ঢাকা, বুধবার, ৪ চৈত্র ১৪৩১, ১৯ মার্চ ২০২৫, ১৮ রমজান ১৪৪৬

জাতীয়

নজরদারির বাইরে রাতের খুলনা, নগরজুড়ে অকেজো সিসি ক্যামেরা!

মাহবুবুর রহমান মুন্না, ব্যুরো এডিটর  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৫৭ ঘণ্টা, মার্চ ১৮, ২০২৫
নজরদারির বাইরে রাতের খুলনা, নগরজুড়ে অকেজো সিসি ক্যামেরা!

খুলনা: খুলনা মহানগরীতে লাগানো সিসি ক্যামেরার প্রায় সবগুলোই চুরি হয়ে গেছে, চুরি হয়ে গেছে তারও।  যেগুলো অবশিষ্ট আছে সেগুলোও অকেজো।

ফলে পুরো নগরী এখন নজরদারির বাইরে। ফলে চুরি, ছিনতাই ও হত্যার মতো ঘটনা ঘটলেও অপরাধীদের শনাক্ত করতে হিমশিম খাচ্ছে পুলিশ।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, খুলনা সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে ২০১৪ সালে মেট্রোপলিটন পুলিশকে ৮৮টি ক্যামেরা দেওয়া হয়। সে সময় নগরীর শিববাড়ি, নিউমার্কেট, ময়লাপোতা, ডাকবাংলো মোড়, পিকাচার প্যালেস মোড়সহ অন্ত্যত ১২টি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ৮টি করে ক্যামেরা স্থাপন করা হয়। পরে ২০২০-২১ সালে নগরীর সকল থানা এলাকার আরও ১০ থেকে ১২টি স্থানে ৯৬টি ক্যামেরা স্থাপন করে মেট্রোপলিটন পুলিশ। তবে গুরুত্ব আর দেখভালের অভাবে প্রথম ধাপের শতভাগ ও দ্বিতীয় ধাপের অর্ধেকের বেশি ক্যামেরা অকেজো হয়ে পড়েছে।

রাতে বেপরোয়া সন্ত্রাসীরা:
খুলনা নগরীতে গত ৫ মাসে অন্তত ১৫ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া বহু মানুষ গুরুতর আহত হয়েছেন। অধিকাংশ হত্যাকাণ্ডই ঘটেছে রাতে। রাত হলেই সন্ত্রাসীদের দৌরাত্ম্যে নগরবাসীর মধ্যে বাড়ছে আতঙ্ক। এসব অপরাধে জড়িত মাদক কারবারী, জামিনে মুক্তি পাওয়া চিহ্নিত সন্ত্রাসী এবং কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা।

শনিবার (১৫ মার্চ) রাত সাড়ে ১১টার দিকে সন্ত্রাসীদের গুলিতে শেখ শাহিনুল হক শাহীন (৫০) নামে এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। শাহীন নগরীর দৌলতপুরের হুজি শহিদ হত্যা মামলার আসামি ছিলেন। বাগমার মারকাজুল উলুম মাদ্রাসার পেছনে এ ঘটনা ঘটে। নিহত  শাহীন দৌলতপুর কাত্তিককুল এলাকার আব্দুর রশিদের ছেলে।

একই রাতে নগরীর শের-এ-বাংলা রোডের হাজিবাড়ি এলাকায় রনি নামের এক ব্যক্তিকে নিজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ঢুকে গুলি করে ও কুপিয়ে আহত করে একদল সন্ত্রাসী।

মঙ্গলবার (১২ মার্চ) রাত সাড়ে ১০ টার দিকে খুলনায় মাদক বিক্রিকে কেন্দ্র করে একরাম নামে এক ব্যক্তিকে কুপিয়ে জখম করেছে দুর্বৃত্তরা। নগরীর লবণচরা থানাধীন উত্তর হরিণটানা হাওড়া ব্রিজ প্রেমগলির মধ্যে এ ঘটনা ঘটে।

সোমবার (১০ মার্চ) রাত ১১টার দিকে খালিশপুরে ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যে এক ইজিবাইক চালককে গলা কেটে হত্যার চেষ্টা চালিয়েছে দুর্বৃত্তরা। নগরীর খালিশপুর হাউজিং এলাকার হাফিজিয়া ফোরকানিয়া মাদ্রাসা গলির ভেতরে এ ঘটনা ঘটে। চালকের চিৎকারে আশপাশের লোকজন বের হয়ে এলে দুর্বৃত্তরা ইজিবাইক নিয়ে পালিয়ে যায়।

বুধবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) নগরীর ব্যস্ততম এলাকা পিটিআই মোড়সংলগ্ন খানজাহান আলী সড়কে কম্পিউটার ব্যবসায়ী নাজমুল আহসান রণি দুর্বৃত্তদের গুলিতে আহত হন। প্রকাশ্যে মোটরসাইকেলযোগে দুই মুখোশধারী সন্ত্রাসী এসে পেছন থেকে তাকে গুলি করে চলে যায়। আহত রণির দাবি, তার সঙ্গে কারো ব্যবসায়িক, আর্থিক বা অন্য কোনো বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্ব নেই।

এর আগে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাতে নগরীর জোড়াগেট কেএমপির ট্রাফিক কার্যালয়ের পাশে তিনটি দোকানের তালা ভেঙে দুর্বৃত্তরা অন্তত ১০ লাখ টাকার মালামাল লুট করে। ক্ষতিগ্রস্তদের অভিযোগ, দুর্বৃত্তরা অনুপম গ্যাস চুলা, মেসার্স আবুল ব্রাদার্স ও পিকুল বার্নার হাউসের তালা ভেঙে শতাধিক গ্যাস সিলিন্ডার ও চুলা ট্রাকে তুলে নিয়ে গেছে।

১১ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাতে দুর্ধর্ষ ডাকাতির ঘটনা ঘটে খুলনা সিটি করপোরেশনের সাবেক কাউন্সিলর আনজিরা বেগমের বাড়িতে। ১২ ফেব্রুয়ারি জেলা ক্রীড়া সংস্থার কার্যালয় থেকে দুর্বৃত্তরা বিভিন্ন ট্রফি চুরি করে নিয়ে যায়। এর আগে গত ১৭ জানুয়ারি রাতে খুলনা জেলা ক্রীড়া সংস্থার হিসাব শাখা থেকে ড্রয়ারের তালা ভেঙে সাড়ে ৯ হাজার টাকা, ক্রীড়া সামগ্রী, কিডস্ ব্যাগ ও অফিসের কম্পিউটার চুরি হয়। এসব ঘটনায় থানায় মামলা ও অভিযোগ দায়ের হলেও অপরাধীরা শনাক্ত হয়নি।

এভাবে প্রতিনিয়তই খুলনায় ঘটছে ঘটনা-দুর্ঘটনা। হরহামেশাই ঘটছে চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতির মতো ঘটনা। কিন্তু সিসি ক্যামেরা না থাকায় অপরাধীকে শনাক্ত করতে ঘাম ঝরছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। অরক্ষিত শহরকে প্রযুক্তির আওতায় আনার দাবি নগরবাসীর।

শের-এ-বাংলা রোডের স্কলার ক্লিনিকের পাশের দোকানী শামীম বলেন, সম্প্রতি হাসপাতালে তিন দফায় ক্লিনিকে চুরি হয়েছে। চোর এসির তারও নিয়ে গেছে।

তাবলীগ মসজিদের পাশের বাসিন্দা এম রহমান বলেন, আশাপাশের সব সিসি ক্যামেরা ২৬ নং ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলরের তত্ত্বাবধানে লাগানো হয়েছিল। এখন কাউন্সিলরও নেই সিসি ক্যামেরাও সচল নেই। যে কারণে এলাকায় প্রায় ঘটছে চুরি। চলছে মাদক ব্যবসা।

মোল্লাপাড়া এলাকার বাসিন্দা জাহিদুর রাহমান বলেন, শহরজুড়ে রাত ১০টার পর চলাফেরা দিন দিন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। খুলনার ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের মোল্লাপাড়া এলাকায়ও ছিনতাই, চুরি ও খুনের মতো অপরাধ বেড়েছে। যদিও কিছু স্থানে সিসি ক্যামেরা বসানো হয়েছে, তবে বেশিরভাগই অকেজো, আর অনেক জায়গায় ক্যামেরাই নেই। পুলিশের টহলও সীমিত, বিশেষ করে গভীর রাতে, ফলে অপরাধীরা সহজেই অপরাধ করতে পারছে।

তিনি আরও বলেন, সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে রাতে কাজ শেষে ফেরা ব্যক্তিরা আতঙ্কে থাকেন। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মোল্লাপাড়াসহ পুরো শহরে সিসি ক্যামেরা সচল করা, পুলিশের টহল বাড়ানো ও আলোবাতির ব্যবস্থা করা জরুরি। অপরাধীদের দ্রুত শাস্তির আওতায় না আনলে রাতের খুলনা আরও অনিরাপদ হয়ে উঠবে।

ময়লাপোতার মোড়ের বাসিন্দা অ্যাডভোকেট হেলাল হোসেন আক্ষেপ করে বলেন, জনমনে স্বস্তি নেই।  নিরাপত্তা অভাববোধ হচ্ছে প্রতিনিয়ত। মোড়ে মোড়ে পুলিশের টহল বাড়ানো জরুরি।  সিসি ক্যামেরা আছে শহরের অলিগলিতে কিন্তু সেগুলো কার্যকর কিনা জানা নেই। ঘটনা ঘটার পর সিটিফুটেজ দিয়ে কি হবে?

নিরালা ২০ নং রোডের বাসিন্দা আবু সাঈদ বলেন, নিরালায় চুরির মহোৎসব চলছে। সম্প্রতি সময়ে চোরের আমার প্রতিবেশির বাড়িতে চুরি করে জানালার গ্রিলও নিয়ে গেছে। ৫তলা থেকে এক প্রতিবেশি দেখে ফেললে চোরেরা তাদের হাত উঁচিয়ে টা টা দিয়ে চলে যায়। যেন এটা কোনো ব্যাপারই না।

নিরালা আবাসিক এলাকা জনকল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. আব্দুস সবুর বাংলানিউজকে বলেন, নিরালা আবাসিকে চুরি বেড়েছে। সিসি ক্যামেরার ক্যাবল পর্যন্ত কেটে নিয়ে যাচ্ছে চোরেরা।

খুলনা নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব মো. বাবুল হাওলাদার বাংলানিউজকে বলেন, খুলনায় সন্ধ্যা হলেই মানুষের মধ্যে চুরি, ছিনতাই ও হত্যার আতঙ্ক শুরু হয়ে যায়। প্রায় প্রতি রাতেই কোনো না কোনো জায়গায় চুরি, খুন, মারামারি, ছিনতাই সংঘটিত হচ্ছে। রাতের বেলায় সড়কে চলাচল করা নিয়ে উগ্বেগ-আতঙ্ক বেড়েছে নগরবাসীর মাঝে। বিশেষ করে রাত ১০টার পর রাস্তায় চলাচল কঠিন হয়ে যাচ্ছে। ঈদের কেনা কাটা করতে যেতেও মানুষ ভয় পাচ্ছে। জান-মালের নিরাপত্তা নিয়ে আতঙ্কে থাকতে হচ্ছে। এটা থেকে পরিত্রাণ দিতে পুলিশকে আরও বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে।

তিনি আরও বলেন, মহানগরীর মোড়ে মোড়ে লাগানো সিসি ক্যামেরাগুলো নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। কিছু তো চোরেই নিয়ে গেছে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে চলছে ছিনতাই, চুরি ও হত্যার মতো নানা অপরাধ।

অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সিসি ক্যামেরার গুরুত্ব অপরিসীম। দ্রুত নষ্ট সিসি ক্যামেরা স্থাপন করে নগরবাসীর স্বস্তি ফেরানো দাবি জানান তিনি।

খুলনা সিটি কর্পোরেশনের (কেসিসি) আইটি ম্যানেজার শেখ হাসান হাসিবুল হক বাংলানিউজকে বলেন, নগরীতে যেসব স্থানে সিসি ক্যামেরা আছে তা সিটি কর্পোরেশন নিয়ন্ত্রণ করে না। মূলত যেসব ওয়ার্ডে সিটি ক্যামেরা আছে তা সেই সব ওয়ার্ডের কাউন্সিলররা স্থাপন করেছিলেন। তার অধিকাংশেই চুরি হয়েছে। আর বাকিগুলো অকেজো হয়ে পড়ে আছে।

প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোল্লা মারুফ রশীদ বাংলানিউজকে বলেন, সিটি কর্পোরেশন এলাকায় যেসব সিসি ক্যামেরা আছে তা যদি সংশ্লিষ্ট এলাকাবাসী আবেদন করে তাহলে সেগুলো সংস্কার ও মনিটরিংয়ের জন্য বিবেচনা করা হতে পারে।

খুলনা মেট্রাপলিটন পুলিশের (কেএমপি) এডিসি (মিডিয়া) মোহাম্মদ আহসান হাবীব বাংলানিউজকে বলেন, শহরের কতটি স্থানে সিসি ক্যামেরা স্থাপন আছে তার সঠিক পরিসংখ্যান এখন বলা যাচ্ছে না। তবে ঈদের আগে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য সিসি ক্যামেরাস্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ২০৫৩ ঘণ্টা, মার্চ ১৮, ২০২৫
এমআরএম/নিউজ ডেস্ক

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।