লক্ষ্মীপুর: ঘরে যেতে মন চায় না। তাই রাতের বেলাতেও রাস্তার পাশে বসে আছি।
লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলার চরআলগী ইউনিয়নের চর নেয়ামত গ্রামের বন্যাকবলিত কয়েকজন নারী-পুরুষ দীর্ঘ ভোগান্তির চিত্র তুলে ধরে বাংলানিউজের কাছে এমন দুঃখ-দুর্দশার কথা বলেন।
রোববার (০১ সেপ্টেম্বর) রাতে কথা হয় বেড়িবাঁধের ওপরে বসে থাকা কয়েকজন নারী-পুরুষের সঙ্গে। এসময় দেখা যায় বেড়িবাঁধের পাশে কিছুদূর পর পর কয়েকজন নারী-পুরুষ দলবদ্ধ হয়ে বসে আছে। চোখের সামনেই তাদের বসতঘর। সে ঘরে পানি আর পানি। বন্যা তাদের দুর্দশাগ্রস্ত করে তুলেছে। পানির ভয়ে তারা ঘরে ঢুকছেন না।
লক্ষ্মীপুরের কমলনগরের তোরাবগঞ্জ থেকে ফজুমিয়ার হাট হয়ে রামগতির চর গাজী পর্যন্ত যে বেড়িবাঁধটি আছে, ওই বেড়িবাঁধের কমলনগর চরকাদিরা ইউনিয়নের পূর্ব অংশ এবং রামগতি উপজেলার বেড়িবাঁধের অংশের পাশ ও উত্তর পাশ ভয়াবহ বন্যাকবলিত। বাঁধের একপাশে যে ভুলুয়া খালটি আছে, সেটির পানি রামগতির আজাদনগর স্টিল ব্রিজ হয়ে চরগাজী ইউনিয়নের ব্রিজঘাট হয়ে সরাসরি মেঘনা নদীতে গিয়ে পড়ে। কিন্তু ভুলুয়ার পানি প্রবাহ বন্ধ থাকায় খালের দুই পাশের বাসিন্দারা ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছেন। বিশেষ করে কমলনগরের চরকাদিরা ইউনিয়নের একাংশের পাশাপাশি রামগতি উপজেলার চর আলগী ইউনিয়নের চর নেয়ামত গ্রাম, চর বাদাম ইউনিয়নের পূর্ব চরসীতা এবং চর পোড়াগাছা ইউনিয়নের বেশিরভাগ এলাকা এখনো পানির নিচে তলিয়ে আছে।
ফলে বন্যাকবলিত খালপাড়ের এসব বাসিন্দারা চরম দুঃখ দুর্দশার মধ্যে দিনাতিপাত করছেন। কারো ঘরে এক মাসের বেশি সময় ধরেও পানি রয়েছে। কেউ দুই সপ্তাহ বা তিন সপ্তাহ ধরে পানিবন্দি। রামগতির স্টিল ব্রিজ সংলগ্ন আশপাশের খালটি বেদখল হয়ে সংকুচিত হয়ে পড়েছে। কোথাও আবার পলি জমে খালের গভীরতা কমে গেছে। ফলে পানি এখন আর স্বাভাবিক গতিতে নামছে না।
খালের দুইপাড়ে পানিবন্দি এসব বাসিন্দা, যাদের বসতঘর একেবারে বেড়িবাঁধের পাশে তাদের অনেকেই আশ্রয় কেন্দ্রে ওঠেননি, বা উঠার সুযোগ হয়নি।
রাতে বেলা পানিতে নিমজ্জিত বসতঘরের দিকে তাকিয়ে বেড়িবাঁধের ওপর বসে থাকা চর আলগী ইউনিয়নের চর নেয়ামত এলাকায় বাসিন্দা শাহিনুর বেগম বাংলানিউজকে বলেন, খাটের ওপর চুলা রেখে রান্না করি। সবকিছু খাটের ওপর। খাট থেকে পা ফেললেই পানি। পানিতে নানা রকম জীবাণু সৃষ্টি হয়েছে। পথেঘাটে শামুক ভাঙা। তাতে পা কাটা গেছে। এখন এই পা পানিতে ভেজাতে মন চায় না।
তিনি বলেন, দিনে এবং রাতের বেশিরভাগ সময় বেড়িবাঁধের ওপর বসে থাকি। দিনের বেলা শুধু রান্না আর খাবারের সময় ঘরে যেতে হয়। রাত ১১টা কিংবা ১২টা পর্যন্ত বাড়ির লোকজন দলবদ্ধ হয়ে বাঁধের ওপর বসে থাকি। ঘুমানোর সময় হলে ঘরে যাই। পানিতে পা ফেলতে মান চায় না। খুবই কষ্ট করে চলতে হচ্ছে।
এই নারী জানান, তাদের কারো ঘরে প্রায় এক মাস, আবার কারো ঘরে ২০ দিনের বেশি সময় ধরে পানি আছে।
শাহনাজ বেগম নামে এক নারী বলেন, ঘরের বেড়া (টিন) নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ভিটির মাটি সরে যাচ্ছে। সিমেন্টের খুঁটির নিচ ফাঁকা হয়ে গেছে। এতোদিন ধরে পানি, তাই ঘরটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে।
শাহনাজের সঙ্গে বেড়িবাঁধের ওপর বসে থাকা বন্যার্ত বাসিন্দা আমেনা বেগম, আকলিমা বেগম, কহিনুর ও মো. আজাদ উদ্দিনের বাস্তবতার গল্প একই। এদের ঘরেও দীর্ঘদিন ধরে পানি। কেউ ঠিকমতো ঘরে বসবাস করতে না পেরে বেড়িবাঁধের ওপর বসে আছেন। আশ্রয়কেন্দ্রে জায়গা না থাকায় সেখানেও যাননি। আবার কারো গবাদি পশু আছে, তাই তারাও পশু রেখে যেতে পারেননি৷ পানিতে তলিয়ে থাকা ঘরে তাদের জন্য বসবাস করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে।
সালেহা বেগম নামে অপর এক নারী বলেন, যাদের ঘর থেকে পানি নেমেছে, তাদের ঘরের ক্ষতচিহ্ন ভেসে উঠেছে। ঘরের ভিটি এবং বেড়া সংস্কার ছাড়া বসবাসও সম্ভব নয়। মোরামের জন্য যে টাকা প্রয়োজন, সেটাও নেই। বন্যার কারণে আয় রোজগার তো এখন বন্ধ। রাস্তার পাশে থাকার কারণে কিছু ত্রাণ পাই, তা দিয়ে কোনো মতে চলে।
এদিকে বন্যার্ত এসব পরিবারের শিশু সন্তানদের নিয়েও ঝুঁকিতে আছে তাদের মায়েরা। তাদের একজন আকলিমা বেগম। তার চার বছরের ছেলেকে নিয়ে ঝুঁকিতে আছেন তিনি।
বলেন, আমার স্বামী নেই। বাচ্চাকে রেখে তার বাবা চলে গেছে। এখন বাচ্চাকে নিয়ে বেড়িবাঁধের ঢালে থাকি। আমার বসতঘরে পানি। বাচ্চাকে নিয়ে সবসময় খাটের ওপর থাকতে হয়। কিন্তু খাটের ওপর থেকে একবার সে পানিতে পড়ে গেছে, অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছে আমার ছেলেটি। ছেলেকে নিয়ে এখন বেশিরভাগ সময় বেড়িবাঁধের ওপর থাকি। শুধু ঘুমানোর সময় ঘরে যাই। কিন্তু তাতেও ঝুঁকি। ঘুমের মধ্যে খাট থেকে পানিতে পড়ে যাওয়ার ভয় আছে।
বন্যার্ত বাসিন্দা আজাদ উদ্দিন বলেন, এতোদিন ধরে পানিবন্দি হয়ে আছি। পানি একেবারে ধীরগতিতে নামছে। ফলে পানির উচ্চতা তেমন একটা কমছে না। ঘরের পানি নামছেই না। ভুলুয়া খালের বিভিন্ন জায়গায় অবৈধ বাঁধ দিয়ে মাছ শিকার করতো। কোথাও আবার দুই পাড় দখল হয়ে আছে। গভীরতা কমে গেছে। তাই বন্যার পানি এবং বৃষ্টির পানি ঠিকমতো মেঘনা নদীতে প্রবাহিত হচ্ছে না৷ এ মুহূর্তে এমন সংকট থেকে মুক্তির কোনো পথও দেখছি না।
এ ব্যক্তি ভুলুয়া খালের দক্ষিণ পাশ দেখিয়ে বলেন, এ পাশে কোনো পানি নেই। আমনের চারা রোপণের জন্য যে পরিমাণ পানি দরকার পড়ে, কোনো কোনো ক্ষেতে সেটুকুও নেই। কিন্তু আমাদের উত্তর পাশে দেখেন, পানি আর পানি। এ পানিতে ডুবে-চুবে মরছি।
ভবিষ্যত পরিকল্পনায় শুষ্ক মৌসুমে খাল খনন ও অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করার দাবি জানান খালপাড়ে বসবাসরত বাসিন্দারা।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৫৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৩, ২০২৪
আরএ