নারায়ণগঞ্জ: নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের কর্ণগোপ এলাকায় হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেডে অগ্নিকাণ্ডে ৫৪ জনের মৃত্যুর ঘটনায় মামলার তদন্তকারী সংস্থা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) কারখানার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাহেন শাহ্ আজাদসহ ৬ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেছে।
সোমবার (৪ সেপ্টেম্বর) বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন কোর্ট পুলিশের পরিদর্শক আসাদুজ্জামান।
অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. বদিউজ্জামানের আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিলে আগামী ১১ সেপ্টেম্বর পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করা হয়।
এদিকে অভিযোগপত্রে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় মামলা থেকে কারখানার মালিক এজাহারভুক্ত আসামি আবুল হাসেম (৭০) ও তার চার ছেলে হাসিব বিন হাসেম (৩৯), তারেক ইব্রাহিম (৩৫), তাওশীফ ইব্রাহিম (৩৩) ও তানজীম ইব্রাহিমকে (২১) অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
তবে এই অব্যাহতি যথার্থ নয় বলে মন্তব্য করেছেন মামলার বাদী। মামলার বাদী তৎকালীন ভুলতা পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক নাজিম উদ্দিন আহমেদ। বর্তমানে তিনি চট্টগ্রামে এসবিতে কর্মরত আছেন। তিনি বলেন, মামলার ফলাফলের বিষয়ে তদন্তকারী কর্মকর্তা তাকে কিছু জানায়নি।
তিনি বলেন, এই ঘটনায় কারখানার মালিক দায় এড়াতে পারেন না। এ কারণে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছিল। অভিযোগপত্রে কী আছে, তা দেখে পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
রোববার (৩ সেপ্টেম্বর) দুপুরে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডির নারায়ণগঞ্জ অফিসের পরিদর্শক মোকছেদুর রহমান ১৩ পৃষ্ঠার এই অভিযোগপত্র দাখিল করেন।
নারায়ণগঞ্জ কোর্ট পুলিশের পরিদর্শক আসাদুজ্জামান বলেন, ঘটনার দুই বছর পর অভিযোগপত্র দাখিল করা হলো। আসামিদের বিরুদ্ধে অবেহলার দ্বারা মৃত্যু সংঘটনের অভিযোগ আনা হয়েছে। এই ধারায় একজন আসামির সর্বোচ্চ ৫ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। আদালতে অভিযোগপত্রের ওপর শুনানি অনুষ্ঠিত হবে।
২০২১ সালের ৮ জুলাই রূপগঞ্জের হাসেম ফুড কারখানায় আগুনে পুড়ে কর্মকর্তা-শ্রমিকসহ ৫৪ জনের মৃত্যুর ঘটনায় ভুলতা পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক নাজিম উদ্দিন বাদী হয়ে কারখানার মালিক আবুল হাসেম ও তার চার ছেলেসহ ৮ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন। আবুল হাসেমসহ ৬ আসামি জামিনে আছেন।
অভিযোগপত্রভুক্ত আসামিরা হলেন—কারখানার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাহেন শাহ আজাদ (৪৩), উপ-মহাব্যবস্থাপক মামুনুর রশিদ (৫৪), সিভিল ইঞ্জিনিয়ার কাম প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. সালাউদ্দিন (২৬) ও প্রধান প্রকৌশলী (মেকানিক্যাল ও ইলেট্রিক) ওমর ফারুক (৩৮), কলকারখানা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর নারায়ণগঞ্জ অফিসের পরিদর্শক নেছার উদ্দিন (৪০) ও সৈকত মাহমুদ (৩৭)।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির নারায়ণগঞ্জ অফিসের পরিদর্শক মোকছেদুর রহমান বলেন, তার আগে আরও চার কর্মকর্তা মামলাটি তদন্ত করেছেন। তদন্তে তাদের প্রাপ্ত ফলাফল নতুন তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে সাক্ষ্য স্মারকলিপি দাখিল করে কারখানার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় কারখানার মালিকসহ ৫ জনকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। মামলার ফলাফল বাদীকে জানানো হয়েছে। মামলায় বাদীসহ ৯১ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে।
অভিযোগপত্রে সিআইডির তদন্ত কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, ৩৪ হাজার ৫০০ বর্গফুটের হাসেম ফুড কারখানার মূল নকশায় তিনটি সিঁড়ি থাকলেও নির্মাণকালে দুটি সিঁড়ি রাখা হয়। ২০২০ সালের ২ মে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে ম্যাংগো জুস উৎপাদনের জন্য ছাড়পত্র নেওয়া হলেও সেখানে ম্যাংগো জুসের পাশাপাশি শর্ত ভঙ্গ করে লাচ্ছা সেমাই, টোস্ট, মুড়ি, ক্যান্ডি, জ্যাম-জেলি, আচার, ম্যাংগো বার, সফট ড্রিঙ্ক ইত্যাদি খাবার উৎপাদন হতো। দুই দশমিক ৫৯ একর জমির ছাড়পত্র নেওয়া হলেও অনুমতি ছাড়া নসিলা উৎপাদনের জন্য কারখানা সম্প্রসারণ করা হয়।
কারখানায় পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা রাখা হয়নি। দুর্ঘটনা কবলিত ভবনে শ্রমিকদের বের হতে ভেতর ও বাইরে থেকে দরজা খোলার ব্যবস্থা রাখা হয়নি। প্রতিটি ফ্লোর নেট দিয়ে শ্রমিকদের আবদ্ধ করে রাখা হয়েছিল ও সিঁড়ি তালাবদ্ধ ছিল। কারখানায় শ্রমিকদের ফায়ার প্রশিক্ষণ ও ফায়ার কর্মী ছিল না। দুর্ঘটনা কবলিত ভবনের নিচ তলা থেকে ছয় তলা পর্যন্ত প্রতিটি ফ্লোরে দাহ্য পদার্থ মজুদ ছিল। সেই দাহ্য পদার্থের সঙ্গে উৎপাদিত মালামাল মজুদ করে রাখা হয়েছিল। কারখানার ভবনের ভেতরে মেশিন স্থাপনে দূরত্বের লেআউট প্ল্যান মানা হয়নি। এগজাস্ট ফ্যানও ভবনের ভেতরে রাখা ছিল। নকশা অনুযায়ী কারখানার দক্ষিণ পাশে ২০ ফুট রাস্তা ও পূর্ব পাশে ১০ ফুট এবং পশ্চিম পাশে ২০ ফুট রাস্তা রাখার কথা থাকলেও রাখা হয়নি।
কারখানাটি ৬ মাসের শর্ত সাপেক্ষে অনুমোদন নিয়ে করা হলেও সেই শর্ত বাস্তবায়ন করা হয়নি। শিশু আইন অমান্য করে শিশু শ্রমিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। আগুনে পোড়া অধিকাংশ মৃতদেহ শিশু বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়।
কলকারখানা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর নিয়মিত কারখানাটি পরিদর্শন করেনি। অথচ কারখানার লাইসেন্স অসাধুভাবে নবায়ন করে গেছে। প্রতিষ্ঠানের উপ-মহাব্যবস্থাপক সৌমেন বড়ুয়া ও পরিদর্শক নেছার উদ্দিন কারখানা পরিদর্শনে উদাসীনতা ও দায়িত্বে অবহেলার কারণে ৫৪ জন শ্রমিক আগুনে পুড়ে মারা গেছে। ফায়ার সার্ভিসের পরিদর্শক শাহ্ আলম যথাযথভাবে কারখানা পরিদর্শন না করে সনদ নবায়ন করেছেন। অবেহলা ও উদাসীনতার কারণে ৫৪ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। তারা যদি যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করতেন তাহলে এত বড় দুর্ঘটনা ঘটতো না।
হাসেম ফুড সেন্ট্রাল স্টোরে কম্প্রেসার মেশিনের গরম বাতাস বের হতে দুটি এগজস্ট ফ্যান খোলা জায়গায় না লাগিয়ে ফ্লোরের ভেতরে লাগানো ছিল। এগজস্ট ফ্যানের গরম বাতাস দাহ্য পদার্থের ওপর পরে উত্তপ্ত থাকতো। ক্যাবলের ইনসুলেশন গলে একটা আরেকটার ওপর লেগে আগুনের স্ফুলিঙ্গ তৈরি হয়ে তা ক্যাবলের ইনসুলেশনের ওপর পড়ে। এক পর্যায়ে আগুন নিচ তলার দাহ্য বস্তুর ওপর ধরে যায়। এগজস্ট ফ্যানের কারণে আগুন ধরে যায়। আগুন সিঁড়ি, লিফট, নিচতলা থেকে তৃতীয় তলা পর্যন্ত কনভয়ের বেল্ট, ক্যাবল ডকেট, জানালার কাছে রক্ষিত ফিনিশড গুডস, রেজিন, ভোজ্যতেল, প্লাস্টিক, বিভিন্ন ধরনের মালামাল এবং গুদামের কারণে আগুন নিচ তলা থেকে ৬ষ্ঠ তলা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে।
হাসেম ফুডসের মালিক ও তাদের নিয়োগতকৃত কর্মকর্তাদের অপরিকল্পনা-অব্যবস্থাপনা জনিত কারণে বৈদ্যুতিক গোলযোগে সৃষ্ট আগুন থেকে অগ্নিকাণ্ডের কারণ তদন্তে প্রাথমিকভাবে সত্য বলে প্রতীয়মান হয়েছে।
সার্বিক তদন্তে প্রাপ্ত তথ্য পর্যালোচনা, সাক্ষ্য প্রমাণে ঘটনাস্থল পরিদর্শন, ভিডিও ফুটেজ, মরদেহ সুরতহাল, ডিএনএ টেস্ট প্রতিবেদন, ঘটনার পারিপার্শ্বিকতা হাসেম ফুডসের দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের দায়িত্বে অবহেলা, অপরিকল্পিত ও অব্যবস্থাপনা এবং তুচ্ছতাচ্ছিল্য কার্যকলাপ, উদাসীনতাসহ নিজেদের খুশি মতো কারখানা পরিচালনা করার কারণে এই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের সৃষ্টি হয়। এতে কারখানার কর্মকর্তা-শ্রমিক ৫১ জন আগুনে পুড়ে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গেছে। আগুনের ঘটনায় তিন তলা থেকে লাফিয়ে পড়ে মারাত্মক আহত হয়ে নির্মমভাবে তিন শ্রমিকের মৃত্যু হয়।
মামলার এজারভুক্ত আসামি কারখানার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাহেন শাহ, উপ-মহাব্যবস্থাপক মামুনুর রশিদ, সিভিল ইঞ্জিনিয়ার কাম অ্যাডমিন সালাউদ্দিন, প্রধান মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার ওমর ফারুক ও কলকারখানা প্রতিষ্ঠান পদিরর্শন অধিদপ্তর পরিদর্শক নেছার উদ্দিন ও সৈকত মাহমুদ পেনাল কোডের ৩০৪ (ক) ৩৪ ধারায় প্রাথমিকভাবে অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে।
তদন্তকালে হাসেম ও তার চার ছেলের বিরুদ্ধে মামলায় জড়িত থাকার সুনির্দিষ্ট সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি। অভিযোগে বর্ণিত পেনাল কোড ৩০২/৩২৩/৩২৪/৩২৫/৩২৬/৩০৭ ধারায় সত্যতা পাওয়া যায়নি। এজারভুক্ত আসামি আবুল হাসেম ও তার চার ছেলের বিরুদ্ধে জড়িত থাকার সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণ না পাওয়ায় তাদেরকে মামলার দায় থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৯০৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৪, ২০২৩
এমআরপি/এমজেএফ