ঢাকা, মঙ্গলবার, ২০ কার্তিক ১৪৩১, ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

সাতক্ষীরা-শ্যামনগর সড়কের বেহাল দশা, দুর্ভোগে ১৫ লাখ মানুষ  

শেখ তানজির আহমেদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩১০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৮, ২০২৪
সাতক্ষীরা-শ্যামনগর সড়কের বেহাল দশা, দুর্ভোগে ১৫ লাখ মানুষ  

সাতক্ষীরা: দীর্ঘ প্রায় এক যুগ সংস্কারের অভাবে চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে সাতক্ষীরা-শ্যামনগর সড়ক। এতে চলাচলে সীমাহীন দুর্ভোগে পড়ছেন জেলার চারটি উপজেলার অন্তত ১৫ লাখ মানুষ।

এ সড়কের সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ থেকে শ্যামনগর বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত পিচ ও পাথর উঠে গিয়ে এবড়ো থেবড়ো হয়ে গেছে।  

সড়কটির অবস্থা এতোটাই খারাপ যে তা দিয়ে চলাচল করলে সুস্থ মানুষও অসুস্থ হয়ে পড়েন। সেই সঙ্গে ধীরে ধীরে স্থবির হয়ে পড়ছে পণ্য পরিবহন। সড়কের দুরাবস্থার কারণে পর্যটক কমছে সুন্দরবনে।

সড়কটির উন্নয়নে দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন সরকার গৃহীত দুটি প্রকল্প একনেকে পাস হলেও বর্তমানে তার কোনো অগ্রগতি নেই। ফলে হতাশ হয়ে পড়েছেন সাতক্ষীরাবাসী। এ বিষয়ে বর্তমান সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন তারা।

সাতক্ষীরা-শ্যামনগর সড়কের ১৬টি স্থানে ইটের সোলিং
এক যুগ হলো সাতক্ষীরা-শ্যামনগর সড়ক উন্নয়নে দৃশ্যমান কোনো প্রকল্প গৃহীত হয়নি। এতে সড়কটিতে বড় বড় গর্ত সৃষ্টি হয়। অনেক স্থানে সড়কটি চলাচলের একেবারেই অযোগ্য হয়ে পড়ে। ভেঙে পড়ার উপক্রম হয় যোগাযোগ ব্যবস্থা। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় উপজেলা শ্যামনগরের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ অক্ষুণ্ন রাখতে সড়ক ও জনপথ বিভাগ বাধ্য হয়ে এক বিরল উদ্যোগ নেয়। এ উদ্যোগের আওতায় সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ, আলিপুর বাজার, আলিপুর শ্মশান, কুলিয়াসহ সড়কটির অন্তত ১৬টি স্পট চিহ্নিত করে পাকা রাস্তার ওপর নির্মাণ করা হয় ইটের হেরিং বন্ড। যা নিয়ে রীতিমত হাস্যরসের সৃষ্টি হয় জেলাজুড়ে।

এ প্রসঙ্গে দেবহাটার সখিপুরের আজিজুর রহমান বলেন, বাংলাদেশের কোথাও এমন বিরল ঘটনা ঘটেছে কি না আমার জানা নেই যে ‘পাকা রাস্তার ওপর ইটের সোলিং’। বিষয়টি খুবই লজ্জার। রাস্তাটির অবস্থা বর্ণনার জন্য আর বিশেষ কিছু বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে করছি না। রাজনৈতিক নেতৃত্বের সংকটের কারণেই সড়কটির এ দুরবস্থা।

ধুলায় অতিষ্ঠ মানুষ
সাতক্ষীরা-শ্যামনগর সড়কের অধিকাংশ স্থানে পিচ পাথর উঠে গিয়ে ধুলো বালিতে ভরে উঠেছে। এতে বাস-ট্রাকসহ অন্যান্য যানবাহন চলাচলের সময় ধুলায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে গোটা এলাকা। আশপাশের অনেকে দোকান-পাট টিকিয়ে রাখতে বাধ্য হয়ে রাস্তায় দুই বেলা পানি ছিটান। তাতেও যেন দুর্ভোগ কমে না।

এ প্রসঙ্গে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ মোড়ের এক ফুচকা ব্যবসায়ী বলেন, চারদিকে ধুলা আর ধুলা। গাড়ি একটা গেলেই হয়, ধুলায় যেন দম আটকে যায়। তাহলে খাবার দাবারের কি অবস্থা হয় চিন্তা করুন? ধুলার কারণে আস্তে আস্তে কাস্টমার কমে যাচ্ছে। বসতেই পারে না, খাবে কি করে?

পর্যটক কমছে সুন্দরবনে
সাতক্ষীরা জেলা ব্র্যান্ডিংয়ের স্লোগান ‘সাতক্ষীরার আকর্ষণ, সড়কপথে সুন্দরবন’। কিন্তু সাতক্ষীরা-শ্যামনগর সড়কের বেহাল দশার কারণে জেলা ব্র্যান্ডিংয়ের এ স্লোগান ভুলতে বসেছেন মানুষ। কারণ সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা অত্যন্ত নাজুক হওয়ায় সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জে আসতে উৎসাহ হারাচ্ছেন পর্যটক। এতে মারাত্মক প্রভাব পড়ছে সুন্দরবন কেন্দ্রিক পর্যটনের ওপর নির্ভরশীল জনতার জীবন-জীবিকায়।

এ প্রসঙ্গে শ্যামনগরের উন্নয়ন কর্মী স ম ওসমান গনী সোহাগ বলেন, সাতক্ষীরাই বাংলাদেশের একমাত্র জেলা, যেখানে সড়কপথে সুন্দরবন উপভোগ করা সম্ভব। কিন্তু সাতক্ষীরা-শ্যামনগর সড়কের যে নাজুক ও জরাজীর্ণ অবস্থা, তাতে এখানে আর পর্যটকরা আসতে চান না।

তিনি বলেন, ঢাকা থেকে সাতক্ষীরা শহরে আসতে সময় লাগে সাড়ে চার ঘণ্টা থেকে পাঁচ ঘণ্টা। আর সাতক্ষীরা থেকে শ্যামনগরের মুন্সীগঞ্জ আসতে সময় লাগে চার ঘণ্টা। তারপরও মানুষ আসতে গেলে অসুস্থ হয়ে পড়েন। সড়কটি দ্রুত সংস্কার করা দরকার।

যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের উষ্মা
সম্প্রতি সাতক্ষীরা সফর করেছেন যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া। সফরকালে তিনি সড়কপথে সাতক্ষীরা থেকে শ্যামনগরের যশোরেশ্বরী কালী মন্দিরে যান। মন্দির পরিদর্শন শেষে সাতক্ষীরায় ফিরে ১৩ অক্টোবর সন্ধ্যায় সার্কিট হাউজে স্থানীয় সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে উষ্মা প্রকাশ করে যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ বলেন, গত ১৫ বছর ধরে উন্নয়ন গেলানো হয়েছে, যেটা খুব নির্দিষ্ট কিছু জায়গায়। যেমন গোপালগঞ্জ উন্নত হয়েছে কিন্তু তার আশপাশের জেলাগুলোর অবস্থা খুবই খারাপ।

তিনি সাতক্ষীরা-শ্যামনগর সড়কের কথা উল্লেখ করে বলেন, এখানকার রাস্তাগুলো আমি দেখেছি। অবস্থা খুবই খারাপ এবং এটার উন্নয়ন প্রয়োজন।

এসময় তিনি সড়ক উপদেষ্টার সঙ্গে কথা বলে দ্রুত রাস্তাটির উন্নয়নে পদক্ষেপ নেওয়ার আশ্বাস দেন।

চরম দুর্ভোগে সাতক্ষীরার ১৫ লাখ মানুষ
সাতটি উপজেলা নিয়ে গঠিত সাতক্ষীরা জেলার চারটি উপজেলার মানুষ সরাসরি সাতক্ষীরা-শ্যামনগর সড়ক দিয়ে যাতায়াত করেন। এগুলো হলো শ্যামনগর, কালিগঞ্জ, দেবহাটা ও সাতক্ষীরা সদর। এছাড়া আশাশুনি উপজেলার একাংশের মানুষের যাতায়াতের রাস্তা এটি। সড়কটি চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ায় চলাচলে মারাত্মক ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন জেলার অন্তত ১৫ লাখ মানুষ।

কালিগঞ্জের মাসুদ পারভেজ ক্যাপ্টেন বলেন, সাতক্ষীরা-শ্যামনগর সড়কের এমনই ভয়াবহ অবস্থা যে কোনো অন্তঃসত্ত্বা নারীকে চিকিৎসার জন্য সাতক্ষীরা শহরে নেওয়ার প্রয়োজন হলে রাস্তাতেই ডেলিভারি হওয়ার শঙ্কা দেখা দেয়।

এছাড়া সাতক্ষীরায় উৎপাদিত মাছ, কাঁকড়াসহ অন্যান্য পণ্য জেলার বাইরে পাঠাতে বা কোনো কিছু বাইরের জেলা থেকে আনতে চাইলে ট্রাক চালকরা শ্যামনগর সড়কের কথা শুনলে আসতে বা যেতে চান না।

সাতক্ষীরা-কালিগঞ্জ ও কালিগঞ্জ-ভেটখালী মহাসড়ক উন্নয়ন প্রকল্প স্থবির
সাতক্ষীরা-শ্যামনগর সড়ক উন্নয়নে বিগত সরকার সাতক্ষীরা-কালিগঞ্জ ও কালিগঞ্জ-ভেটখালী মহাসড়ক উন্নয়ন প্রকল্প নামে দুটি প্রকল্প নেয়। প্রকল্প দুটি ২০২৩ সালের ৯ নভেম্বর একনেকে পাস হয়। এরপর প্রকল্প দুটির কাজ শুরুর লক্ষ্যে সড়ক ও জনপথ বিভাগ সড়কের দুপাশের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে অভিযান শুরু করে। যা চলে প্রায় এক সপ্তাহ। এরপর অদৃশ্য কারণে বন্ধ হয়ে যায় উচ্ছেদ অভিযানসহ প্রকল্প সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কার্যক্রম। সেই থেকে অদ্যাবধি প্রকল্প দুটি বাস্তবায়নে দৃশ্যমান কোনো কার্যক্রম দেখা যায়নি।

এ প্রসঙ্গে সাতক্ষীরা সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আনোয়ার পারভেজ বলেন, সাতক্ষীরা থেকে কালিগঞ্জ পর্যন্ত ৩৫ কিলোমিটার চারলেন ও কালিগঞ্জ থেকে ভেটখালী পর্যন্ত ২৭ কিলোমিটার ২৪ ফুট প্রস্থ রেখে ২০২৩ সালে একটি প্রকল্পের খসড় মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। ৮২২ কোটি টাকা ব্যয় দেখিয়ে প্রকল্পের টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছে। গত দুই মাস মন্ত্রণালয়ে এ কাজের দরপত্রগুলো অনুমোদনের জন্য রয়েছে। দ্রুত যদি অনুমোদন না হয় আর ঠিকাদার না আসে, তবে আমাদের পক্ষে এ সড়ক আর মেরামত করে রাখা সম্ভব হবে না।  

বাংলাদেশ সময়: ১৩০৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৮, ২০২৪
এসআই


 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।