ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৮ ফাল্গুন ১৪৩১, ০৪ মার্চ ২০২৫, ০৩ রমজান ১৪৪৬

জাতীয়

বিদেশগামী ছেলেকে বিদায় দিতে এসে চিরবিদায় বাবার

আবাদুজ্জামান শিমুল, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৫২ ঘণ্টা, মার্চ ৩, ২০২৫
বিদেশগামী ছেলেকে বিদায় দিতে এসে চিরবিদায় বাবার

ঢাকা: ছেলে মুবিন জমাদ্দারের সৌদি আরবে যাওয়ার ফ্লাইট মঙ্গলবার (৪ মার্চ) সন্ধ্যায়। তাকে বিদায় দিতে সঙ্গে এসেছিলেন মিরন জমাদ্দার।

এসে উঠেছিলেন রাজধানীর গুলশান থানাধীন শাহজাদপুরে সৌদিয়া হোটেলে। আর ছেলে মুবিন ওঠেন হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছাকাছি একটি হোটেলে। কিন্তু ছেলেকে আর বিদেশযাত্রায় বিদায় দেওয়া হলো না মিরনের। সৌদিয়া হোটেলে অগ্নিকাণ্ডে তিনিই নিয়েছেন চিরবিদায়।

সোমবার (৩ মার্চ) দুপুরে আবাসিক হোটেলটিতে এ আগুনের ঘটনায় মুবিনের সঙ্গে প্রাণ ঝরেছে আরও তিনজনের। আগুনে সৃষ্ট ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়েই তাদের মৃত্যু হয়েছে বলে ধারণা পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও দুইজন। আহতদের দ্রুত উদ্ধার করে স্থানীয় হাসপাতালে পাঠানো হয়।

মিরন জমাদ্দারের (৬০) বাড়ি পিরোজপুর জেলায়। তার আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মুবিন জমাদ্দারের বিদেশযাত্রায় তাকে বিদায় দিতে মিরন ও তার ভগ্নিপতি হিরন তালুকদার সঙ্গে করে ঢাকায় আসেন। যানজটের ঝুঁকি এড়াতে মুবিন বিমানবন্দরের কাছাকাছি একটি হোটেলে ওঠেন। আর মিরন-হিরণ ওঠেন শাহজাদপুরের ওই হোটেলটিতে। সকাল ৮টায় হোটেলের চারতলার ৪০২ নম্বর রুমে চেক-ইন দিয়ে কিছুক্ষণ পরে তারা বাইরে বের হন নাস্তা করতে। নাস্তা শেষে হিরন বাইরে থেকে গেলেও মিরন হোটেলে যান বিশ্রাম নিতে।  

এর মধ্যে আগুন লেগে যায় হোটেলে। তখন বের হতে না পেরে জীবন বাঁচানোর জন্য মিরন ফোনকল দেন হিরনকে। কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকেন, ‘আমি বাঁচার কোনো পথ পাচ্ছি না, চারদিকে ধোঁয়া দম বন্ধ হয়ে আসছে। ’ এ কথা বলার পরে ফোনকল কেটে যায় তার। পরে ফায়ার সার্ভিস আগুন নিয়ন্ত্রণের পর মিরনের মরদেহ চারতলা থেকে উদ্ধার করে।

হিরন তালুকদার বলেন, আগুন দেখে দৌড়ে হোটেলের নিচে আসি। তখনই মিরন আমাকে ফোনকল দিয়ে কান্না করতে করতে বলেন, চারদিকে ধোঁয়া উনি কোথাও যাওয়ার জায়গা পাচ্ছেন না।

ছাদের গেটে তিন মরদেহ, তলাবদ্ধ ছিল ছাদ
পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যে ভবনটিতে আগুন লাগে সেটি ছয়তলা বিশিষ্ট। ভবনের নিচতলায় তিনটি দোকান রয়েছে। আর দোতলায় নারীদের একটি বিউটি পার্লার ও তিন থেকে ছয় তলা পর্যন্ত ছিল আবাসিক সৌদিয়া হোটেলটি। ছয় তলার অর্ধেক হোটেলের রুম আর বাকি অর্ধেক ছাদ। দোতলার বিউটি পার্লার আগুনে পুড়ে গেছে। এছাড়া ভবনের নিচ তলায় আগুনে আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে তৃতীয় থেকে ছয় তলা পর্যন্ত অবস্থিত হোটেলও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস সূত্রে আরও জানা যায়, ভবনের নিচ তলায় রয়েছে রুমা ডিজিটাল নামে একটি স্টুডিও এবং মা ডোর সেন্টার অ্যান্ড ফার্নিচার ও মুন্নি এন্টারপ্রাইজ নামে দুটি দোকান। দোতলার ওই পার্লারটির নাম গোল্ডেন টিউলিপ। ভবনটির চারতলায় হোটেলের রুমের সামনে একটি মরদেহ পাওয়া যায়। বাকি তিনটি মরদেহ ছয় তলার ছাদের গেটের সামনে পড়েছিল। তবে গেটের তালাবদ্ধ ছিল।

এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গুলশান থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোখলেছুর রহমান বলেন, ভবনটির চারতলা থেকে একজন ও ছয় তলার ছাদের গেটের সামনে তিনজনের মরদেহ পাওয়া গেছে। মরদেহগুলো আগুনের তাপে কিছুটা পুড়ে গেছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা নিহত চারজন আগুনে সৃষ্ট ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে মারা গেছেন। আমরা এখন পর্যন্ত একজনের পরিচয় নিশ্চিত করতে পেরেছি। বাকি তিনজনের মরদেহ নাম-পরিচয় জানা যায়নি। আমাদের ধারণা এ চারজন হোটেলের গেস্ট ছিলেন।

প্রত্যক্ষদর্শী ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা বলেছেন, আগুনের সূত্রপাত ঘটে দ্বিতীয় তলার বিউটি পার্লার থেকে। পরে বিউটি পার্লার থেকে আগুন বাড়তে থাকে আর প্রচণ্ড ধোঁয়ার সৃষ্টি হয়।

মোখলেছুর রহমান এ বিষয়ে বলেন, আমরা ঘটনাস্থলে এসে বিউটি পার্লার এবং হোটেলের কাউকে পাইনি। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও এ দুই প্রতিষ্ঠানের কোনো কর্তৃপক্ষকে বা কর্মচারীকে পাওয়া যায়নি।

ভবনটির নিচ তলার মা ডোর সেন্টার অ্যান্ড ফার্নিচারের মালিক ফারুক হোসেন বলেন, দুপুর ১২টা ১৫ মিনিটের দিকে আগুন লাগে। আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে দোকানের ক্যাশ বক্স নিয়ে বের হয়ে যাই। আল্লাহর রহমতে আমার দোকানে তেমন ক্ষতি হয় নাই। তবে জেনেছি ভবনের দোতলার বিউটি পার্লার থেকে আগুন লেগেছে। সেখানে নাকি এসি থেকে আগুনের সূত্রপাত ঘটেছে। এরপর ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা এসে আগুন নেভায়। কিন্তু আগুনে প্রচণ্ড ধোঁয়ার সৃষ্টি হয়।

পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের ধারণা, চারতলার বাথরুমে যে মরদেহটি পাওয়া যায় সেই ব্যক্তি হয়তো জীবন বাঁচাতে বাথরুমের ভেতরে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেখানে ধোঁয়ার কারণে দম বন্ধ হয়ে তিনি মারা যান। আর বাকি তিনজন জীবন বাঁচাতে ছাদে যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ছাদ বন্ধ থাকায় তারা আর যেতে পারেননি। ছাদের গেটেই ধোঁয়ার কারণে দম বন্ধ হয়ে তারা মারা যান।

ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভবনটিতে কোনো ধরনের অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল না। ভবনটিকে মোডিফাই (নির্ধারিত ভবনের কাঠামো পরিবর্তন) করে হোটেল ভাড়া দেওয়া হয়। ‌এছাড়া নিচতলায় ও দ্বিতীয় তলা চারটি প্রতিষ্ঠানকে ভাড়া দেওয়া হয়। ভবনটির সিঁড়ি একদম ছোট। দুজন মানুষ একসঙ্গে এ সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করতে পারবে না। এছাড়া ভবনে কোনো ধরনের ফায়ার এক্সিট ছিল না। অন্যদিকে ভবনের কোনো ফ্লোরে অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থাও দেখা যায়নি।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মিডিয়া সেলের কর্মকর্তা তালহা বিন জসিম বলেন, দুপুর ১২টা ১৭ মিনিটের দিকে আমাদের কাছে খবর আসে সৌদিয়া হোটেলে আগুন লেগেছে। পরে আমাদের দুটি ইউনিট প্রায় আধা ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।  আগুন নিয়ন্ত্রণের পর আমাদের তল্লাশি দল হোটেলের ভেতরে চারজনের মরদেহ পায়। নিহত চারজনই পুরুষ।

বাংলাদেশ সময়: ১৯৫২ ঘণ্টা, মার্চ ০৩, ২০২৫
এজেডএস/আরআইএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।