ঢাকা, শনিবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

মিরপুরের ৬০ ফিট: লেগুনা-অটোরিকশার রাজত্বে যেন সাক্ষাৎ মৃত্যুকূপ

মিরাজ মাহবুব ইফতি, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২০০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২, ২০২৪
মিরপুরের ৬০ ফিট: লেগুনা-অটোরিকশার রাজত্বে যেন সাক্ষাৎ মৃত্যুকূপ

ঢাকা: আগারগাঁও ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হসপিটালের সামনে থেকে শুরু করে মিরপুর-২ নম্বর পর্যন্ত সড়কটির নাম ‘কামাল সরণি’। কিন্তু লোকে চেনে ‘৬০ ফিট’ নামে।

আওয়ামী লীগের আমলে এ সড়কের উদ্বোধন হয়। মিরপুরের সঙ্গে মহাখালী-তেজগাঁওয়ের সহজ যোগাযোগ সৃষ্টিতে নির্মিত সড়কটির প্রস্থ ৬০ ফুট। এর মধ্যে দুই পাশে পাঁচ ফুট করে ১০ ফুট প্রশস্ত ফুটপাত থাকার কথা। কিন্তু তা কখনোই দেখা যায়নি।

উদ্বোধনের পর থেকে সড়কটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে মিরপুর-১, ২, ১০ নম্বর এলাকার বাসিন্দাদের কাছে। পরিণত হয় রাজধানীর অন্যতম ব্যস্ত সড়ক হিসেবে। এ রাস্তায় বাস চলে না, কিন্তু দৌরাত্ম্য রয়েছে লেগুনা, অটো রিকশা, পায়ে টানা রিকশার। বর্তমান পরিস্থিতি এমন, যেকোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

ছবি: জিএম মুজিবুরসড়কের এ মাথা থেকে ও মাথা দিয়ে চলাচলকারী প্রায় প্রতিটি যাত্রী-পথচারীর অভিযোগ, ৬০ ফিটের পরিস্থিতি এখন ‘বুড়োর হাতে পাটকাঠির লাঠি’। নিজেও মৃত প্রায়; মানুষেরও প্রাণহানির কারণ হয়ে উঠছে।

এ সড়কে সবচেয়ে বেশি যেটি দেখা যায়, সেটি লেগুনা ও সেটির চালক-হেলপারের দৌরাত্ম্য। যখন যেখানে ইচ্ছা, সেখানে থামিয়ে যাত্রী তোলা হচ্ছে। আশপাশের কোনো বাহনকে সাইড না দিয়ে রাস্তার মাঝে দুম করে দাঁড়িয়ে যাত্রী নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে।   চালকের আসনের পাশে একজন ও পেছনে যাত্রীদের সিট প্রতি পাঁচজন করে নেওয়ার কথা থাকলেও হেলপাররা নেন ছয়জন করে। আবার পেছনে হেলপারের দাঁড়ানোর জায়গায় ঝোলেন অন্তত চারজন!

অটো রিকশাগুলোরও কোনো হাল নেই, যে যার মতো রাস্তার চার ভাগের দুই ভাগ দখল করে দাঁড়িয়ে থাকে। যাত্রী পেলে তোলে, আবার নামিয়ে দেয়। কোনো যাত্রী না পেলে প্যাডেল চালিত রিকশা চালকদের সঙ্গে ঝগড়া করে।

এই সড়কের মূল সমস্যা লেগুনা ও অটো রিকশা। সবগুলো লেগুনার আবার বৈধতা নেই। চালকদের লাইসেন্স নেই। ১০ থেকে ১৫ বছরের শিশুরাও এসব লেগুনা চালাতে পারে। সরকারের তৈরি রাস্তা দখল করে মিরপুর-২ নম্বর অংশে লেগুনা স্ট্যান্ড করা হয়েছে। যার দখল ছিল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের হাতে। আর এখন ওই স্থানটিতে সবাই যে যার মতো রাজা। স্ট্যান্ডে চাঁদাবাজিও হয়, কিন্তু কে করে- কেউ জানে না।

ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হসপিটালের সামনে থেকে শুরু করে মিরপুর-২ নম্বর পর্যন্ত সড়কটির অবস্থা এত বেশি বেহাল, যা বর্ণনা করার মতো নয়। মিরপুর ২ থেকে শুরু করে আমতলা পর্যন্ত বিশাল বিশাল গর্ত, খানাখন্দ। আমতলা থেকে নিউরোসায়েন্সেস পর্যন্ত রাস্তার অবস্থা মন্দের ভালো। তারপরও যেসব গর্ত আছে, কায়দা মতো কোনো গাড়ি বা মানুষ পড়ে গেলে শরীরের হাড্ডি কয়েকটা ভাঙবে, তা নিশ্চিত বলা যায়। ভারী বৃষ্টিতে গর্ত, খানাখন্দগুলো ভরাট হয়ে যায়। ফলে বোঝা যায় না, রাস্তার কোন অংশটি ভালো। সম্প্রতি এক নারী বারেক মোল্লা মোড়ে দুর্ঘটনার শিকার হন। স্থানীয় কয়েকজন জানিয়েছেন, ভুক্তভোগীর নাক ও চোয়াল ভেঙে গেছে; তার সন্তানও বেশ আহত।

ছবি: জিএম মুজিবুর৬০ ফিটের এ সড়কে যানজট তৈরি হলে মানুষের জান হয়ে পড়ে ওষ্ঠাগত। যানজট হওয়ার মূল কারণ, লেগুনা ও অটোরিকশা। প্রচুর অটোরিকশা চলে এ সড়কে। ফলে সপ্তাহের পাঁচ কর্ম দিবসের সকাল, দুপুর ও রাতে যানজট সৃষ্টি হয়।

সংশ্লিষ্টতা বলছেন, ট্রাফিক নিয়ম না মানা, সড়ক দখল, সরু সড়ক ও কে কার আগে যাবে; এসব প্রতিযোগিতার কারণে প্রতিনিয়ত এ সড়কে যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। ৬০ ফিট সড়কের কিছু কিছু স্থান ৩০ ফিটে নেমে এসেছে।

সড়কের পাকা মসজিদ মোড়ে এলাকায় অটো রিকশা ও লেগুনার দাঁড়ানোর জায়গা নিয়ে দুই পক্ষে মাঝে মধ্যেই মারামারি হয়। এর মধ্যে আবার গর্তের কারণে দুই বাহনে চড়া মানুষরাও ভোগান্তিতে পড়েন। দক্ষিণ মনিপুর ও মোল্লাপাড়া মোড়ে সড়কের এক পাশ দখল করে থাকে মোটরসাইকেল। পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার জন্য ড্রেন তৈরি করা হবে বলে রাস্তা আবার খোঁড়াও হয়েছে। সংস্কার কাজের কাঁচামাল ইট বালু ও বিভিন্ন যন্ত্রপাতিও রাখা হচ্ছে সড়কের ওপরে।

বারেক মোল্লা মোড়, পশ্চিম মনিপুর ও মধ্য মনিপুর এলাকা জুড়ে খোঁড়াখুঁড়ি করা হয়েছে। পায়ে হেঁটেও ফুটপাত দিয়ে যাতায়াত করারও কোনো পরিবেশ নেই। কেননা, এসব স্থান দখল করে আছে মোটরসাইকেল সরাইখানাওয়ালারা। ফলে পথচারীদের বাধ্য হয়ে মূল সড়ক ধরে হাঁটতে হয়। মধ্য মনিপুর এলাকায় সড়কে রাখা হয়েছে খোঁড়ার কাজে ব্যবহৃত ট্রাক্টর। এখানেও সড়ক সংকুচিত হয়ে গেছে, তাই লেগুনা ও অটো রিকশা থামলেই যানজট বাধে।

মোল্লাপাড়া এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা আফজাল হোসেন বলেন, ৬০ ফিট সড়কে অটো বা ব্যাটারি রিকশা, লেগুনা, খোঁড়াখুঁড়ি ও রাস্তা দখল করে বিভিন্ন ধরনের দোকান ও মোটরসাইকেল সরাইখানার জন্য যানজট সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে অটো বা ব্যাটারিচালিত রিকশা চালকরা গতির কারণে নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে না, এতে প্রায়ই ঘটছে ছোট-বড় দুর্ঘটনা। এলাকাবাসী থেকে শুরু করে পথচারীদের প্রতিনিয়তই দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে রাস্তার বড় বড় গর্তের কারণে। কেননা, রাস্তা তৈরির পর কখনোই মেরামত বা সংস্কার করা হয়নি। যদি প্রশাসন, সরকার এই সড়কটির দিকে নজর দিতো- এত সমস্যায় পড়তে হতো না।

তিনি আরও বলেন, সপ্তাহের ৫ কর্ম-দিবসের সকাল থেকে শুরু করে রাত পর্যন্ত এই সড়কে যানজট লেকে থাকা এখন স্বাভাবিক। এ যেন আরেক পুরান ঢাকা। সড়ক সংস্কার করার ‘রা’ তুলে কাজ ধরা হলেও কোনো কিছুই হচ্ছে না। খানাখন্দে ভরা ৬০ ফিট এখন ত্রিশ ফিটে পরিণত হয়েছে। ৩০ ফিট সড়ক।

মিরপুর ২ নম্বর এলাকায় মা ও শিশু হাসপাতাল, হার্ট ফাউন্ডেশনসহ বেশ কয়েকটি স্বাস্থ্যসেবা দানকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। আগারগাঁওয়ের দিকে যেতে রয়েছে নিউরোসায়েন্সেস। এসব হাসপাতালে রোগী আনা নেওয়াও এখন দুঃস্বপ্ন। নাফিজ নামে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এক বিক্রয় কর্মী বলেন, রাস্তার অবস্থা এমন আমরা কোনো রোগী নিয়ে যেতে পারি না। একদিন অ্যাম্বুলেন্সেই রোগী মারা গেছেন। নিজের আত্মীয়কে নিয়ে সঠিক সময়ে হাসপাতালে পৌঁছতে পারিনি। এমন বাজে অবস্থার মধ্যে এই সড়কে চলাচল করতে হয় আমাদের।

মো. মালেক, বড় বাগ এলাকার এক-চা দোকানি মালিক। রাত দিন তিনি এই সড়কের অবক্ষয় দেখেছেন। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, এইহানে যহন তহন জাম (যানজট) লাগতে পারে। সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা, রাইত জাম আটকাইন্না মুশকিল। লেগুনা আর ব্যাটারি রিকশার কারণে বেশি জাম লাগে। কেউ কোনো কিছু কইরা জাম কমাইতারে না। এলাকার পোলাপান মাঝে-মইধ্যে রাস্তায় নাইমা কতক্ষণ খাড়াইতো, অহন ওরাও ঝিম ধইরা গেসে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এলাকার এক রাজনৈতিক বাংলানিউজকে বলেন, ৬০ ফিট সড়ক দিয়ে চলাচলকারী কোনো যানবাহন নিয়ম-কানুন মানতে চায় না। তাদের একটাই চেষ্টা- কে কার আগে যাবে। এ সড়কে পায়ে হাঁটার কোনো ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। ড্রেন তৈরির জন্য দেড় মাস আগে কিছু অংশ খোঁড়া হয়েছে। সেটির কাজও এখন বন্ধ। সংস্কার কাজের জন্য আনা ইট,বালু, সিমেন্ট ও বিভিন্ন সরঞ্জাম সড়কে ফেলে রাখা হয়েছে। পথচারীরা স্বাভাবিকভাবে চলাচল করতে পারে না। বাধ্য হয়ে সড়কের মাঝখান দিয়ে হাঁটতে হয়। দুর্ঘটনাও ঘটে। পতিত সরকারের আমলে তৈরি এ সড়ক তাদের মতোই খোকলা। আমরা বলে কয়ে অনেক চেষ্টা করেছি সড়ক সংস্কারের। কিন্তু কিছুই হয়নি।

মিরপুর-২ নম্বর বড় বাগ এলাকায় ট্রাফিক কন্ট্রোলিংয়ের ‘দায়িত্ব পালন করেন’ মো. খুরশিদ আলম নামে এক পুলিশ সদস্য। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত এ সড়কে যানজটের অনেকগুলো কারণ। এক. অটোরিকশা; দুই. বেপরোয়া লেগুনা; তিন. ব্যাটারি চালিত বা অটো রিকশা, লেগুনার হুটহাট যাত্রী তোলা-নামানো; চার. সড়কের বেশ কিছু জায়গা অনেক সরু; পাঁচ. ফুটপাত ও সড়ক দখল; ও ছয়. সংস্কারের নামে খোঁড়াখুঁড়ি। তবে সবচেয়ে বড় কারণ, মিরপুর-২ নম্বর থেকে  ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হসপিটালের সামনে পর্যন্ত অসংখ্য গর্ত, খানাখন্দ। এসবের কারণে দুর্ঘটনা হয়। ৬০ ফিট সাক্ষাৎ মৃত্যুকূপ।

৬০ ফিট সড়কের বেহাল দশা, গর্ত-খানাখন্দ সংস্কারের ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা উওর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর খায়রুল আলম প্রথমে এ ব্যাপারে কথা বলতে চাননি। পরে আবার যোগাযোগ করা হলে তিনি ডিএনসিসির জনসংযোগ কর্মকর্তার বরাত দিয়ে বাংলানিউজকে বলেন, মিরপুরের মনিপুর, ৬০ ফিট, পীরেরবাগ এলাকায় অনেকগুলো শাখা রোডের উন্নয়ন কাজ চলমান। আগস্ট মাসে ঠিকাদাররা নিরবিচ্ছিন্নভাবে কাজ চালাতে পারেনি। সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের প্রকৌশল বিভাগ থেকে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজের গতি বাড়িয়ে নির্দিষ্ট মেয়াদের মধ্যে কাজ সম্পন্ন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, মেয়াদ অনুযায়ী অক্টোবর ও নভেম্বরের মধ্যে এই এলাকার শাখা রাস্তাগুলোর কাজ শেষ হবে। ৬০ ফিট থেকে মিরপুর প্রধান সড়কের কাজটি মেয়াদ অনুযায়ী ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হবে। নির্দিষ্ট মেয়াদে কাজ শেষ না করতে পারলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এ সড়কের শৃঙ্খলার বিষয়ে ট্রাফিক মিরপুর ও তেজগাঁও বিভাগ উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) এ এফ এম তারিক হোসেন খান বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের আগে বুঝতে হবে প্রধান সড়কের প্রাধান্য আগে। প্রধান সড়কের শৃঙ্খলা ফিরে এলে শাখা সড়কগুলোয় আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করব। এছাড়াও আমাদের জনবল সংকট রয়েছে, এটাও বুঝতে হবে।

লেগুনা ও অটোরিকশার দৌরাত্ম্যের কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি ভেঙে ভেঙে কাজ করছি। আগে প্রধান সড়কে শৃঙ্খলা ফিরুক। একবারে সব নিয়ে কাজ করলে আমরাই (পুলিশ) সড়কে দাঁড়াতে পারবো না। প্রতিটা স্থানে একসঙ্গে কাজ ধরলে না পারবো শেষ করতে, না পারবো নতুন করে শুরু করতে। পরিবহন সেক্টরটাই বেপরোয়া। মালিক থেকে শুরু করে শ্রমিকরা সবাই বেপরোয়া। পর্যায়ক্রমে সকল সড়কেই শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১২০০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২, ২০২৪
এমএমআই/এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।