম-নির্যাতনের মাধ্যমে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায়। অন্যটি জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় রাজধানীর রামপুরা ও বনশ্রী এলাকায় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায়।
গত ৮ অক্টোবর গুমের বিষয়ে দুটি ফরমাল চার্জ আমলে নেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এই দুটি অভিযোগ আমলে নিয়ে আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়।
আদালতে আবেদনের পক্ষে ছিলেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। ওই দিন তিনি জানান, গুম, গোপন বন্দিশালায় আটক, নির্যাতন, হত্যাকাণ্ডসহ নানা ধরনের যে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, সেগুলোর বিষয়ে এই প্রথম দুটি ফরমাল চার্জ দাখিল করা হয়েছে। সেই চার্জ আমরা ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করেছি। ট্রাইব্যুনাল সবগুলোর বর্ণনা শুনেছেন। এরপর আসামিদের বিরুদ্ধে কগনাইজেন্স নিয়েছেন এবং গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ইস্যু করেছেন।
সেদিনই প্রসিকিউটর গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামিম বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ গুমের অভিযোগে দুটি এবং জুলাই আন্দোলনে গুলি চালানোর অভিযোগে বিজিবির কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে একটি; মোট ৩টি ফরমাল চার্জ দাখিল করা হয়েছে।
এক. গুমের (টিএফআই) ঘটনায় আসামি শেখ হাসিনা ও তারিক সিদ্দিকীসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে ৫টি অভিযোগ আনা হয়েছে। গুম-নির্যাতনের ঘটনায় করা দুটি মামলার একটিতে আসামি ১৭ জন। তাদের মধ্যে রয়েছেন র্যাবের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তোফায়েল মোস্তফা সারোয়ার, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. কামরুল হাসান, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাহাবুব আলম, ব্রিগেডিয়ার কে এম আজাদ, কর্নেল আবদুল্লাহ আল মোমেন ও কর্নেল আনোয়ার লতিফ খান (এখন অবসরকালীন ছুটিতে) ; র্যাবের গোয়েন্দা শাখার সাবেক পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মশিউর রহমান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাইফুল ইসলাম সুমন ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. সারওয়ার বিন কাশেম। তারা এখন সেনা হেফাজতে আছেন।
দুই. গুমের (জেআইসি) ঘটনায় আসামি শেখ হাসিনা ও তারিক সিদ্দিকীসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছে। তিন. জুলাই আন্দোলনে রামপুরায় বিজিবির গুলির ঘটনায় ৪ জনের বিরুদ্ধে ছয়টি অভিযোগ আনা হয়েছে।
এরপর ১১ অক্টোবর শনিবার ঢাকা সেনানিবাসের মেসে এক সংবাদ সম্মেলনে সেনাবাহিনীর অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল মেজর জেনারেল মো. হাকিমুজ্জামান বলেন, যেসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে চার্জশিট হয়েছে তাদের মধ্যে ১৫ জন বর্তমানে সেনা হেফাজতে আছেন। আমরা ১৬ জনকে সেনা হেফাজতে আসার জন্য বলেছিলাম, এর মধ্যে ১৫ জন এসেছেন।
তিনি আরও বলেন, গত ৮ অক্টোবর আইসিটিতে প্রথম দুইটি চার্জশিট জমা পড়ে। এরপর তৃতীয় আরেকটি চার্জশিট জমা হয়। সকাল ১১টা থেকে দুপুর ১টার মধ্যে আমরা টিভির স্ক্রল দেখে জানতে পারি যে চার্জশিট জমা পড়েছে এবং ট্রাইব্যুনাল তা গ্রহণ করেছে। চার্জশিটগুলোর মধ্যে একটি ছিল গুম-সংক্রান্ত, যা তখন ডিজিএফআইয়ে কর্মরত কর্মকর্তাদের নিয়ে। আরেকটি ছিল র্যাবের টিএফআই নিয়ে এবং আরেকটি ছিল ৪-৫ আগস্টের রামপুরার ঘটনাকে কেন্দ্র করে। এরপরই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয় এবং নিয়ম অনুযায়ী তা আইজিপির কাছে পাঠানো হয়, যেখানে ২২ তারিখ পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছে। তবে আমরা এখন পর্যন্ত কোনো চার্জশিট কিংবা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা পাইনি।
সেনা কর্মকর্তা আরও জানান, চার্জশিটে প্রায় ২৫ জন সেনা কর্মকর্তার নাম এসেছে। এর মধ্যে অবসরে আছেন ৯ জন, এলপিআরে একজন এবং কর্মরত আছেন ১৫ জন। যারা অবসরে গেছেন, তাদের ক্ষেত্রে আমাদের সেনা আইন প্রযোজ্য নয়।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সংবিধান স্বীকৃত বাংলাদেশের সব আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। সেই অনুযায়ী ৮ অক্টোবর কর্মরত ১৫ জন এবং এলপিআরে থাকা একজন কর্মকর্তাকে সেনা হেফাজতে আসার জন্য আদেশ পাঠানো হয়। আদেশে বলা হয়, ৯ অক্টোবরের মধ্যে তারা যেন ঢাকা সেনানিবাসে রিপোর্ট করেন। যদিও আমরা কোনো পরোয়ানা পাইনি, তবুও আইন মেনে আমরা স্বপ্রণোদিতভাবে এই পদক্ষেপ নিয়েছি।
মেজর জেনারেল হাকিমুজ্জামান আরও বলেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এরকম পরিস্থিতিতে অভ্যস্ত। ৫৪ বছরের ইতিহাসে এর চেয়েও জটিল ও সংবেদনশীল অনেক মামলা আমরা মোকাবিলা করেছি। যাদের নামে অভিযোগ ওঠে, প্রথমে তাদের আমরা হেফাজতে নিই। এরপর কোর্ট মার্শাল হয় এবং রায়ের ভিত্তিতে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এবারও আমরা তাই করেছি। যাদের হেফাজতে আসতে বলা হয়েছিল তারা সবাই সাড়া দিয়েছেন, শুধু একজন ছাড়া। সেই একজন কর্মকর্তা ৯ অক্টোবর পর্যন্ত কোনো সাড়া দেননি। পরে ১০ অক্টোবর আমরা তার সঙ্গে এবং তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করি। জানতে পারি, তিনি ৯ অক্টোবর সকালে বাসা থেকে বের হন একজন আইনজীবীর সঙ্গে দেখা করার কথা বলে, কিন্তু এরপর আর বাসায় ফেরেননি। তার পরিবারের সঙ্গেও আর যোগাযোগ স্থাপন সম্ভব হয়নি। তিনি হলেন মেজর জেনারেল কবির।
পরদিন ১২ অক্টোবর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কারা-১ শাখা থেকে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। সেই প্রজ্ঞাপনে ঢাকা সেনানিবাসের একটি ভবনকে সাময়িকভাবে ‘কারাগার’ ঘোষণা করে সরকার।
এমআইএইচ/এসআই