ঢাকা, মঙ্গলবার, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ২১ মে ২০২৪, ১২ জিলকদ ১৪৪৫

আইন ও আদালত

যেসব কারণে বিশ্বজিৎ হত্যায় আসামিদের সাজা কমলো

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৪৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ১, ২০১৭
যেসব কারণে বিশ্বজিৎ হত্যায় আসামিদের সাজা কমলো বিশ্বজিৎ হত্যা (ফাইল ফটো)

ঢাকা: পুরান ঢাকার টেইলার্স শ্রমিক বিশ্বজিৎ দাস হত্যা মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপিতে আসামিদের সাজা বহাল ও কমানোর কারণ উল্লেখ করেছেন হাইকোর্ট। হত্যাকাণ্ডের ভিডিও ফুটেজ, জবানবন্দি, সাক্ষ্যসহ বিভিন্ন বিষয় বিবেচনায় নিয়ে এ রায় দেওয়া হয়।

গত ০৬ আগস্ট দেওয়া রায়ে বিচারপতি মো. রুহুল কুদ্দুস ও বিচারপতি ভীষ্মদেব চক্রবর্তীর হাইকোর্ট বেঞ্চ দু’জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রাখেন। ২১ আসামির মধ্যে চারজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও চারজনকে খালাস দেন।

পলাতক অন্য ১১ আসামির বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি হাইকোর্ট।  

বিচারিক আদালতের রায়ে ফাঁসির আদেশ পাওয়া ৮ জনের মধ্যে রফিকুল ইসলাম শাকিল ও রাজন তালুকদারের মৃত্যুদণ্ড বহাল রয়েছে। তাদের মধ্যে রাজন পলাতক। অন্য ছয়জনের মধ্যে মাহফুজুর রহমান নাহিদ, ইমদাদুল হক এমদাদ, জিএম রাশেদুজ্জামান শাওন ও মীর মোহাম্মদ নূরে আলম লিমনের সর্বোচ্চ সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। লিমন পলাতক থাকলেও অন্য তিনজন কারাগারে আছেন।

খালাসপ্রাপ্তদের মধ্যে সাইফুল ইসলাম সাইফুল ও কাইয়ূম মিয়া টিপু বিচারিক আদালতের রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ছিলেন। আর গোলাম মোস্তফা মোস্তফা ও এ এইচ এম কিবরিয়াকে দেওয়া হয়েছিল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।

রায়ে আদালত বলেন,  ‌‘প্রশ্ন হলো আসামিরা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন কি-না, বিচারিক আদালত যাদের সাজা দিয়েছেন, তা যথাযথ এবং ফৌজদারি আইনের নীতিসিদ্ধ কি-না। রেকর্ড অনুসারে চারজন ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি নিজেদের সম্পৃক্ত করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তাদের মধ্যে শাওনকে ২০১২ সালের ১৪ ডিসেম্বর সিলেটের জাফলং থেকে গ্রেফতার করা হয়। পরে শাওন স্পষ্টভাবে জবানবন্দিতে বলেছেন, অবরোধের সময় তিনি কর্মসূচিতে অংশ নেন। তিনি দেখেছেন, তার সামনে একজন ছেলে দৌঁড়ে যাচ্ছেন। ইউনুস ও রাজন বিশ্বজিৎকে ধরেন। শাকিলসহ অন্যরা সেখানে ছিলেন। রাজন কিরিজ দিয়ে তার শরীরে আঘাত করেন। আল আমিন ছুরি দিয়ে আঘাত করেন। ইউনুস রড দিয়ে ও শাকিল চাপাতি দিয়ে কোপ দেন। নাহিদ, আজিজ, লিমন, রফিক ও আল অমিন লাঠি ও রড দিয়ে আঘাত করেন’।

‘অভিযুক্তদের মধ্যে শুধুমাত্র চাপাতি দিয়ে শাকিলই কোপানোর কথা স্বীকার করেছেন। চাপাতিও পুলিশ জব্দ করেছে এবং ভিডিওক্লিপ সংগ্রহ করেছে। রাজন কিরিজ দিয়ে আঘাত করেছেন’।

‘শাকিল চাপাতি ও রাজন কিরিজ দিয়ে আঘাত করেছেন। শাওন, নাহিদ, এমদাদ লাঠি দিয়ে আঘাত করেছেন। তারা ভিকটিমের শরীরে মারাত্মক ধরনের আঘাত করেননি। তাদের অপরাধের ধরন শাকিল বা রাজনের মতো নয়’।

 রায়ে বলা হয়, ‘আসামি নাহিদ তার এক আত্মীয়ের বিয়েতে ছিলেন বলে উল্লেখ করেছেন। এমনকি বিয়ের কাবিননামাও আদালতে দাখিল করেছেন। কিন্ত পেপার ক্লিপিংস, ভিডিও ফুটেজ থেকে স্পষ্টত দেখা যায় যে, কাঠ দিয়ে তিনি (নাহিদ) বিশ্বজিৎকে আঘাত করছেন। অন্য যে তিনজন জবানবন্দি দিয়েছেন, তারাও নাহিদের জড়িত থাকার কথা বলেছেন। তাই তার দাবি বিশ্বাসযোগ্য নয়’।

‘নুরে আলম লিমন ভিকটিমের মাথা ও শরীরের পেছনে দিকে আঘাত করেন। স্থিরচিত্রে তার উপস্থিতি দেখা যায়। যারা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন, বিশেষ করে শাওন, শাকিল ও নাহিদের জবানবন্দিতে লিমনের সম্পৃক্ততা প্রকাশ পেয়েছে। তার অপরাধের ধরন শাকিল ও রাজনের চেয়ে ভিন্ন’।

হাইকোর্ট রায়ে বলেন, ‘সাইফুল ইসলাম চার্জশিটভুক্ত আসামি। নাহিদ ও শাকিলের জবানবন্দির ভিত্তিতে সাইফুলকে আসামি করা হয়েছে। তবে শাওন ও এমদাদ তাদের জবানবন্দিতে সাইফুলের নাম বলেননি। এমনকি প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী পার্বতী হালদার, চা বিক্রেতা মো. শহিদ, রিকশাচালক রিপন সরকার সাইফুলকে কাঠগড়ায় আসামি হিসেবে চিহ্নিত করেননি। সাইফুলকে বারবার রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। সেখানেও তিনি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেননি। অন্য অভিযুক্তদের পুলিশ ঢাকার বাইরে থেকে গ্রেফতার করলেও সাইফুলকে উত্তরার বাসা থেকে গ্রেফতার করা হয়। তার এ আচরণ প্রমাণ করে, তিনি ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না’।

‘তবে ৩১ নম্বর সাক্ষী বলেছেন, তিনি রড দিয়ে আঘাত করেছেন। প্রথম তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশের এসআই মাহবুবুল আলম আকন্দ তার জবানবন্দিতে বলেছেন, সাইফুল রড দিয়ে শরীরে আঘাত করেছেন। দ্বিতীয় তদন্তকারী কর্মকর্তা মো. তাজুল ইসলাম (ডিবি পুলিশের পরিদর্শক) সাইফুলের নাম ও অবস্থানের কথা বলেননি। এছাড়া আমরা সকল ভিডিও ফুটেজ পরীক্ষা করেছি, কিন্তু সাইফুলের অবস্থান চিহ্নিত করতে পারিনি। এ কারণে শুধুমাত্র দু’জনের জবানবন্দির ভিত্তিতে তাকে সাজা দেওয়া যথাযথ নয়’।  

‘ফৌজদারি আইনে শুধুমাত্র যা অন্য কোনো সাক্ষী দ্বারা প্রমাণিত হয়নি, এমন ব্যক্তিকে সাজা দেওয়া যায় না। এ কারণে সাইফুল খালাস পাওয়ার যোগ্য’।

রায়ে বলা হয়, ‘কাইয়ুম মিয়া ওরফে টিপুকে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির ভিত্তিতে আসামি করা হয়। প্রথম তদন্তকারী কর্মকর্তা বলেছেন যে, এ আসামি রোল দিয়ে ভিকটিমকে আঘাত করেছেন। দ্বিতীয় তদন্তকারী কর্মকতা বলেছেন, এ আসামি ভিকটিমকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেন। কিন্তু প্রকাশ্য আদালতে এটিএন বাংলার ভিডিও ফুটেজ থেকে দেখা যায়, তিনি ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন মাত্র। স্থিরচিত্রেও তার উপস্থিতি দেখা যায়। তার উপস্থিতিতে চিন্তা করতে পারি না যে, তিনি ঘটনার সঙ্গে জড়িত’।

‘গোলাম মোস্তফার বিষয়ে শাকিল ও নাহিদ বলেছেন, তিনি ছুরিকাঘাত করেছেন। অন্য দু’জন শাওন ও এমদাদ জবানবন্দিতে বলেছেন, তিনি শুধুমাত্র উপস্থিত ছিলেন। দ্বিতীয় তদন্ত কর্মকর্তা তার জবানবন্দিতে বলেছেন, গোলাম মোস্তফা রড দিয়ে বিশ্বজিৎকে আঘাত করেছেন। কিন্ত ভিডিও ফুটেজ ও স্থিরচিত্রে তার উপস্থিতি দেখা যায় না। এ কারণে তার সাজা বহাল রাখা নিরাপদ মনে করি না। এ কারণে সন্দেহের সুবিধায় তিনি খালাস পাওয়ার যোগ্য’।

হাইকোর্ট আরও বলেন, ‘এ এইচ এম কিবরিয়ার বিষয়ে জবানবন্দিতে অন্য আসামিরা বলেছেন। ভিডিও ফুটেজ ও স্থিরচিত্রে তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। এ মামলায় শুধুমাত্র তাকে দাঁড়িয়ে থাকার কারণে তাকে সাজা দেওয়া যথাযথ নয়। ফলে আমরা তার সাজা বহাল রাখতে পারছি না’।

‘নাহিদ, এমদাদ, শাওন, লিমন হত্যার ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকলেও তারা মারাত্মকভাবে বিশ্বজিৎকে আঘাত করেননি। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তাদের অতীত ইতিহাস পরিষ্কার। তাদের মধ্যে নাহিদ, শাওন ও এমদাদ পাঁচ বছর ধরে কনডেম সেলে রয়েছেন। তারা স্বভাবগত অপরাধী নন। এ কারণে ন্যায়বিচারের স্বার্থে এ তিনজনের  সাজা কমিয়ে মৃত্যুদণ্ড থেকে যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া ন্যায়সঙ্গত’।

‘একই কারণে নুরে আলম লিমনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া যুক্তিযুক্ত হয়েছে’।

আদালত বলেন, ‘মূলত এ ঘটনার জন্য শাকিল ও রাজন দায়ী। তারা দু’জনই অস্ত্র দিয়ে মারাত্মক আঘাত করেছেন। প্রকাশ্য দিবালোকে কুপিয়ে হত্যা করার ঘটনাটি ছিল একটি বর্বরতা। তাদের এ অপরাধের ধরন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও গোটা যুব সমাজের সঙ্গে মানানসই নয়। এ কারণে তাদের মৃত্যুদণ্ড সাজা দেওয়ার ক্ষেত্রে ন্যূনতম সহানুভূতি দেখাতে পারি না’।

বাংলাদেশ সময়: ২১৫০ ঘণ্টা, নভেম্বর ০১, ২০১৭
ইএস/এএসআর
**
বিশ্বজিৎ হত্যায় হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।