ঢাকা, রবিবার, ১৪ পৌষ ১৪৩১, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

ফরিদপুরে মাটি খুঁড়ে পাওয়া যায় নারীদের শাড়ি-ব্লাউজ-চুড়ি ও হাড়গোড়

হারুন-অর-রশীদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭১৮ ঘণ্টা, মার্চ ২৫, ২০২৪
ফরিদপুরে মাটি খুঁড়ে পাওয়া যায় নারীদের শাড়ি-ব্লাউজ-চুড়ি ও হাড়গোড়

ফরিদপুর: ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাস। চারপাশে বৃষ্টির পানি।

কখনোবা সারাদিন আকাশ থেকে ঝরছিল টুপটাপ বৃষ্টি। ২১ এপ্রিল হঠাৎ রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ ঘাট হয়ে ট্যাংক, কামান ও গোলাবারুদ নিয়ে পাক হানাদার বাহিনী ফরিদপুরে প্রবেশ করে। চারপাশে গোলাবারুদ আর গুলির শব্দ। মানুষ ঘর ছেড়ে পালাতে শুরু করলেন। কেউবা নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে গিয়ে উঠলেন। চারদিকে শুনশান নীরবতা, ভয় আর আতঙ্ক। হানাদার বাহিনীরা ঘাঁটি তৈরি করলেন ফরিদপুর সার্কিট হাউস ও শহরের শেখ জামাল স্টেডিয়ামের আশেপাশে। সেখানে থাকা জর্জ কোর্টের বিল্ডিংগুলোতেও থাকা-খাওয়াসহ নানা আবাসস্থল বানিয়ে নিল পাকিস্তানি আর্মিরা।

কথাগুলো বলছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সময়কার দৃশ্যগুলো স্বচক্ষে দেখা মো. মঈনুদ্দিন মোল্যা (৬৫)। তার বাড়ি ফরিদপুর শহরের গুহলক্ষ্মীপুর এলাকায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ক্লাস ফাইভে পড়ালেখা করতেন। বয়স তার ১০ কিংবা ১১ বছর।

এরপর পাকিস্তানি বাহিনী রাজাকারদের সহযোগিতা নিয়ে বাড়ি থেকে মুক্তিবাহিনী ও যুবকদের রশি বেঁধে নিয়ে যেত শেখ জামাল স্টেডিয়ামের পাশে থাকা তাদের ঘাঁটিতে। এরপর নানা নির্যাতন শেষে কাউকে চোখমুখ বেঁধে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে তাদের মাটি চাঁপা দেওয়া হতো। যুবতী মেয়েদের নিয়ে সম্ভ্রমহানি করা হতো, আবার কাউকে সম্ভ্রমহানি শেষে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে ও গুলি করে মেরে ফেলতেন হানাদার বাহিনী।

মঈনুদ্দিন মোল্যা বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় এতো মিডিয়া কিংবা প্রচারমাধ্যম ছিল না। যুদ্ধের খবর জানতে রেডিও-ই ছিল বড় ভরসা। তাইতো দেশের খবর জানতে ফরিদপুর শহরের স্টেশন বাজারের রামজীবন চর্মকারের দোকানে প্রায় দেড়-দুই কিলোমিটার দূরে থেকে সন্ধ্যায় বিবিসির খবর শুনতে আসতেন মানুষ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও দেশের কি অবস্থা জানতে সবাই উদগ্রীব হয়ে থাকতেন।

এ ব্যাপারে শিক্ষাবিদ ও সাবেক বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাংবাদিক প্রফেসর মো. শাহজাহান বাংলানিউজকে বলেন, ২১শে এপ্রিল ফরিদপুরে প্রথম আসে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। আসার সময় শহরের শ্রী অঙ্গনের সাতজন হিন্দু সম্প্রদায়ের সাধুকে হত্যা করেন তারা। পরে সার্কিট হাউসসহ শেখ জামাল স্টেডিয়ামের পাশে ঘাটি গাড়ে তারা। সেখানে ধরে নিয়ে মানুষজনকে টর্চারিং করা হতো এবং হত্যা করে মধুখালীর কামারখালীতে ফেলে দেওয়া হতো। অতঃপর ১৭ই ডিসেম্বর শহরের ময়েজ মঞ্জিলে নূর মোহাম্মদ ক্যাপ্টেন বাবুল ও বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহ মো. আবু জাফরসহ মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন হানাদার বাহিনী। ১৬ই ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলেও ফরিদপুর স্বাধীন হয় একদিন পরে অর্থাৎ ১৭ই ডিসেম্বর।

৯ নম্বর সাবসেক্টরের (বৃহত্তর ফরিদপুর অঞ্চল) যুদ্ধকালীন কমান্ডার নূর মোহাম্মদ ক্যাপ্টেন বাবুল বাংলানিউজকে বলেন, আমরা স্বাধীনতার পরে শহরের শেখ জামাল স্টেডিয়ামের পাশে মাটি খুঁড়ে নারীদের শাড়ি, পেটিকোট, ব্লাউজ, সিঁদুরের কৌটা, চুড়ি, শাঁখা ও হাড়গোড় পাই। পরে সেখানে নিজ উদ্যোগে ‘গণকবর’ লেখা সম্বলিত একটি নাম ফলক স্থাপন করি।

এ ব্যাপারে জানতে কথা হলে ফরিদপুর জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল ফয়েজ শাহনেওয়াজ বলেন, শেখ জামাল স্টেডিয়াম এলাকা তখন পাকিস্তানি বাহিনীর কব্জার মধ্যে ছিল। সেখানে লোকদের বৃহত্তর ফরিদপুরের বিভিন্ন এলাকা থেকে ধরে নিয়ে এসে নির্যাতন করতেন তারা। এখন যেখানে গণকবর দৃশ্যমান, তখন সেখানে একটি পুকুর ছিল। এটা একটি বদ্ধভূমি হিসেবে পরিচিত ছিল। তাই ফরিদপুরের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মানুষদের পক্ষ থেকে সেখানে একটি গণকবর স্থাপনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। আমরা কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা একত্রে বসে ঠিক করি সেখানে একটি গণকবর করা হবে। পরে সেখানে ২০২৩ সালে ৭১-এর গণকবর ও ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়। যার নকশা ও পরিকল্পনা করেন ভাস্কর এজাজ-এ-কবীর। ভাস্কর্যটি নির্মাণে অর্থায়ন করেন ফরিদপুর জেলা পরিষদ।

ফরিদপুর জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. কামরুল আহসান তালুকদার বলেন, শেখ জামাল স্টেডিয়ামের পাশে যে গণকবরটি নির্মাণ করা হয়েছে। এর আগে শহীদের স্মৃতির উদ্দেশ্য শ্রদ্ধা নিবেদন করার মতো ফরিদপুরে তেমন ভালো ভাস্কর্য ছিল না। পরে জেলা পরিষদ অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন একটি স্থাপনা নির্মাণ করে। এখন প্রত্যেকটি দিবসে সেখানে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের শ্রদ্ধা জানাতে জেলার সব বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ রাজনৈতিক, জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে গণকবরে পুষ্পস্তবক অর্পণ করি।  

এটা ফরিদপুরবাসীর জন্য অত্যন্ত আবেগের একটি জায়গা তৈরি হয়েছে। আশা করছি এ গণকবরটি নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের শহীদ ও যাদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে তাদের স্মৃতি নতুন প্রজন্মের কাছে ধারণ করার জন্য এ স্মৃতিস্তম্ভটি কাজ করবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৭১৮ ঘণ্টা, মার্চ ২৫, ২০২৫
এসএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।