ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

সুন্দরবনে থামছেই না হরিণ নিধন!

মাহবুবুর রহমান মুন্না, ব্যুরো এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০২০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১১, ২০২৩
সুন্দরবনে থামছেই না হরিণ নিধন!

খুলনা: বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনে ভালো নেই মায়াবি চিত্রা হরিণ। বন্য এ প্রাণীটি চোরা শিকারি ও পাচারকারীদের প্রধান টার্গেটে পরিণত হয়েছে।

ফাঁদসহ নানা কৌশলে সুন্দরবনে হরিণ শিকার করেন তারা। সাম্প্রতিক সময়ে উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে সুন্দরবনে হরিণ শিকার। এসব হরিণের মাংস আবার বন সংলগ্ন বিভিন্ন এলাকায় হরহামেশা বিক্রি হচ্ছে। হরিণ শিকারের পাশাপাশি এসব শিকারির কাছ থেকে অন্যান্য বন্য প্রাণীও রেহাই পাচ্ছে না। ডজন-ডজন হরিণ শিকার হলেও তা নিয়ে খুব একটা তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না বলেও অভিযোগ রয়েছে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, শিকারিদের ধরতে সুন্দরবনে বন বিভাগের নিয়মিত টহল থাকলেও অদৃশ্য কারণে হরিণ শিকার কমছে না। বনবিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ম্যানেজ করে, আবার কখনও তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে ফাঁদ পেতে হরিণ শিকার করা হয়। বিভিন্ন ধরনের সুবিধা নিয়ে শিকারিদের সুযোগ করে দিচ্ছেন কিছু অসাধু বন কর্মকর্তা ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। তারা শিকারি চক্রের কাছ থেকে হরিণের মাংসসহ আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করায় দিনে দিনে সুন্দরবনে হরিণ শিকার বাড়ছে।

শনিবার (৪ ফেব্রুয়ারি) সুন্দরবন থেকে ৩০ কেজি হরিণের মাংস উদ্ধার করেছে বন বিভাগ। পশ্চিম সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জের তেরকাটি খাল এলাকা থেকে এসব হরিণের মাংস উদ্ধার করা হয়।   বন বিভাগের টহল টের পেয়ে হরিণ শিকারিরা বনের ভেতরে গা ঢাকা দেন। তাই এ সময় শিকারিদের কাউকে আটক করা সম্ভব হয়নি। তবে নৌকা ও বন বিভাগের দেওয়া একটি পাস উদ্ধার করেছে বন বিভাগের সদস্যরা।

রোববার (৫ ফেব্রুয়ারি) সুন্দরবন থেকে ডিঙি নৌকা, হরিণ শিকারের ফাঁদসহ ২০ কেজি হরিণের মাংস জব্দ করে বন বিভাগ। সুন্দরবন পূর্ব বনবিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের ইসহাকের ছিলা এলাকায় অভিযান চালিয়ে এসব হরণির মাংস জব্দ করা হয়।   এ সময় কাউকে আটক করতে পারেননি বনরক্ষীরা।

শুক্রবার (২৭ জানুয়ারি) সুন্দরবনের খুলনা রেঞ্জ থেকে ১২ কেজি হরিণের মাংসসহ চারজনকে আটক করে বন বিভাগ। বন বিভাগের সাতক্ষীরা রেঞ্জের টহল দলের সদস্যরা সুন্দরবনের বঙ্গবন্ধুর চর থেকে এসব হরিণের মাংস বিক্রির সময় তাদের হাতেনাতে আটক করেন।

আটকরা হলেন- সজীব মিয়া (৩৫), নওশের আলী (৩২), ইদ্রিস আলী (৪০) ও নূর আলী (৩৮)। তারা সবাই খুলনার বাসিন্দা।

সোমবার (২৩ জানুয়ারি) বাগেরহাটের শরণখোলায় বসত বাড়ি থেকে হরিণের দুটি চামড়া জব্দ করে বন বিভাগ। শরণখোলা উপজেলার সোনাতলা গ্রামের তানজির বয়াতির বাড়ি থেকে চামড়া দুটি উদ্ধার করা হয়। তবে এ সময় কাউকে আটক করতে পারেননি বনরক্ষীরা।

এর আগে রোববার (২২ জানুয়ারি) সুন্দরবন থেকে হরিণের মাংসসহ দুই শিকারিকে আটক করে বন বিভাগ। সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের  শরণখোলা রেঞ্জের ডিমেরচর এলাকা থেকে তাদের আটক করা হয়। এ সময় ১৬ কেজি হরিণের মাংস, আটকদের ব্যবহৃত ইঞ্জিনচালিত নৌকা, ১৫০টি ফাঁদ ও ২৫০ ফুট নাইলন সুতা জব্দ করেন বনরক্ষীরা।

আটক দুই হরিণ শিকারি হলেন- পিরোজপুরের পাথরঘাটা উপজেলার চরলাঠিমারা গ্রামের হাবিবুর রহমানের ছেলে মো. নিজাম (৪৫) ও করমজাতলার রতন আলীর ছেলে ইদ্রিস আলী (৪০)।

এদিকে মঙ্গলবার (১৭ জানুয়ারি) সুন্দরবন থেকে হরিণের মাংসসহ চার জেলেকে আটক করে বন বিভাগ। সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের দুবলার চর শুঁটকি পল্লী সংলগ্ন নাড়িকেলবাড়িয়ার চর থেকে সাড়ে চার কেজি হরিণের মাংস জব্দসহ তাদের আটক করা হয়।

আটক চার জেলেরা হলেন- খুলনার পাইকগাছা উপজেলার প্রতাপকাঠি গ্রামের আহসান আলী খানের ছেলে সাফায়েত খান, হরিঢালি গ্রামের জরিব গাজীর ছেলে হোসেন আলী গাজী, কড়ইখালী গ্রামের আ. গফুর গাজীর ছেলে রনোকুল গাজী এবং নোয়াকাঠি গ্রামের সোহরাব গোলদারের ছেলে খলিলুর রহমান। আটক জেলেরা দুবলার চরে শুঁটকি আহরণে নিয়োজিত ছিলেন।

এর আগে ২০২২ সালেও সুন্দরবনের হরিণ শিকারিরা ছিল ব্যাপক তৎপর। প্রায় বছরজুড়েই হরিণ নিধনের খবর ছিল।

সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক ও সাতক্ষীরা রেঞ্জ কর্মকর্তা এম কে এম ইকবাল হোছাইন চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, শুষ্ক মৌসুমে নদীতে পানি কম থাকে এ কারণে সহজে বনের মধ্যে ঢুকে যায় শিকারিরা। এ সময়ে হরিণ শিকারও একটু বেড়ে যায়। তবে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

তিনি বলেন, সুন্দরবনের মধ্যে যদি কেউ হরিণ শিকারি ধরিয়ে দিতে পারেন তাহলে তাকে ২০ হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হয়। আর বনের বাইরে ধরিয়ে দিতে পারলে রয়েছে ১০ হাজার টাকা পুরস্কার। যা গেজেটে উল্লেখ রয়েছে।

জানা যায়, সুন্দরবনের ৩০০ প্রজাতির প্রাণীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আর্কষণীয় প্রাণী হচ্ছে চিত্রা হরিণ। সুন্দরবনের আর্কষণীয় প্রাণীদের মধ্যে বাঘ ও চিত্রা হরিণ অন্যতম। বাঘের সংখ্যা কম হলেও হরিণের সংখ্যা প্রচুর; দেড় লাখের ওপরে। ফলে সুন্দরবনে যত্রতত্র হরিণের সাক্ষাৎ ঘটে পর্যটকদের। তাই বাঘের দেখা না পেলেও হরিণ দেখে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলেন পর্যটকরা।

যেভাবে চলে হরিণ শিকার: চলমান শুষ্ক মৌসুমে সুন্দরবনের বিভিন্ন স্থানে ঝাঁকে ঝাঁকে হরিণের দেখা মিলছে। খাল বা নদীর ধারে দল বেধে হরিণের চলাফেরার দৃশ্য এখন হরহামেশাই চোখে পড়ে। যেসব এলাকায় হরিণের বিচরণ বেশি সেসব স্থানে নাইলনের জাল পেতে, বিষ মাখিয়ে, স্প্রিং বসানো ফাঁদ পেতে, কলার সঙ্গে বড়শি ঝুলিয়ে, চেতনানাশক ওষুধ দিয়ে ও তীর অথবা গুলি ছুড়ে হরিণ শিকার করা হয়।

মাছ ধরার পারমিট নিয়ে হরিণ শিকারিরা রাতের আঁধারে গোপনে বনে ঢোকে। নাইলনের দড়ির এক ধরনের ফাঁদ ব্যবহার করেন তারা। হরিণের নিয়মিত যাতায়াতের পথে এগুলো পাতা হয়। যাতায়াতের সময় হরিণগুলো আটকে যায়। এক রাতে ফাঁদ পেতে আসা হয়। পরের রাতে গিয়ে আবার ফাঁদ দেখা হয়। অনেক সময় এসব ফাঁদে আটকে হরিণ মারাও যায়। আবার অনেক সময় ফাঁদে পা আটকে জালে জড়িয়ে থাকে।

এসব ফাঁদ বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে হিরণ পয়েন্ট, দুবলার চর, বঙ্গবন্ধুর চর, কটকা, তালপট্টি, কচিখালি, দুবলা চান্দেরশ্বর, বগি, চরখালি এলাকায়। বিভিন্ন উপলক্ষে চোরা শিকারিদের দৌরাত্ম্য বেড়ে যায় এসব এলাকায়। শিকারিরা বনের ভেতর থেকে হরিণ শিকার করে এনে লোকালয়ে থাকা সহযোগীদের হাতে পৌঁছে দেয়। বিভিন্ন জায়গায় হাতবদল হয়ে হরিণ পৌঁছে যায় নির্দিষ্ট গন্তব্যে।

হরিণের মাংস চড়া দামে বিক্রি হয়। ক্রেতারাও অনেক সময় প্রতারণা ভেবে হরিণের মাংস কিনতে চান না। তাই তাদের প্রমাণ দেখাতে চোরা শিকারিরা জীবন্ত হরিণ লোকালয়ে এনে জবাই করে থাকেন।

প্রতি কেজি হরিণের মাংসের দাম পড়ে এক হাজার ৫০০ টাকা। আর আস্ত একটি জীবিত হরিণের দাম চাওয়া হয় ১৫ হাজার টাকা।

হরিণের চামড়া-শিং সৌখিন ব্যক্তিরা সংগ্রহ করে ড্রইংরুম সাজায়। এছাড়া বনাঞ্চল এলাকার ধনাঢ্য ব্যক্তিরা হরিণের মাংস খেয়ে উৎসবও পালন করেন। কোনো বড় ধরনের স্বার্থসিদ্ধির জন্যও কর্তাব্যক্তিদের খুশি করতে গোপনে হরিণের মাংস সরবরাহ করেন; এমন তথ্যও পাওয়া গেছে।

শিকারি দমনে র‌্যাবের অভিযান দাবি: সুন্দরবন একাডেমির পরিচালক ফারুক আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, বন্য প্রাণী হলো সুন্দরবনের আকর্ষণ। বাঘ বাঁচাতে হলে হরিণকে বাঁচাতে হবে। বনে বাঘের প্রধান খাদ্য হরিণ। তাই হরিণ না থাকলে বাঘও থাকবে না। সুন্দরবনের ইকো সিস্টেমের ভারসাম্য রাখতে সব প্রাণীরই প্রয়োজন। এ থেকে কোনো একটি না থাকলে সিস্টেম নষ্ট হয়ে যায়। সুন্দরবনের বন্য প্রাণী রক্ষায় সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাব রয়েছে। ২০০ বছর আগের ব্রিটিশদের ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি দিয়ে এখনও চলছে বন। তখন তো জলবায়ু পরিবর্তন ছিল না, বনে এত পর্যটক ঢুকতো না। তাই বর্তমান অবস্থা বিবেচনা করে আধুনিক বন রক্ষার ব্যবস্থাপনা তৈরি করতে হবে।

তিনি বলেন, সুন্দরবনের প্রধান আকর্ষণ বাঘ ও হরিণ। বাঘের সংখ্যা তেমন না থাকলেও হরিণের সংখ্যা রয়েছে বেশি। তাই সুন্দরবনের যত্রতত্র হরিণের সাক্ষাৎ ঘটে পর্যটকদের। বাঘের দেখা না পেলেও হরিণ দেখে তারা আনন্দ পান। সেই হরিণ যদি শিকারিদের কারণে কমে যায় তাহলে বনের প্রতি আকর্ষণ কমে যাবে। র‌্যাব যদি সারা দেশের জঙ্গি দমন করতে পারে তাহলে সুন্দরবনের শিকারি দমন করতে পারবে না এটা তো হতে পারে না।

বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপমন্ত্রী যা বললেন: পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপমন্ত্রী বেগম হাবিবুন নাহার বাংলানিউজকে বলেন, হরিণ শিকার হচ্ছে বিষয়টি না জানার কিছু নয়। প্রতি পয়েন্টে পয়েন্টে তো লোক দিতে পারি না। সীমিত লোকবল ও জলযান নিয়ে সুন্দরবনের হরিণ রক্ষায় চেষ্টা করা হচ্ছে। এতটুকু জানি আমি প্রচেষ্টা চালিয়েছি। তবে পারিপার্শ্বিকতার কারণে সফল হতে পারিনি।  

বাংলাদেশ সময়: ১০২০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১১, ২০২৩
এমআরএম/আরআইএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।