ঢাকা: মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গাইবান্ধার ছয় আসামির বিরুদ্ধে তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা।
একই মামলার ছয় আসামির সবাই ছিলেন একাত্তরে রাজাকার বাহিনীর সদস্য।
তাদের বিরুদ্ধে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে হত্যা-গণহত্যা, ধর্ষণ, আটক, অপহরণ, নির্যাতন, বাড়িঘরে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ, ভয়-ভীতি ও আতঙ্ক ছড়িয়ে হিন্দু সম্প্রদায়কে ধর্মান্তর ও দেশান্তরে বাধ্য করাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের চারটি অভিযোগ আনা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ২২ জনকে হত্যা-গণহত্যা, সাধারণ মানুষের ওপর হামলা ও ৫০টি বাড়িতে লুটপাট এবং খুঁজে খুঁজে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর হামলা-হত্যার অভিযোগ।
বুধবার (২১ ডিসেম্বর) রাজধানীর ধানমণ্ডিতে তদন্ত সংস্থার কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার ৪৪তম এ তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
তদন্ত সংস্থার জ্যেষ্ঠ সমন্বয়ক সানাউল হক খান জানান, বুধবারই তদন্ত প্রতিবেদন প্রসিকিউশনের কাছে জমা দেওয়া হবে। এর ভিত্তিতে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) তৈরি করে ট্রাইব্যুনালে দাখিল করবেন প্রসিকিউশন।
গত বছরের ১২ অক্টোবর থেকে বুধবার পর্যন্ত এক বছর ১০ দিনের তদন্ত শেষে মোট ৬ খণ্ডে ৯৫৮ পাতার এ তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে।
গত ২৫ মে ওই ছয় আসামির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল। সে সময় মো. রঞ্জু মিয়াকে গ্রেফতার করা হলেও বাকি পাঁচজনকে এখনও গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ।
গ্রেফতারকৃত মো. রঞ্জু মিয়াকে ট্রাইব্যুনালের অনুমোদনক্রমে সেফহোমে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।
আগামী ২৮ ডিসেম্বর তাদের বিরুদ্ধে তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিলের দিন ধার্য রয়েছে ট্রাইব্যুনালে।
চার অভিযোগ
আসামিরা গাইবান্ধা সদরের নান্দিদা ও ফুলবাড়ি গ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা এবং সবাই জামায়াতের সক্রিয় কর্মী।
আসামিদের মধ্যে মো. আব্দুল জব্বার, মো. জাফিজার রহমান খোকা ও মো. আব্দুল ওয়াহেদ মণ্ডল ১৯৭১ সালের আগে থেকেই জামায়াতের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। জব্বার ও খোকা মানবতাবিরোধী অপরাধে ১৯৭২ সালে গ্রেফতার হলেও তাদের কোনো বিচার হয়নি। খোকার বর্তমান ঠিকানা রাজধানীর কাফরুল থানার উত্তর ইব্রাহিমপুর। তিনি ১৯৭৫ সালে পুলিশের চাকরিতে যোগ দিয়ে ২০১৪ সালে অবসর নেন।
মো. মমতাজ আলী ব্যাপারী মমতাজ ১৯৭৪ সালে কৃষি বিভাগে চাকরিতে যোগ দিয়ে ২০১২ সালে অবসর নেন।
প্রথম অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের জুন মাসে আসামি রাজাকার আজগর হোসেন খান পাকিস্তানি দখলদার সেনাবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়কে ধ্বংসের উদ্দেশ্যে গাইবান্ধা সদর উপজেলার সাজাপাড়া ইউনিয়নের বিষ্ণুপুর গ্রামে হামলা চালিয়ে অম্বিকা চরণ সরকারকে নির্যাতন করেন। এরপর তাকে মৃতপ্রায় অবস্থায় ফেলে রেখে পাশের বাড়ির দ্বিজেস চন্দ্র সরকার ও তার বন্ধু আব্দুল মজিদ প্রধানকে আটক ও অপহরণ করেন। গাইবান্ধা শহরের হেলাল পার্কের পাকিস্তানি আর্মি ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে কবিরের পাড়ায় আব্দুল মজিদের কাপড় খুলে মুসলমান নিশ্চিত হয়ে ছেড়ে দেন। পরে দ্বিজেস চন্দ্রকে ক্যাম্পে নিয়ে হত্যা করেন।
আসামিরা ফুল কুমারী রানী ও তার জা সাধনা রানীকে আটকে নির্যাতন করেন। মুসলমান হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলে তাদের কপালের সিঁদুর মুছে এবং হাতের শাখা ভেঙ্গে দেন।
এছাড়াও ওই ৬ জন নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষের মধ্যে ভয়-ভীতি ও আতঙ্ক সৃষ্টি করলে সাহাপাড়া ইউনিয়নের ৩শ’ থেকে ৪শ’ জন মানুষ বাড়ি-ঘর ছাড়তে বাধ্য হন।
দ্বিতীয় অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ১৮ অক্টোবর রাজাকার কমান্ডার আব্দুল জব্বারসহ আসামিরা সাহাপাড়া ইউনিয়নে সশস্ত্র হামলা চালান। এ হামলায় আবু বক্কর, মো. তারা আকন্দ, আনছার আলী এবং নছিম উদ্দুন আকন্দসহ মোট ৯ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ৪০ থেকে ৫০টি বাড়ির মালামাল লুটপাটের পর আগুনে পুড়িয়ে ধ্বংসও করেন আসামিরা।
তৃতীয় অভিযোগে বলা হয়েছে, রনজু মিয়া ছাড়া বাকি ৫ জন লাল মিয়া, আব্দুল বাকি এবং খলিলার রহমানসহ মোট ৫ জনকে গুলি করে হত্যা করেন।
চতুর্থ অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ১৮ অক্টোবর দুপুরে ওই ছয় রাজাকার মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যার উদ্দেশ্যে গাইবান্ধা জেলার সাহাপাড়া ইউনিয়নের নান্দিনা, মিরপুর, সাহারাবাজার, কাশদহ, বিসিক শিল্প নগরী, ভবানীপুর এবং চকগয়েশপুর গ্রামগুলোতে সশস্ত্র হামলা চালান। এ সময় মুক্তিযোদ্ধা মো. ওমর ফারুক ও মো. ইসলাম উদ্দিনসহ মোট ৭ জনকে হত্যা করেন আসামিরা।
বাংলাদেশ সময়: ১১২৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২১, ২০১৬
জেএফ/এএসআর