ঢাকা, শনিবার, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১৮ মে ২০২৪, ০৯ জিলকদ ১৪৪৫

জাতীয়

গুলশানে আগুন

লাফ দেওয়ার আগে আলো দেখিয়ে সাহায্য চেয়েছিলেন বাসিন্দারা

সুব্রত চন্দ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮০৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০২৩
লাফ দেওয়ার আগে আলো দেখিয়ে সাহায্য চেয়েছিলেন বাসিন্দারা

ঢাকা: সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা। রাজধানীর গুলশানের একটি ১২ তলা ভবনের কয়েকটি তলায় তখন দাউ দাউ করে জ্বলছিল আগুন।

জীবন বাঁচাতে বারান্দা ও ছাদে এসে দাঁড়ান এক নারীসহ চারজন। হাতে থাকা মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে চিৎকার করে নিজেদের বাঁচাতে আকুতি জানাতেন তারা। এভাবে কেটে যায় ঘণ্টা খানেক। সাহায্য মিলছিল না। এক পর্যায়ে আগুনের লেলিহান থেকে বাঁচতে প্রাণের মায়ায় নিচে লাফ দেন তারা। শেষ রক্ষা না হওয়ায় দুজন চলে যান না ফেরার দেশে। বাকি দুজন হাসপাতালে ভর্তি।

সোমবার (২০ ফেব্রুয়ারি) সকালে এভাবেই গুলশান দুইয়ের ১০৪ নম্বর সড়কের দুই নম্বর অগ্নিদগ্ধ বাড়ির বাসিন্দাদের সম্পর্কে জানান প্রত্যক্ষদর্শীরা। গতকাল রোববার (১৯ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যা ৭টায় আবাসিক ভবনটিতে আগুনের ঘটনা ঘটে।

আগুনের শিকার ভবনটির উত্তর পাশের বাড়ির নম্বর ১৩। বাড়ির নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত মো. জালাল উদ্দিন। গত সন্ধ্যার ঘটনা সম্পর্কে তার কাছে জানতে চায় বাংলানিউজ। তিনি জানান, সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে আগুনের খবর পেয়ে কয়েকজন ওই বাড়ির দিকে দৌড়ে যায়। রাত ৮টায় তিনি যখন ডিউটি শেষ করেন, দেখেন আগুনের ভয়াবহ রূপ। এ সময় ভবনটির ১০ তলার দিকে চোখ যায় তার। দেখেন, সেখানকার উত্তর দিকের ফ্ল্যাটের বারান্দায় জীবন বাঁচাতে এসে দাঁড়িয়েছেন কয়েকজন। নিচে নামতে না পেরে সাহায্যের আশায় মোবাইলের আলো জ্বেলে সংকেত দিচ্ছিলেন তারা। চিৎকার করছিলেন বাঁচাও বাঁচাও বলে।

ওই সময় ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা ভবনের সামনের দিকে (পূর্ব দিকে) আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছিল। সেখানকার আটকে পড়া লোকজনকে ক্রেন দিয়ে নামানোর চেষ্টা চলছিল। এভাবে অনেক সময় কেটে যায়। উপায় না পেয়ে প্রাণে বাঁচতে উত্তর দিকের বারান্দায় থাকা চারজন লাফ দেন। তাদের মধ্যে এক নারী ও তিনজন পুরুষ ছিলেন। উপস্থিত লোকজন তাদের উদ্ধার করে অ্যাম্বুলেন্সের মাধ্যমে হাসপাতালে নিয়ে যায়।

জালাল উদ্দিন অভিযোগ করে বলেন, ফায়ার সার্ভিসের দুটি গাড়িই ভবনের সামনের দিকে ছিল। যদি একটি গাড়ি উত্তর পাশের আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করতো তাহলে হয়তো মানুষগুলোকে জীবন বাঁচাতে নিচে লাফ দিতে হতো না। ওই চারজন লাফ দেওয়ারও অনেক পরে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি এইদিকে (উত্তর দিকে) এসে আগুন নিয়ন্ত্রণ করে।

একই অভিযোগ করেন আরেক প্রত্যক্ষদর্শী ও আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির (এআইইউবি) গাড়ি চালক ইমরান। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, এই পাশে ৪-৫ জন লোক প্রায় দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা বারান্দায় দাঁড়ানো ছিল। কিন্তু কেউ যায়নি তাদের উদ্ধার করতে। সবাই সামনের দিকের মানুষজনকে নামানোর চেষ্টার করছিল। পরে রাত সাড়ে ৯টার দিকে চিল্লাচিল্লি শুনে দৌড়ে এসে দেখি চারজন মানুষ বারান্দা থেকে লাফ দিয়েছে। আগুনের ঝলকানি যখন আসছিল ভেতর থেকে, তখন লোকগুলো লাফ দিয়েছে। এর আগে তারা দাঁড়ানোই ছিল। এটা দেখার মতো নয়।

ভবন থেকে লাফ দেওয়া বাসিন্দারা ৮ বা ৯ তলায় ছিল বলে ধারণা ইমরানের। তিনি বলেন, ফায়ার সার্ভিস যদি আগেই এদিকে আসত বা ক্রেন দিয়ে আটকে পড়াদের নামানোর চেষ্টা করতো, তাহলে হয়তো লোকগুলো বাঁচতে পারত। বড় গাড়ি দুটি সামনে ছিল। লোকগুলো লাফ দেওয়ার অনেক পরে এসে ফায়ার সার্ভিস এই দিকের আগুন নেভায়।

১০৬ নম্বর রোডের ১৭ নম্বর বাড়ির একটি অফিসের অফিস সহকারী আব্দুল মোমিন বলেন, সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে ফায়ার সার্ভিস ও অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেনের আওয়াজ শুনে বাইরে এসে দেখি ওই ভবনটিতে আগুন লেগেছে। ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা বাড়ির সামনের দিকের আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে, মানুষজনকে উদ্ধার করছে। আমরা ফায়ার সার্ভিসের লোকজনকে বারবার উত্তর পাশে আসতে বলছিলাম। কিন্তু তারা আসেনি। আমরা সাধারণ মানুষ তাদের সাহায্য করতে পারছিলাম না। আমাদের অভিজ্ঞতাও নেই, প্রশিক্ষণও নেই।

তিনি আরও বলেন, রাত ৮টার যখন উত্তর দিকে সব ধোঁয়া হয়ে যায়। তখন দেখি বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষরা আতঙ্কে গ্লাস ভেঙে এক রুম থেকে আরেক রুমে ঢোকার চেষ্টা করছে। এরপর যখন আগুন একেবারে কাছে চলে আসে, হয়তো আর ২০ সেকেন্ড থাকলে আগুন ধরে যাবে, তখন তারা ভয়ে লাফ দেয়। আমি ওই জায়গায় থাকলে আমিও লাফ দিতাম। কারণ আগুন শরীরে লেগে যাচ্ছে। লাফ না দিয়ে তো উপায় নেই। নিচে পড়লে হয়তো বেঁচে যাবো, বা আত্মীয়-স্বজন আমার চেহারাটা দেখতে পারবে। নইলে তো পুড়ে ছাই হয়ে যাব।

রোববার ওই ভবনের আগুন নিয়ন্ত্রণে যায় ফায়ার সার্ভিসের ১৯টি ইউনিট। এতগুলো ইউনিট একসঙ্গে কাজ করলেও কেন ভবনে উত্তর পাশে আসতে দেরি করেছে, তার কোনো উত্তর নেই জালাল, ইমরান বা মোমিনের কাছে। রয়েছে কেবল একটি প্রশ্ন- কেন? যদিও রাত ৮টা থেকে ১১টা পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিসের ইউনিটগুলো কাজ করে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়।

আগুনের ঘটনায় নিহতরা হলেন- আনোয়ার (৩০) ও রাজু (৩৮)। তারা দুজন ছিলেন ভবনটির বাবুর্চির। আগুন থেকে বাঁচতে লাফ দেওয়ার পর তারা গুরুতর আহত হন। তাদের একজনকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল; আরেকজনকে গুলশানের জেড. এইচ শিকদার উইমেনস মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাদের মৃত্যু হয়। এছাড়া শিশু ও নারীসহ ২২ জনকে জীবিত উদ্ধার করেন ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা।

এ ঘটনায় রোববার রাতেই ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত দল গঠন করা হয়। যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী।

বাংলাদেশ সময়: ১৮০৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০২৩
এসসি/এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।