ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ পৌষ ১৪৩১, ০৯ জানুয়ারি ২০২৫, ০৮ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

এক মাসের মাস্টারপ্ল্যানে নন্দন পার্ক ‘দখল’ করেন আ.লীগ নেতা 

অতিথি করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬২৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৮, ২০২৫
এক মাসের মাস্টারপ্ল্যানে নন্দন পার্ক ‘দখল’ করেন আ.লীগ নেতা  ইনসেটে আওয়ামী লীগ নেতা সিরাজুল হক

সাভার (ঢাকা): সাভারের আশুলিয়ার বাড়ইপাড়ায় অবস্থিত থিম পার্ক খ্যাত বেসরকারি বিনোদন কেন্দ্র ‘নন্দন পার্ক’ দখলের চেষ্টার অভিযোগ উঠেছে আওয়ামী লীগ নেতা সিরাজুল হকের বিরুদ্ধে।  

সিরাজুল হক সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলার ২ নং পাটলী ইউনিয়নের বাসিন্দা।

তবে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পলায়ন ও আ.লীগ সরকারের পতনের পর নিজ এলাকা ছেড়ে সাভারের আশুলিয়ায় গা-ঢাকা দেন তিনি। আর আশুলিয়ায় অবস্থান নিয়ে ষড়যন্ত্র করে ও প্রশাসনে প্রভাব খাটিয়ে সরিয়ে দেন নন্দন পার্কের চেয়ারম্যানকে। পরে পুরো পার্ক কয়েকদিনের জন্য দখল করে নেন সিরাজুল।

অনুসন্ধানে জানা যায়, সুনিপুণ এক মাসের মাস্টারপ্ল্যানের মাধ্যমে নন্দন পার্কের চেয়ারম্যান বেলাল হককে সরিয়ে দেন সিরাজুল হক। নন্দন পার্কের নামমাত্র শেয়ার কিনে সিরাজুল হক আরও দুই শেয়ার হোল্ডারকে সঙ্গে নেন। তাদের মোট শেয়ার ১১ শতাংশেরও নিচে। তারাই প্ল্যান করে প্রথমে মামলা করেন বেলাল হকের নামে। সেই মামলায় ওয়ারেন্ট জারি করে জেলে পাঠানো হয় তাকে। পথের প্রতিবন্ধকতা সরে গেলে শতভাগ শেয়ার দখল করে পার্কটি নিজের নিয়ন্ত্রণে নেন সিরাজুল।  

যদিও নন্দন পার্কে সিরাজুলের আধিপত্য বেশি দিন টেকেনি। চেয়ারম্যান বেলাল জামিনে মুক্তি পাওয়ার কয়েক সপ্তাহ পরেই সিরাজুল হক দখল ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। কিন্তু ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের দখলদারিত্বের স্বভাব যায়নি সিরাজুলের। এখনও নানাভাবে পার্কটি দখলের চেষ্টা করে যাচ্ছেন এই আওয়ামী লীগ নেতা।

নন্দন পার্ক দখল করার কথা স্বীকারও করেছেন সিরাজুল হক। চেয়ারম্যান বেলালকে দুর্নীতিবাজ আখ্যা দিয়ে পার্কটি থেকে তাকে সরিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেই এই মাস্টার প্ল্যান করেছিলেন বলে জানান তিনি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আওয়ামী লীগ সরকারের সময় সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার ২ নং পাটলী ইউনিয়নের পর পর দুই বারের নির্বাচিত চেয়ারম্যান ছিলেন সিরাজুল হক। এছাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ছিলেন। উপজেলায় ছিল তার ব্যাপক প্রভাব। তার দাপটে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকও ছিলেন কোণঠাসা।

অনুসন্ধানে জানা যায়, চেয়ারম্যান থাকাকালীন ছাত্রশিবিরের দুই কর্মীকে আটকে রেখে ইফতার মাহফিলে হামলা চালান সিরাজুল হক, যা সেসময় রীতিমতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ভাইরাল হয়। এছাড়াও এলাকায় বিএনপি ও জামায়াত নেতাকর্মীদের মামলা-হামলাসহ নানাভাবে নির্যাতন করেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে সিরাজুলের বিরুদ্ধে।  

২নং পাটলী ইউনিয়নের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আঙ্গুর মিয়া বাংলানিউজকে বলেন, সিরাজুল হক উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ছিলেন। মানুষ হিসেবে সুবিধার ছিলেন না। শুধু আমি না, তার গ্রামের সব মানুষই তাকে খারাপ বলবে। আপনি চাইলে এলাকাবাসীর কাছে জিজ্ঞেস করুন। আমি বললে বলবেন, তার বদনাম করছি। তবে তিনি দীর্ঘদিন ধরে এলাকায় আসছেন না।

জানা গেছে, নিয়ম বহির্ভূতভাবে বিদেশে যাওয়ায় চেয়ারম্যান পদ থেকে বহিষ্কৃতও হয়েছিলেন সিরাজুল হক। গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর নিজ এলাকা ছেড়ে সাভারের আশুলিয়ায় গা-ঢাকা দেন তিনি। এরপরই নন্দন পার্ক দখলের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নন্দন পার্কের এক কর্মকর্তা বলেন, ২০০০ সালে ১৪ জন শেয়ার হোল্ডার নিয়ে নন্দন পার্কের কার্যক্রম শুরু হয়। বাণিজ্যিকভাবে কার্যক্রম শুরু হয় ২০০৩ সাল থেকে। তখন থেকে এ পর্যন্ত কোনো ঝামেলা ছিল না। তবে খুব একটা ব্যবসায়িক সফলও ছিল না। এখনও পার্কটি সফল হতে পারেনি। তবে বেলাল হক সাহেব পার্কটি ব্যবসাসফল করার চেষ্টা করছিলেন। এমন সময় সিরাজুল হক অবৈধভাবে পার্কের দখল নেন। অভিযান করান যৌথবাহিনী দিয়ে। এসব গণমাধ্যমে প্রচার হলে নন্দন পার্কে আর লোকজন আসছে না।

এ ব্যাপারে নন্দন পার্কের চেয়ারম্যান বেলাল হক বাংলানিউজকে বলেন, সিরাজুল হক ও তার সহকারী সেলিম মিয়া এবং এফ আই দেওয়ান ওই সময় কিছু অসাধু পুলিশ কর্মকর্তার সাহায্য নেন। এছাড়া স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক নেতাদের সাহায্যে আমার সঙ্গে এবং এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অমানবিক অন্যায় করেন তারা। অতীতেও এই তিনজন তৎকালীন গাজীপুরের এসপি হারুন অর রশিদ (ডিবি হারুন) এবং গাজীপুরের কালিয়াকৈর থানার ওসি রফিকের সাহায্যে আমাকে ওরা বিভিন্নভাবে হয়রানি ও অপদস্থ করেছে।

বর্তমানে পার্কটি দখলে সিরাজুল হকের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের বিষয়ে সাভার ও আশুলিয়া থানা পুলিশের বর্তমান কর্মকর্তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

তবে পার্কটি দখলে ডিবি হারুনের সম্পৃক্ততার ব্যাপারে সাভার সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার শাহীনুর কবির বাংলানিউজকে বলেন, সেরকম কোনো সম্পৃক্ততা পাইনি। সিনিয়র একজন পুলিশ কর্মকর্তার (ওসি রফিক) বিষয়ে যে কথাটা বলা হচ্ছে, জনশ্রুতি আছে যে তার সঙ্গে সম্পৃক্ততা রয়েছে। এটুকু জানতাম যে, সিরাজুল হকসহ অভিযুক্তদের সঙ্গে সখ্য আছে বা ছিল ওই পুলিশ কর্মকর্তার। ভবিষ্যতে আমরা আরও যাচাই-বাছাই করে দেখব আসলেই সম্পৃক্ত আছে বা ছিল কি না।

দখল অবস্থায় সিরাজুল ইসলামের সঙ্গে নন্দন পার্কেই একান্তে কথা বলেন বাংলানিউজের প্রতিনিধি। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, নন্দন পার্কের চেয়ারম্যানকে সরানো সহজ ছিল না। আমরা পার্কে প্রবেশ করতে পারতাম না। তিনি গ্রেপ্তারের পর আমরা পার্কে প্রবেশ করেছি। আর্থিকভাবে হোক এবং সামাজিকভাবে হোক সব দিক দিয়ে নন্দন পার্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অসামাজিক কার্যক্রম এখানে হয়েছে। এসব বিষয় মিনিমাইজ করে নন্দনকে আমরা দেশের স্বনামধন্য পারিবারিক বিনোদন কেন্দ্র করতে চেয়েছি।

সুনামগঞ্জে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন ও আওয়ামী রাজনীতির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এলাকায় আমার অনেক সুনাম ও জনপ্রিয়তা ছিল। যে কারণে উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি পদে আমাকে রাখা হয়েছিল। আমি আওয়ামী লীগ করলেও জামায়াতের সঙ্গেও তো আমার ব্যবসা রয়েছে।

উল্লেখ্য, গত বছরের ১৮ অক্টোবর মধ্যরাতে প্রতারণার দায়ে করা একটি মামলায় নন্দন পার্কের চেয়ারম্যান বেলাল হক গ্রেপ্তার হন। গ্রেপ্তারের পর একটি কালো ব্যাগের কথা আলোচনায় আসে। অভিযোগ, গ্রেপ্তারের আগে ব্যাগটি পার্কের ভেতরে রেখে আসেন বেলাল হক। ১৯ অক্টোবর নন্দন পার্কে অভিযান চালিয়ে ওই কালো ব্যাগ উদ্ধার করে যৌথবাহিনীর সদস্যরা। ব্যাগটি থেকে ২ লাখ ১৩ হাজার ৭০০ টাকা ও আই প্যাডসহ কাগজপত্র উদ্ধার করা হয়।  

সেসময় বেলাল হকের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ আনেন নন্দন পার্কের কয়েকজন কর্মচারী। ভয়ে মিথ্যা বক্তব্য দিয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন তারা।

মঙ্গলবার (৭ জানুয়ারি) নন্দন পার্কের এক কর্মচারী বাংলানিউজকে বলেন, আগে যা গণমাধ্যমে বলেছি তা আমার কথা ছিল না। তখন আন্দোলনের সময় যে নেতারা ছিল তারাই বলেছিল আমাদের মিডিয়ার সামনে এসব বলতে। এছাড়া সিরাজুল হক নিজেও আমাদের বলতে বলেছিলেন। আমরা কর্মচারী, ভয়ে চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে মিডিয়ায় বলেছিলাম।

অপর কর্মচারী বলেন, ওই সময় সাংবাদিকরা আমাদের কাছে জানতে চেয়েছিল যে নন্দন পার্কে কি হয়েছে। তখন কারো প্ররোচনায় ভুল করে বলে ফেলেছি যে পার্কে ইনক্রিমেন্ট, হাফ বেতন সমস্যা। আসলে তখন আমাদের বোঝার ভুল ছিল। আমরা তখন বুঝতে পারিনি। তাই ক্যামেরার সামনে শিখিয়ে দেওয়া কথা বলেছি। এর জন্য আমরা অনুতপ্ত, দুঃখিত।

চেয়ার‌ম্যান বেলাল হককে সরিয়ে নন্দন পার্ক দখলে নিতে মামলাসহ কর্মীদের দিয়ে মিথ্যা অভিযোগ তুলে মানববন্ধন করার নেপথ্যে ছিলেন সিরাজুল হক - এমন অভিযোগ তাদের।

বাংলাদেশ সময়: ১৬০৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৮, ২০২৪
এসএএইচ
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।