ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

সবুজ পাতার ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে লিচুর সোনালি মুকুল

টিপু সুলতান, উপজেলা করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩২৫ ঘণ্টা, মার্চ ২৩, ২০২৪
সবুজ পাতার ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে লিচুর সোনালি মুকুল

পাবনা (ঈশ্বরদী): প্রকৃতিতে এখন ঋতুরাজ বসন্ত চলছে। ফাল্গুন-চৈত্র দুমাস বসন্তকাল।

তাই প্রকৃতি সেজেছে রং-বেরঙয়ে। চারিদিকে সবুজের সমাহার। ঋতু বদলের সঙ্গে সঙ্গে পাবনার ঈশ্বরদীতে সবুজ পাতার ফাঁকে প্রতিটি লিচুর বাগানে গাছে গাছে উঁকি দিচ্ছে নাক ফুলের মতো লিচুর সোনালি মুকুল।  

লিচু গাছের মুখরিত তাক লাগানো মুকুল দেখে বাগান চাষি ও গাছ মালিকেরা অনেক খুশি। চলতি মৌসুমে ঈশ্বরদী উপজেলায় তিন হাজার ১১৫ হেক্টর জমিতে বাণিজ্যিকভাবে লিচু চাষ হচ্ছে। বৈরী ও দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া যদি না আসে তবে লিচুর বাম্পার ফলন হবে। এ বছর বাগান মালিকেরা লাভবান হবেন বলে আশা করা হচ্ছে।  

সরেজমিনে দেখা গেছে, লিচু গাছের মুকুলের সঙ্গে বাগানের চাষি ও মালিকদের যেন সোনালি স্বপ্ন উঁকি মারছে সবুজ পাতার ফাঁকে। গাছে লিচুর মুকুল আসার পর যেন ঝরে না পড়ে তাই লিচুর কুঁড়ি আসার আগে গাছের গোড়া পরিষ্কার, সেচ ও সার দিয়ে কৃষি অফিস অনুমোদিত ভিটামিন জাতীয় বিভিন্ন রকম মেডিসিন স্প্রে করে বাগান পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। লিচুর বাগানে বাড়তি শ্রম দিচ্ছেন চাষিরা। কারণ লিচু গাছে মুকুল থেকে কুঁড়ি ও ফল আসা পর্যন্ত যত্ন করলেই মিলবে বাম্পার ফলন।

ঈশ্বরদী উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলায় তিন হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন জাতের লিচু চাষ হয়েছে। ঈশ্বরদী পৌরসভা ও সাতটি ইউনিয়নে বিভিন্ন গ্রামে তিন হাজার ১৫০ হেক্টর জমিতে দুই লাখ ৮৩ হাজার ৫০০টি লিচু গাছ রয়েছে। বিঘা প্রতি ২০টি থেকে ১৫টি গাছ অর্থাৎ এক একর জমিতে ৪২টি, এক হেক্টর জমিতে ৯০টি গাছ হয়েছে। সেখানে ছোট বড় বাগান মিলিয়ে ১১ হাজার ২৭০টি গাছে লিচুর বাগান রয়েছে।  

ঈশ্বরদী উপজেলায় লিচু আবাদি কৃষকদের সংখ্যা নয় হাজার ৬২০ জন। বাণিজ্যিক আকারে লিচু বাগান রয়েছে দুই হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে। বিচ্ছিন্নভাবে বসতবাড়ি আবাদ হয়েছে ৫০০ হেক্টর জমিতে। ফলন্ত আবাদি জমির পরিমাণ দুই হাজার ৮৩৫ হেক্টর জমি। লিচু উৎপাদন জমির পরিমাণ দুই হাজার ৮৩৫ হেক্টর এবং অফলন গাছ রয়েছে ৫৫ হাজাট ৫৫০টি।

কৃষি অফিস সূত্র আরও জানা যায়, ঈশ্বরদী উপজেলায় প্রধানত, ৩ জাতের লিচু বেশি চাষ হয়। তার মধ্যে মোজাফ্ফর (দেশী) লিচু পরিপক্ব হয়ে সবার আগে বাজারে আসে। তবে ব্যবসায়ীদের বেশি চাহিদা বোম্বাই ও চায়না-৩ লিচু। আর তাই চাষিরা বেশি ঝুঁকছেন সেদিকে। স্বল্পসংখ্যক কৃষক তার জমিতে কদমি, কাঁঠালি এবং বেদেনা, চায়না-১, চায়না-২ লিচুর চাষ শুরু করেছে। বোম্বাই, চায়না-৩  লিচু আকারে বড়, খেতে সুমিষ্ট স্বাদ গন্ধ আলাদা, লিচুর আঁটি ছোট হওয়ার কারণে দেশে-বিদেশে বেশ সুনাম রয়েছে। যে কারণে উপজেলার সলিমপুর ইউনিয়নে চর-মিরকামারী, জয়নগর, ভাড়ইমারী, বক্তারপুর, জগন্নাথপুর, দাশুড়িয়া ইউনিয়নের নওদাপাড়া, কোলেরকান্দি, সাহাপুর ইউনিয়নের আওতাপাড়া, চর-কদিমপাড়া, পাকশী ইউনিয়নের জিগাতলা, নতুন রুপপুর, চর রূপপুর, দিয়ার বাঘইলসহ বিভিন্ন ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে লিচুর বাগান রয়েছে।

শুক্রবার (২২ মার্চ) সরেজমিন ঈশ্বরদী উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নে যতদূর চোখ যায়, গাছে গাছে থোকায় থোকায় ঝুলছে লিচুর মুকুল। লিচু গ্রাম খ্যাত ইউনিয়নে এমন কোনো বাড়ি নেই, যে বাড়িতে একটি লিচুর গাছ নেই। বাগান মালিক ও কৃষকেরা লিচুর বাগান পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন।  

লিচুর বাগান মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে ফাল্গুনের মাঝামাঝি সময়ে গাছে গাছে মুকুল আসতে শুরু করেছে। চৈত্রের মাঝামাঝিতে বাগানগুলোতে লিচুর মুকুল থেকে কুঁড়ি আসা শুরু হয়েছে। চৈত্রের শেষ সপ্তাহে কুঁড়ি থেকে ফুটবে গুটি লিচু। সবুজ গুটি থেকে থোকা থোকা বৈশাখের শেষে টকটকে লাল রঙে রাঙাবে গ্রাম। লিচুর রাজ্যে পরিণত হবে পাবনার ঈশ্বরদীর অর্ধশত গ্রাম।  

লিচু চাষিরা জানান, চলতি মৌসুমে লিচুর মুকুল আসার আগে হালকা বৃষ্টি মুকুল আসার পর পুনরায় হালকা বৃষ্টির কারণে পূর্ণাঙ্গ মুকুল বের হয়েছে। ইতোমধ্যে মুকুল থেকে ফুল ফুটতে শুরু করেছে। যদি এ বছর আবহাওয়া অনুকূলে থাকে, কয়েক বছরের তুলনায় এবার লিচুর বাম্পার ফলনের সম্ভাবনা রয়েছে।  

লিচুর বাগান চার ধাপে বিক্রি হয়। লিচু গাছে পাতা আসা শুরু করে মুকুল আসার আগেই এবং লিচুর মুকুল থেকে লিচুর গুটি হওয়ার পরে বাগান বিক্রি হয়। লিচু সবুজ গুটি হওয়া থেকে ফল ধরা পর্যন্ত, ফল পাকলে লিচু গাছ থেকে পাড়া পর্যন্ত চারবার পরিবর্তন হয় বাগানের মালিকানা। তবে অনেক বাগান মালিকরা লাভের আশায় নিজেই শ্রম দেন। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ব্যবসায়ীরা বাগান ক্রয় করে পরিচর্যাও করেন বলে জানান লিচু চাষিরা।

উপজেলার সলিমপুর ইউনিয়নের চর-মিরকামারী গ্রামের কৃষক কালাম সরদার বাংলানিউজে বলেন, আমার ১২ বিঘা জমিতে লিচু গাছে পরিপূর্ণ মুকুল এসেছে। লিচুর মুকুল থেকে গুটি আসার পরপরই দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে পাইকাররা এসে বাগান ক্রয় করেন। লিচুর গুটির ওপর নির্ভর করে দুইমাসের জন্য বাগান বিক্রি করা হয়। এ বছর বেশ ভালো দাম মিলবে বলে আশা করছি।  

ঈশ্বরদী উপজেলার পাকশী ইউনিয়নের রূপপুর গ্রামের লিচু চাষি পলাশ আহমেদ বলেন, আমার ১০ বিঘা জমিতে লিচুর বাগান রয়েছে। তবে চৈত্র মাসের শুরুতে যে বৃষ্টি হয়েছে, তা কৃষকদের জন্য আশীর্বাদ। যা মুকুলের জন্য কিন্তু অনেক উপকার। এতে পাতা সতেজ হয়েছে, লিচুর মুকুলগুলো পরিষ্কার হয়েছে। রোগবালাই কম হবে, সব মুকুলের গুটিতে ফল ধরবে, এতে অন্যবারের চেয়ে বাম্পার ফলন হবে।

ঈশ্বরদী উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মিতা সরকার বাংলানিউজকে জানান, ফাল্গুনে লিচুর মুকুল থেকে ফুল আসা শুরু হয়েছে। চলতি মৌসুমে মুকুল আসর আগে এবং পরে হালকা বৃষ্টি হওয়াতে অন্য বছরের তুলনায় লিচুর ফলন ভালো হবে এবার।

তিনি আরও জানান, লিচু গাছে মুকুল আসার আগে ও পরে রোগবালাই দমন ও লিচু মুকুল থেকে লিচুর গুটি যেন গাছ থেকে ঝরে না পড়ে সেজন্য আমরা নানাভাবে কৃষকদের পরামর্শ দিচ্ছি।

তিনি বলেন, লিচু গাছের সংখ্যা ও ফলন অনুযায়ী লক্ষ্যমাত্রা ধরেছি প্রায় সাড়ে ৫০০ কোটি টাকা। তবে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ার বেশ সম্ভাবনা রয়েছে।  

বাংলাদেশ সময়: ১৩২৪ ঘণ্টা, মার্চ ২৩, ২০২৪
এসএম 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।