ঢাকা, শনিবার, ৮ আষাঢ় ১৪৩১, ২২ জুন ২০২৪, ১৪ জিলহজ ১৪৪৫

লাইফস্টাইল

সন্তান যখন বয়ঃসন্ধিতে

নিউজ ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১০০ ঘণ্টা, মে ২৮, ২০২৪
সন্তান যখন বয়ঃসন্ধিতে সংগৃহীত ছবি।

প্রতিটি মানুষের জীবন গৎবাঁধা এক ছকে আবদ্ধ। মায়ের গর্ভ থেকে পৃথিবীর আলো-বাতাসের সান্নিধ্য লাভ, তারপর বেশ কয়েক বছর এই গ্রহে কাঁটিয়ে অজানার উদ্দেশ্য পাড়ি জমানো।

মাঝের সময়টার জীবনকে যদি এক শব্দে বন্দি করতে হয় তবে শব্দটা বোধহয় পরিবর্তন। শৈশবের অনাবিল আনন্দের সময়টা পার করে কৈশোরে পা রাখার পর অন্যরকম এক অনুভূতির সঙ্গে পরিচয় হয় প্রত্যেক মানব সন্তানের।

বাংলা ভাষায় শৈশব এবং তারুণ্যের সন্ধিস্থলে থাকা সময়টাকে বলা হয় বয়ঃসন্ধি। দেশীয় প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এ সময়টায় অনিবার্য শারীরিক এবং মানসিক পরবর্তনের ফলে দিশেহারা ছেলেমেয়েদের সামগ্রিক অবস্থাকে উপজীব্য করেই আজকের লেখা সাজানো হয়েছে।

শারীরিক পরিবর্তন

শৈশব পেরিয়ে তারুণ্যে পা রাখার আগে প্রতিটি ছেলেমেয়ের দেহে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় যা তাকে পরবর্তীতে প্রজননক্ষম পূর্ণাঙ্গ পুরুষ বা নারীতে পরিণত হতে সাহায্য করে। ছেলেদের ক্ষেত্রে সাধারণত ১২ থেকে ১৪ বছরের মধ্যে পরিলক্ষিত হলেও মেয়েদের বেলায় পরবির্তনের সময়কালটা কিছুটা আগে।
সাধারণত ১১-১২ বছর বয়সে একজন মেয়ে তার দেহে পরিবর্তন লক্ষ্য করতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে তা ৮-৯ বছরেও দেখা দিতে পারে। অনেকের আবার কিছুটা দেরিতে যেমন ১৩ বছর বয়স থেকে শারীরিক পরিবর্তন আসে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় দেহে বিশেষ হরমোন নিঃসরণ শুরু হওয়ার ফলেই এই শারীরিক পরিবর্তন আসতে শুরু করে।

মনের ঘরে অচেনা আগন্তুক

ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের দেহে ও মনে বয়ঃসন্ধিজনিত পরিবর্তনের প্রভাব বেশি। শৈশবের নির্ভেজাল সময় পেরিয়ে এসে হঠাৎ এই শারীরিক পরিবর্তন মোকাবিলার মানসিক শক্তি অর্জন করা অনেক মেয়ের জন্যই দুরুহ হয়ে পড়ে। এর সঙ্গে যদি যোগ হয় রক্ষণশীল সমাজব্যবস্থা তবে তা যেন ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘাঁ’। শারীরিক এই পরিবর্তন সম্পর্কে আগে থেকে পরিষ্কার কোনো ধারণা না থাকায় বয়ঃসন্ধির প্রথম দিকটায় এদেশের অধিকাংশ মেয়েদেরই বেশ বিব্রতকর সময় পার করতে হয়। শহরাঞ্চলে এই বিষয়টি নিয়ে অভিভাবকদের মধ্যে সচেতনতা বাড়লেও গ্রামীণ জনপদে অবস্থাটা এখনো শোচনীয়।

অভিভাবকদের অনাগ্রহ, সঠিক শিক্ষা এবং তথ্যের অভাবে এসব অঞ্চলের মেয়েরা বয়ঃসন্ধিকালীন মানসিক চাপের মধ্যে থাকে। এর সঙ্গে ঋতুস্রাবের মতো শারীরিক উপসর্গের কারণে অধিকাংশ কিশোরীর মনে অজানা ভয় কাজ করে। মনের মধ্যে নানা ভয় এবং প্রশ্নের উদ্রেকের ফলে কিশোরীর আত্মবিশ্বাসের পারদটা যে তলানিতে গিয়ে ঠেকে তা বলাই বাহুল্য।

এ সময় ছেলেমেয়ের উভয়েরই আচরণ এবং আবেগীয় পরিবর্তনও লক্ষ্য করা যায়। বয়ঃসন্ধি নিয়ে মনে নানা সংকোচ এবং চিন্তাধারায় পরিবর্তনের কারণে নিয়মিত পরিবর্তিত আচরণ দেখা যায়। অনেক সময় অল্পতে রেগে যাওয়া কিংবা খিটখিটে মেজাজও লক্ষ্য করা যায়। এই সময়টায় ব্যক্তি নতুনরুপে আত্মপ্রকাশ করে বলে আত্মমর্যাদাবোধও বেড়ে যায়। এর ফলে অল্পতেই প্রতিক্রিয়া দেখানোটাও স্বাভাবিক আচরণে পরিণত হয়। এছাড়া অন্য কারো সাথে নিজের শারীরিক গঠনের তুলনা করে বা অন্যের আচরণ নকল করতে গিয়ে হতাশায় ডুবে যায় কিশোর মন। এই সময়টায় বন্ধু বা সঙ্গ বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অসৎ সঙ্গের পাল্লায় পড়ে পর্নোগ্রাফি এবং ইভ টিজিংয়ের মতো বিকৃত কাজে লিপ্ত হয় অনেক কিশোর। মেয়েদের ক্ষেত্রে নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণের অক্ষমতার কারণে আত্মবিধ্বংসী কাজে লিপ্ত হওয়ার প্রবণতাও দেখা যায়।

অভিভাবকদের করণীয়

বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে বয়ঃসন্ধিকালীন অভিভাবকদের সঙ্গে সন্তানের দূরত্ব সৃষ্টি হতে থাকে। অথচ এ সময়টায় অভিভাবকদের সঙ্গ সবচেয়ে বেশি দরকার। বিভিন্ন গবেষণা ও প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এ সময়টায় অভিভাবকদের করণীয় বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।

সন্তানকে সময় দেওয়া

জন্মের পর থেকে শিশু প্রতিটি সমস্যার সমাধানে মা-বাবার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেই শিশু বড় হয়ে কৈশোরে পদার্পণের পর শারীরিক এবং মানসিক পরিবর্তনগুলো সম্পর্কে মা-বাবার সঙ্গে খোলা মনে আলোচনা করতে পারেনা। ছোটবেলা থেকে মা-বাবার আঙ্গুল ধরে চলা ছেলে বা মেয়েটির তখন কৈশোরের এ পরিবর্তন সামলানোর ক্ষমতা থাকেনা। মেয়েদের ক্ষেত্রে শারীরিক ধকলটা বেশি যায় বলে অবস্থা আরো করুণ হয়ে পড়ে। এসব ব্যাপার বাবা-মায়ের সঙ্গে শেয়ার করা যাবেনা এমন ধারণার ফলে অভিভাবকের সঙ্গে সন্তানের দূরত্ব বাড়তেই থাকে যা তাকে ভুল পথে নিয়ে যেতে পারে। তাই ছোটবেলা থেকেই অভিভাকের উচিত সন্তানকে নিয়মিত সময় দেওয়া। ছোটবেলা থেকেই যদি বাবা-মা সন্তানের সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশে একসঙ্গে সময় কাটান তবে বয়ঃসন্ধির সময়টায় এসে সন্তান সবকিছুই তাদের সঙ্গে শেয়ার করতে পারেবে। তাই সন্তানের সঙ্গে একান্তে সময় কাটান এবং আগে থেকেই তাকে বয়ঃসন্ধি সময়ের আশু পরিবর্তন সম্পর্কে জানান।

সন্তানের সঙ্গে সম্পর্ক হোক সহজ

সন্তানের সঙ্গে সম্পর্ক হতে হবে সহজ এবং সাবলীল। এ সম্পর্কের গভীরতা এতটাই বেশি হওয়া উচিত যাতে সন্তান সবসময় তার মা-বাবার সঙ্গে যে কোনো বিষয় নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করতে পারে। এভাবে সহজ সম্পর্ক স্থাপনের ফলে সন্তানের উপযুক্ত শিক্ষা এবং মানসিক বিকাশ নিশ্চিত করা যাবে। এর সঙ্গে মাথায় রাখতে হবে জগতের নিয়মানুসারে বয়ঃসন্ধি বা যৌনজীবন সংক্রান্ত বিষয়গুলো অস্বাভাবিক কিছু নয় এবং এসব নিয়ে আলোচনা করাটা অন্য আট-দশটি বিষয়ের মতোই স্বাভাবিক হওয়া উচিত। তাই সন্তানের সঙ্গে খোলামনে এসব বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করুন। এর পাশাপাশি সন্তান যৌনবিষয়গুলো সম্পর্কে সঠিক তথ্য এবং উপযুক্ত শিক্ষা পাচ্ছে কিনা তা নিশ্চিত করুন। মেয়েদের ক্ষেত্রে বয়ঃসন্ধির সময়টায় শারীরিক পরিবর্তন এবং স্পর্শকাতর বিষয়গুলো সম্পর্কে মা আগে থেকেই সচেতন করে দিতে পারেন। এছাড়া আপনার মেয়ে কোনো যৌন-নিপীড়নের শিকার হচ্ছে কিনা তার দিকে খেয়াল রাখুন। মায়ের সঙ্গে এমন সম্পর্ক মেয়ের মনে সব সংকোচ এবং ভয় দূর করবে এবং একই সঙ্গে তাকে স্বাবলম্বী এবং যৌন সচেতন করে তুলবে।  

অতিরিক্ত সমালোচনা নয়

সন্তানের ভুলগুলো ধরিয়ে দেওয়া কিংবা সমালোচনা করাটা মোটেই খারাপ কিছু নয়। তবে এক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে সমালোচনাটা যাতে মাত্রা ছাড়িয়ে না যায়। বয়ঃসন্ধির সময়টায় ছোট-খাট বিষয়ে অতিরিক্ত সমালোচনা করলে সন্তানের মনে তা বিরুপ প্রভাব ফেলতে পারে। অনেক সময় দেখা যায় মা-বাবার বকুনির পরও সন্তান একই ভুল বারবার করছে। অথচ এই সন্তানই যখন ছোট ছিল তখন মা-বাবার প্রতিটি কথা মেনে চলতো। সন্তানের আচরণে এই পরিবর্তনে হতাশ হয়ে সমালোচনার মাত্রা বাড়িয়ে দেয়াটা মোটেও উচিত নয়। এক্ষেত্রে মাথায় রাখতে হবে এই বয়সটায় এসে সন্তানের হঠাৎ জেদি হয়ে যাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এ অবস্থায় সন্তানের ছোট-খাট ভুলগুলো মাফ করে দিয়ে বুঝিয়ে বলতে হবে।  

অনুকরণ বা প্রতিদ্বন্ধী বন্ধ করা

এখনকার সময়ে সন্তান লালন-পালনে গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসান অনেক অভিভাবক। সন্তানকে নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তা এবং পাশের বাড়ির অভিভাবকদের অনুকরণ বা প্রতিদ্বন্ধী ভাবতে গিয়ে নিজের সন্তানের প্রতি মনোযোগ দিতে ভুলে যান অনেক মা-বাবা। এক্ষেত্রে মাথায় রাখতে হবে সন্তানের উপযুক্ত যত্ন এবং শিক্ষার জন্য মা-বাবার কোনো বিকল্প নেই। আপনার সন্তানকে ঠিক কিভাবে বড় করে তুলতে হবে তা আপনার চেয়ে ভাল কেউ জানেনা। তাই অযথা পড়শীর ঘরে উঁকি না মেরে বা তথাকথিত বিশেষজ্ঞের পরামর্শের জন্য বসে না থেকে নিজের সন্তানের দিকে মনোযোগ দিন।

সন্তানের বন্ধুদের সম্পর্কে জানা

বয়ঃসন্ধির সময় সন্তানের বন্ধুদের সম্পর্কে জানুন। অনেক সময় এই বয়সটায় অসৎ সঙ্গে পড়ে সন্তান ভুল পথে পরিচালিত হয়। তবে সন্তানের ওপর এই নজরদারির মানে এই নয় যে তার মোবাইলের মেসেজ ঘেঁটে দেখতে হবে কিংবা প্রতিটি বিষয়ে জবাবদিহি চাইতে হবে। এর চেয়ে আগে থেকেই সন্তানকে বন্ধু নির্বাচনের ব্যাপারে সচেতন করুন। ছেলেমেয়ের বন্ধুদের বাসায় নিয়ে এসে তাদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলুন। এভাবে সন্তানের ওপর নজরদারিও অক্ষুণ্ন থাকবে এবং একইসঙ্গে বিষয়টি নিয়ে সন্তানের মনে কোনো প্রশ্নই আসবে না।

জন্মের পর থেকে কতশত স্বপ্ন নিয়ে জীবন সমুদ্রে নৌকা ভাসাই আমরা। সেই স্বপ্ন অর্জনের জন্য জীবনের প্রতিটা ধাপে খুব সতর্কতার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তাই বয়ঃসন্ধির অস্থির সময়টার জন্য আগে থেকেই প্রস্তুত থাকা উচিত। কর্মজীবন শুরুর আগে এই সময় ভালোভাবে সুস্থ পরিবেশে কাটাতে পারলে জীবনের সেই স্বপ্নগুলোর বন্দরে একদিন না একদিন ঠিকই নোঙর ফেলা যাবে।

সূত্র: কালের কণ্ঠ 

বাংলাদেশ সময়: ২১০০ ঘণ্টা, মে ২৮, ২০২৪
এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।