ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

রাস্তার পাশে ময়লার স্তূপ, খালি পড়ে আছে ১৩ কোটি টাকার ল্যান্ডফিল

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৪৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৯, ২০২৪
রাস্তার পাশে ময়লার স্তূপ, খালি পড়ে আছে ১৩ কোটি টাকার ল্যান্ডফিল

চাঁপাইনবাবগঞ্জ: প্রায় দুই লাখ ৮০ হাজার বাসিন্দার প্রথম শ্রেণীর পৌরসভা চাঁপাইনবাবগঞ্জ ( সদর) পৌরসভা। দিনে বর্জ্য তৈরি হয় প্রায় ৫০ টন।

আর এসব বর্জ্য ফেলা হচ্ছে পরিবেশ অধিদপ্তরের কার্যালয়ের পেছনে চাঁপাইনবাবগঞ্জ-গোমস্তাপুর সড়কের নয়াগোলা মোড়ে রাস্তার পাশে খোলা মাঠে।  

অন্যদিকে খোলা জায়গায় বর্জ্য ফেললে পরিবেশ নষ্ট হওয়াসহ মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতি বিবেচনায় পৌরসভাটি নির্মাণ করে একটি স্যানিটারি ল্যান্ডফিল। এতে ব্যয় হয় প্রায় ১৩ কোটি টাকা। অথচ নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার আড়াই বছর পেরিয়ে গেলেও সেই ল্যান্ডফিল কাজে আসছে না। নিয়ম ভেঙ্গে এখনও বর্জ্য ফেলা হচ্ছে বিভিন্ন খালি জায়গায়।  

পৌরবাসী বলছেন, খোলা জায়গায় ময়লা ফেলার কারণে আবাসিক এলাকায় দুর্গন্ধে টেকা দায় হয়ে পড়েছে। পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। রোগ-বালাইয়ের প্রকোপও বেড়েছে। বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, এ ধরনের জায়গায় বর্জ্য ফেলা হলে তা আশপাশের মানুষের জন্য স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হবে। বড় অঙ্কের অর্থ খরচ করে নির্মিত ল্যান্ডফিলটি কাজে লাগানোর পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভা সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ সরকার ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে তৃতীয় নগর পরিচালন ও অবকাঠামো উন্নতিকরণ প্রকল্পের আওতায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভার দ্বারিয়াপুরে ল্যান্ডফিল নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ২০২০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর এর কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। তবে করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতিতে কাজ পিছিয়ে এর নির্মাণের কাজ শেষ হয় আরও এক বছর পর। জমি অধিগ্রহণ ও অবকাঠামো নির্মাণসহ এই ল্যান্ডফিলের জন্য কাজে মোট ব্যয় হয় ১২ কোটি ৯৫ লাখ ১৪ হাজার ২৩৫ টাকা। আধুনিক ও পরিবেশসম্মত উপায়ে দৈনিক ২৩ টন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার লক্ষ্য নিয়ে তৈরি হয় এই স্যানিটারি ল্যান্ডফিল।  

ল্যান্ডফিলের পাশে রয়েছে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে বিভিন্ন ফুলের বাগান। বর্জ্য থেকে গন্ধ ছড়ানোর পরিবর্তে যেন ফুলের সুগন্ধি ছড়াতে পাড়ে এজন্যই এ পরিকল্পনা। গত আড়াই বছর হলো স্যানিটারি ল্যান্ডফিলটি বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়ে থাকলেও তা কোনো কাজেই আসছে না। উল্টো সেখানে স্থাপিত বিভিন্ন উপকরণ নষ্ট হতে বসেছে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, আধুনিক মানসম্মত বর্জ্য ব্যবস্থাপনাটি কাজে না লাগিয়ে বর্তমানে পৌরসভার সব বর্জ্য ও ময়লা-আর্বজনা ফেলা হচ্ছে পৌর এলাকার নয়াগোলায় পুলিশ লাইন্সের বিপরীতে খোলা জায়গায়। পাশেই রয়েছে বিসিক শিল্পনগরী, নয়াগোলা বাজার, এতিমখানা, স্কুল, মাদরাসা, আবাসিক এলাকা ও পরিবেশ অধিদপ্তরের চাঁপাইনবাবগঞ্জ কার্যালয়। সেখান থেকে এলাকায় দুর্গন্ধ ছড়ানোর পাশাপাশি দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। এ ছাড়াও নানা রকম রোগে আক্রান্ত হচ্ছে স্থানীয় বাসিন্দারা। এতে পরিবেশ দূষণের পাশাপাশি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে পৌরবাসী। স্থানীয়দের হাজারো বাধা ও অভিযোগ সত্ত্বেও ঘনবসতিপূর্ণ আবাসিক এলাকায় ফেলা হচ্ছে এসব বর্জ্য। অভিযোগ ও বাধা দিলেও আবাসিক এলাকায় বর্জ্য ফেলা বন্ধ করা যায়নি।

নয়াগোলার বাসিন্দা ইউসুফ আলী বলেন, দীর্ঘদিন ধরে শুনে আসছি অনেক টাকা খরচ করে ময়লা ফেলার জায়গা নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু তারপরও এখানে ফাঁকা জায়গায় ময়লা ফেলা হচ্ছে। বারবার পৌর কর্তৃপক্ষকে জানিয়েও কোনো সুরাহা হয়নি। ময়লার গন্ধে এলাকায় থাকায় কষ্টকর হয়ে পড়েছে।

একই এলাকার নয়াগোলা ঘাটপাড়া গ্রামের মজিব রহমান জানান, পুলিশ লাইনস এবং বিসিক এলাকা হওয়ায় এখানে বাড়ির চাহিদা অনেক। কিন্তু পৌরসভার ফেলা বর্জ্যের কারণে এখানে বাড়ি ভাড়া কমিয়েও কেউ বাসা ভাড়া নিতে চাইনা। লাখ লাখ টাকা খরচ করে বানানো বাড়ি এখন গলার কাঁটা।

রিকশাচালক আজিজুল হক বলেন, ময়লা ফেলার জায়গার সামনে আধা কিলোমিটার পর্যন্ত দুর্গন্ধ ছড়িয়ে থাকে। যাত্রীদেরও খুব সমস্যায় পড়তে হয়। একটু বৃষ্টি হলেই গন্ধ তীব্র আকার ধারণ করে। আবাসিক এলাকায় ময়লা-আর্বজনা না ফেলে শহরের বাইরে ফেলার দাবি তার।

এলাকার মাদরাসার ছাত্র মাহিম বলেন, এ রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় তীব্র গন্ধের কারণে নাক চেপে যেতে হয়। বিকল্প রাস্তা না থাকায় উপায় না থাকলেও এ রাস্তা দিয়েই যেতে হয়।

স্থানীয় সায়েমা খাতুন বলেন, স্বাভাবিক সময়েই দুর্গন্ধ ছড়ায়। আর বৃষ্টি হলে তো কথাই নেই। বাসার পাশেই এভাবে বর্জ্য ফেলে রাখা হয়েছে। মাছি ও বিভিন্ন পোকা খাবার ডেকে রেখেও প্রতিরোধ করা যায় না। রয়েছে মশার উপদ্রব। এসব কারণে ছেলে-মেয়েরা ঘনঘন নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। তিনি উল্টো প্রশ্ন করেন, এত আধুনিক-সুযোগ সুবিধা দিয়ে এমন ল্যান্ডফিল কেন করা হলো, তা বোধগম্য নয়। ব্যবহার যদি না করা হয়, তাহলে কোটি কোটি টাকা খরচ করে ল্যান্ডফিল তৈরি করার দরকার কী ছিল?

স্থানীয় ব্যবসায়ী আব্দুল খালেক জানান, পাশেই বর্জ্য স্তূপ থাকায় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে থাকায় দায়। বিশেষ করে বৃষ্টির পর থাকায় যায় না। আর পরিবারের সদস্যদের রোগবালাই লেগেই থাকে। গত পাঁচ বছরে দুই মেয়র ও স্থানীয় সংসদ সদস্যকে এলাকাবাসী বার বার তাগাদা দেওয়ার পরও বর্জ্য ফেলা বন্ধ হচ্ছে না। এমনকি পরিবেশ অধিদপ্তরে অভিযোগ দেওয়ার পরও তারা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

স্যানিটারি ল্যান্ডফিল প্রস্তুত থাকলেও কাজে আসছে না বলে স্বীকার করেন এর তত্ত্বাবধায়ক মো. ওয়াসিম। তিনি বলেন, প্রায় আড়াই বছর ধরে ল্যান্ডফিল পুরোপুরি প্রস্তুত। কিন্তু এখানে ময়লা-আর্বজনা ফেলা হয় না। আপাতত নয়াগোলায় খোলা জায়গায় ফেলা হচ্ছে পৌরসভার সব বর্জ্য। কবে নাগাদ এখানকার (ল্যান্ডফিল) কার্যক্রম শুরু হবে, তাও জানি না।

খোলা জায়গায় ফেলা ময়লা-আর্বজনা পরিবেশ দূষণের কারণ হবে উল্লেখ করলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভার শহর পরিকল্পনাবিদ মোহা. ইমরান হোসাইন। তিনি বলেন, বিভিন্ন সমস্যা ও সংকটের কারণে স্যানিটারি ল্যান্ডফিলটি পুরোপুরি চালু করা যায়নি। তবে বর্তমানে সেখানে পৌরসভার মধ্যে থাকা মনুষ্য বর্জ্য ফেলার কাজ চলছে। ল্যান্ডফিলটি পুরো চালু করার আগে পৌরবাসীকে পচনশীল ও অপচনশীল বর্জ্য সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে। এ লক্ষ্যে কাজ করেছে পৌরসভা। আশা করি, শিগগিরই ল্যান্ডফিলটির কার্যক্রম শুরু হবে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ সিভিল সার্জন ডা. এস এম মাহমুদুল রশিদ বলেন, খোলা জায়গায় বর্জ্য ফেলায় ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়াজনিত নানা রোগ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তিনি বলেন, খোলা জায়গায় বর্জ্য ফেলায় আশপাশের বাসিন্দারা ব্যাপক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকবেন। এ ছাড়াও বিভিন্ন রোগবালাই ছড়িয়ে পড়ার তীব্র আশঙ্কা রয়েছে। তার মেডিকেল বর্জ্য থাকলে এর প্রভাব হবে ভয়াবহ।

পৌরসভার বর্জ্য ফেলার কারণে পরিবেশ অধিদপ্তরের চাঁপাইনবাবগঞ্জ কার্যালয়ের পেছনের কোনো জানালা খোলা সম্ভব হয় না জানিয়ে কার্যালয়টির সহকারী পরিচালক মো. মিজানুর রহমান বলেন, জনবসতি পূর্ণ জায়গায় কখনোই বর্জ্য ফেলার নিয়ম নেই। কিন্তু এক্ষেত্রে এখানে ব্যতিক্রম। ইতোমধ্যেই এটি নিয়ে পৌর কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। তারা জানিয়েছে দ্বারিয়াপুরের ল্যান্ডফিলটিতে বর্জ্য ফেলার জন্য কিছু নিয়ম রয়েছে। অপচনশীল বর্জ্য পড়লে কোটি টাকার প্রকল্পটির সক্ষমতা নষ্ট হবে। তাই পৌরবাসী সচেতন হলেই এখানে বর্জ্য ফেলা বন্ধ করে দেবে পৌর কর্তৃপক্ষ।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. তৌফিকুল ইসলাম বলেন, আমাদের লোকবল ও বিভিন্ন সরঞ্জাম সংকট থাকায় প্রতিদিন গড়ে ৩০ ট্রাক বর্জ্য থেকে পচনশীল বর্জ্য বাছাই করা কঠিন। পাশাপাশি পৌরবাসীর মধ্যে পচনশীল ও অপচনশীল বর্জ্য বসতবাড়ি থেকেই আলাদা করে ডাস্টবিনে ফেলার বিষয়ে সচেতনতার অভাব রয়েছে। প্রধানত এই দুই কারণে স্যানিটারি ল্যান্ডফিল চালু করতে পারছে না পৌর কর্তৃপক্ষ। তবে বর্জ্য আলাদা করে ফেলতে বাড়ি বাড়ি আধুনিক ডাস্টবিন প্রদান ও জনসচেতনতা তৈরিতে উঠান বৈঠক করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে ১২ হাজার আধুনিক ও বর্জ্য পৃথক রাখার ডাস্টবিন দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ১০৪২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৯, ২০২৪
এসএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।