ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আইন ও আদালত

‘তোমাকে চিনি, বলার সাথে সাথে আপাকে গুলি করা হয়’

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯২০ ঘণ্টা, মার্চ ২০, ২০২২
‘তোমাকে চিনি, বলার সাথে সাথে আপাকে গুলি করা হয়’ সগিরা মোর্শেদ

ঢাকা: ‘মোটরসাইকেলে বসা সামনের লোকটি আপার হাতের বালা টানাটানি করে। এ সময় আপা বলেন—তুমি আমার সাথে এগুলো করো না, আমি তোমাকে চিনি।

আপা লোকটিকে চিনি বলার সাথে সাথে মোটরসাইকেলের আরোহীরা তাকে গুলি করে। ’

রোববার (২০ মার্চ) ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক আবু জাফর মো. কামরুজ্জামানের আদালতে সগিরা মোর্শেদকে বহনকারী রিকশাচালক সালাম মোল্লা তার জবানবন্দিতে একথা বলেন।

এ নিয়ে মামলাটিতে ৮ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ হয়েছে। এদিন তার সাক্ষ্য শেষ না হওয়ায় আগামী ৩০ মার্চ সাক্ষ্যগ্রহণের পরবর্তী দিন ধার্য করেছেন আদালত।

সালাম মোল্লা জবানবন্দিতে বলেন, ‘১৯৮৯ সালের ২৫ জুলাই বিকেল ৫টার দিকে শাহজাহানপুরের শহীদবাগ থেকে রিকশা নিয়ে রাজারবাগের দিকে যাচ্ছিলেন। রাজারবাগ গলির মুখ থেকে সগিরা মোর্শেদ আমাকে ডাক দিয়ে বলেন—সিদ্ধেশ্বরী ভিকারুননিসা স্কুলের সামনে যাব কিনা? আমি যাব বলি এবং চার টাকা ভাড়া ঠিক করি। তাকে মালিবাগের কাছে পেট্রোল পাম্পের কাছে গিয়ে আমি বলি, আপা শান্তিনগর দিয়ে যাবো? তখন আপা বলেন—না তুমি সিদ্ধেশ্বরীর ভেতর দিয়ে যাও। এদিক দিয়ে কাছে হবে। ’

সালাম মোল্লা আরও বলেন, ‘সিদ্ধেশ্বরীর ভেতর ঢুকে কালীমন্দিরের সামনে এলে একটি মোটরসাইকেল বের হয়ে আসে। সেখানে দুই জন লোক ছিল। ঘটনাস্থল ভিকারুননিসার দুই বাড়ির পূর্বে আমার রিকশা এলে মোটরসাইকেলটি আমার রিকশার সামনের চাকার সামনে এসে ব্রেক করে এবং ব্যারিকেড দেয়। আপার হাতে একটি ব্যাগ ছিল। মোটরসাইকেলের পেছনে বসা লোকটি ব্যাগটি টান দিয়ে নিয়ে নেয়। সেটা মোটরসাইকেলে বসা সামনের লোকটির কাছে দেয়। এরপর মোটরসাইকেলে বসা সামনের লোকটি আপার হাতের বালা টানাটানি করে। এ সময় আপা বলেন—তুমি আমার সাথে এগুলো করো না। আমি তোমাকে চিনি। আপা লোকটিকে চিনি বলার সাথে সাথে মোটরসাইকেলের আরোহীরা তাকে গুলি করে। গুলি আপার বুকের বাম পাশে লাগে। আপা রিকশা থেকে পড়ে যেতে লাগলে আমি হাত দিয়ে তাকে ঠেকিয়ে রাখি। যাওয়ার সময় তারা আরও একটি গুলি করে। ’

তিনি বলেন, ‘এরপর আমি একটি আধলা ইট নিয়ে হাইজ্যাকার হাইজ্যাকার বলে মোটরসাইকেল আরোহীদের পেছনে পেছনে ছুটতে থাকি। ভিকারুননিসা স্কুলের কাছে মহিলা সমিতি পর্যন্ত দৌঁড়ে যাই। তারা মোটরসাইকেল নিয়ে পালিয়ে যায়। তারপর আমি আবার রিকশার কাছে যাই। সেখানে অনেক লোকজন দেখি। তারা আমাকে বলে—আপাকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। এরপর আমি রমনা থানায় যাই এবং ঘটনা পুলিশকে জানাই। তারপর থানার পুলিশসহ আমি আবার ঘটনাস্থলে আসি। ’

এই ঘটনার ৩০ বছর পর ঘটনার রহস্য উদঘাটন করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) চারজনের বিরু‌দ্ধে গত ১৪ জানুয়া‌রি আদাল‌তে অভিযোগপত্র দেয়। এক হাজার ৩০৯ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্রে রাষ্ট্রপক্ষে মোট ৫৭ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। এরপর গত ২ ডিসেম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত।

এ মামলার আসামিরা হলেন—সগিরা মোর্শেদের ভাসুর ডা. হাসান আলী চৌধুরী, জা সায়েদাতুল মাহমুদা ওরফে শাহিন, শ্যালক আনাছ মাহমুদ রেজওয়ান, মারুফ রেজা ও মন্টু মন্ডল ওরফে কুঞ্জ চন্দ্র মন্ডল।

মামলার বিবরণ থেকে জানা যায়, ১৯৮৯ সালের ২৫ জুলাই সগিরা মোর্শেদ সালাম ভিকারুননিসা নূন স্কুল থেকে মেয়েকে আনতে যাচ্ছিলেন। বিকেল ৫টার দিকে সিদ্ধেশ্বরী রোডে পৌঁছামাত্র মোটরবাইকে আসা ছিনতাইকারীরা তার হাতের সোনার চুড়ি ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। তিনি দৌড় দিলে তাকে গুলি করা হয়। পরে হাসপাতালে নেওয়ার পথেই সগিরা মোর্শেদ সালাম মারা যান।

ওই দিনই রমনা থানায় অজ্ঞাতনামাদের বিরুদ্ধে মামলা করেন সগিরা মোর্শেদ সালামের স্বামী সালাম চৌধুরী। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী রিকশাচালক জড়িত দুজনকে শনাক্ত করলেও অজ্ঞাত কারণে মিন্টু ওরফে মন্টু ওরফে মরণ নামে একজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় গোয়েন্দা পুলিশ।

১৯৯১ সালের ১৭ জানুয়ারি আসামি মন্টুর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতের বিচারক আবু বকর সিদ্দীক। সাক্ষ্য নেওয়া হয় সাতজনের। সাক্ষ্যে বাদীপক্ষ থেকে বলা হয়, তদন্তকালে আসামি মন্টু এবং তৎকালীন (১৯৮৯) স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর জেনারেল মাহমুদুল হাসানের নিকটাত্মীয় মারুফ রেজা গ্রেফতার হন। কিন্তু মারুফ রেজার নাম বাদ দিয়েই অভিযোগপত্র দেওয়া হয়।

সাক্ষ্যগ্রহণ চলাকালে মারুফ রেজার নাম আসায় রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনে ১৯৯১ সালের ২৩ মে মামলার অধিকতর তদন্তের আদেশ দেন ঢাকার বিচারিক আদালত। ওই আদেশের বিরুদ্ধে মারুফ রেজার রিভিশন আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯১ সালের ২ জুলাই হাইকোর্ট মামলাটির অধিকতর তদন্তের আদেশ ও বিচারকাজ ছয় মাসের জন্য স্থগিত করার পাশাপাশি অধিকতর তদন্তের আদেশ কেন বাতিল করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন।

পরের বছর ২৭ আগস্ট জারি করা রুল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত ওই মামলার বিচারকাজ স্থগিত থাকবে বলে আদেশ দেন হাইকোর্ট। এ মামলার সর্বশেষ তদন্ত কর্মকর্তা সম্প্রতি বিষয়টি অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ের নজরে আনলে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের উদ্যোগ নেয় রাষ্ট্রপক্ষ। এরপর বিষয়টি বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের বেঞ্চে তোলা হলে আদালত স্থ‌গিতা‌দেশ প্রত্যাহার ক‌রে নেন।

বাংলাদেশ সময়: ১৯১৮ ঘণ্টা, মার্চ ২০, ২০২২
কেআই/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।