ঢাকা: পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে বরাবরের মতো এবারো ফাঁকা হতে শুরু করেছে ঢাকা। দীর্ঘ ছুটিতে রাজধানী ঢাকাসহ আশপাশের দুই-তিন জেলা ছেড়ে বহু মানুষ নাড়ির টানে ফিরছে গ্রামে।
অপরাধ বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ বলছেন, এবার বিশেষ এক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোকে যেতে হচ্ছে। নিরাপত্তা নিয়ে যে প্রত্যাশা, তা পূরণ নাও হতে পারে। তাদের অনেকের পরামর্শ, নিরাপত্তার সংকট মোকাবিলায় অক্সিলিয়ারি ফোর্সকে কাজে লাগানো যেতে পারে। এতে যারা বাড়ি যাচ্ছেন, নিরাপত্তা সংকটে ভুগছেন, তারা কিছুটা হলেও রেহাই পাবেন, কিছুটা স্বস্তিতে থাকবেন।
পুলিশ সদরদপ্তর বলছে, পবিত্র ঈদুল ফিতর উৎসবমুখর ও নিরাপদ পরিবেশে উদযাপনের লক্ষ্যে পুলিশের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আর সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখতে রাজধানীর সর্বত্র পুলিশের চলমান তৎপরতা তদারকি করা হচ্ছে। আসন্ন ঈদের ছুটির সময়ও দেশের নিরাপত্তায় বিঘ্ন ঘটবে না বলেও প্রত্যাশা সরকারের।
তবে গত সোমবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. নাসিমুল গনি সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল রয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখতে রাজধানীর সর্বত্র পুলিশের চলমান তৎপরতা তদারকি করা হচ্ছে। আসন্ন ঈদের ছুটির সময়ও দেশের নিরাপত্তায় বিঘ্ন ঘটবে না।
সবশেষ বৃহস্পতিবার স্বরাষ্ট্রসচিব জানান, পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের ঈদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। ফলে তারা সব জায়গায় সতর্ক স্থানে থাকবেন। ফলে ঈদ উপলক্ষে অন্যান্য সেক্টরে টানা ছুটি থাকলেও নিরাপত্তায় কোনো বিঘ্ন ঘটবে না বলে তিনি জানান।
ভয় কোথায়
ঢাকার বাসিন্দারা মনে করছেন, এবার ঈদুল ফিতরে শুধু পুলিশের দিকে নিরাপত্তার জন্য তাকিয়ে থাকলে হবে না। নিজেদের নিরাপত্তা নিজেদেরই নিতে হবে। এর সঙ্গে পুলিশ তো আছেই। গত কয়েক মাস ধরে রাজধানীতে ঘটে যাওয়া নানা অপরাধের খবর গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। এসব খবর দেখে এবারের ঈদে অনেকটাই শঙ্কা তাদের।
রাজধানী লাগোয়া গাজীপুরের টঙ্গীর স্থানীয় বাসিন্দা লতিফ রিপন। বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে তিনি কর্মরত। কথা হলে তিনি বাংলানিউজকে বলেন, তার তিন ইউনিটের চারতলা বাড়িতে নয়জন ভাড়াটিয়া রয়েছেন। অধিকাংশ ভাড়াটিয়া এবার ঈদে গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছেন।
তিনি জানান, এবারের ঈদে টানা নয়দিনের ছুটিতে তার এলাকা নিস্তব্ধ হয়ে যাবে। তখনকার সময়ের নিরাপত্তা নিয়ে তিনি কিছুটা শঙ্কিত। লতিফ বলেন, চুরি-ডাকাতি প্রতিরোধে নিজেদের উদ্যোগে আমরা কিছু প্রস্তুতি নিয়ে থাকি। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তো আছেনই। আমরা ভাড়াটিয়াদের বিভিন্ন ধরনের পরামর্শ দিই। তারা যেন দরজায় তালা লাগিয়ে যান, গ্যাসের লাইন বন্ধ করে যান।
খিলগাঁও থানার সিপাহীবাগের স্থায়ী বাসিন্দা নাসির আহমেদ নিলন জানান, এবারের ঈদে নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত হলেও বরাবরের মতো চুরি-ডাকাতি প্রতিরোধে সজাগ থাকব। এবার ঈদে লম্বা ছুটি। তাই ঢাকা শহর কিছুটা বেশি ফাঁকা থাকবে বলে মনে হচ্ছে। তবে আমাদের পরিচিত অনেকেই এবার গ্রামের বাড়িতে গিয়ে ঈদ করতে ইচ্ছুক নন। কারণ, ফাঁকা বাসা ফেলে রেখে তারা যেতে কিছুটা হলেও ভয় পাচ্ছেন।
শুধু কি পুলিশেই ভরসা
ধানমন্ডির শংকর এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা আক্তার হোসেন বাবলু বলেন, প্রতি বছরই ঈদে ঢাকা শহর খালি হয়ে যায়। নিজের বাড়ি-ঘরের নিরাপত্তা নিজেই বজায় রাখার চেষ্টা করি। আমাদের বাড়িটি দোতলা। বেশ কয়েকজন ভাড়াটিয়া ঈদে তারা বাড়ি চলে যাবেন। এবার ঈদে নিরাপত্তা নিয়ে কিছুটা যে শঙ্কিত নই, তা বলা যাবে না।
তিনি বলেন, পত্র-পত্রিকা খুললেই দেখা যায়, চুরি-ডাকাতি-ছিনতাইয়ের খবর থাকেই। পুলিশের ওপর হামলার খবরও থাকে। আমার মনে হয়, পুলিশের ওপর হামলার ঘটনা দেখে অপরাধীরা মাথাচাড়া দিচ্ছে। এবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মুখের দিকে চেয়ে থাকলে হবে না। নিজেদের নিরাপত্তা নিজেদেরই বজায় রাখতে হবে। পাশাপাশি থানা পুলিশ তো আছে।
কথা হলে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, তার সংগঠনের হিসাবে এবার ঢাকা ও ঢাকার আশপাশের জেলা থেকে কমপক্ষে দেড় কোটি মানুষ ঈদের সময় গ্রামে যাবেন। দীর্ঘ ছুটির কারণে এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। শুধু ঢাকা নয়, সারাদেশেই আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ আছে।
কী বলছে পুলিশ, যেভাবে কষা হচ্ছে নিরাপত্তার ছক
মার্চের শুরুর দিকে নগরবাসীকে উদ্দেশ করে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, পুলিশ দায়িত্ব পালন করলেও ঈদে বাড়ি যাওয়ার সময় বাড়ি, ফ্ল্যাট, দোকান, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা নিজ দায়িত্বে নিশ্চিত করতে হবে। আমরা আপনাদের সঙ্গে আছি, আমাদের ব্যবস্থাপনাটা আমরা করব।
এবার দীর্ঘ ছুটি বিবেচনায় নিয়ে সে অনুযায়ী ফাঁকা ঢাকায় নিরাপত্তা দেওয়ার ছক কষছে ডিএমপি। ২৪ মার্চের সমন্বয় সভায় ডিএমপি কমিশনার বলেন, পবিত্র ঈদুল ফিতর উৎসবমুখর ও নিরাপদ পরিবেশে উদযাপনের লক্ষ্যে সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের জোর তৎপরতায় রাজধানীতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অনেকটাই উন্নতি হয়েছে। পুলিশি তৎপরতায় ছিনতাই ও চাঁদাবাজির মতো ঘটনা অনেকাংশে কমে গেছে। সবার সহযোগিতা নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।
কথা হলে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর বাংলানিউজকে বলেন, ঈদ সামনে রেখে পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট- হাইওয়ে পুলিশ, শিল্প পুলিশ ও রেলওয়ে পুলিশকে বিশেষভাবে সক্রিয় করা হয়েছে। ঢাকাসহ সারা দেশেই গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। মহাসড়কে ডাকাতি রোধে বিশেষভাবে নজর দেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাই প্রতিরোধেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। জনগণকে সতর্ক করা হচ্ছে। একইসঙ্গে এই সময়ে প্রতারক চক্র অনেক বেশি সক্রিয় হয়। সেদিকেও বিশেষ নজর রয়েছে পুলিশের।
ঢাকা মহানগর পুলিশের পাশাপাশি নিরাপত্তা ছকে থাকছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নও (র্যাব)। রাজধানীসহ সারা দেশে র্যাব নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিয়েছে। বাহিনীটির আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিকুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, ঈদে মানুষের নিরাপত্তায় গোয়েন্দা কার্যক্রম ও টহল জোরদার করা হয়েছে। এ সময় ইউনিফর্মের পাশাপাশি সাদা পোশাকে র্যাবের গোয়েন্দা বিভাগের সদস্যরা তৎপর থাকবেন। ঈদে নিরাপত্তায় গোয়েন্দা, ফুট প্যাট্রল, মোবাইল প্যাট্রল ও সাইবার প্যাট্রল থাকবে।
প্রত্যাশার কতটা পূরণ হবে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক তৌহিদুল হক বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের দেশে ঈদের সময় ঢাকা বা বড় শহরগুলো ছেড়ে মানুষজন গ্রামের বাড়িতে যান। তখন আমাদের বাসায় থাকা মূল্যবান জিনিসপত্র নিয়ে চিন্তা করতে হয়।
তিনি বলেন, আমরা অতীতে দেখেছি, এটি একটি বড় আয়োজন, বড় কর্মযজ্ঞ। শুধু পুলিশের একার পক্ষে অতীতে এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি। চারপাশের সবারই নিজেদের জায়গা থেকে যতটা দায়িত্ববান হওয়া প্রয়োজন, সেই দায়িত্ব থেকে এ ধরনের নিরাপত্তার সংকট অনেকটাই কাটিয়ে ওঠা যায়।
৫ আগস্ট পরবর্তী পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে এই বিশ্লেষক বলেন, এবারের বাস্তবতা হলো ঈদকেন্দ্রিক চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি ও রাহাজানি, অপহরণ, চাঁদাবাজি— এই অপরাধগুলো ঈদের আগে থেকেই বেশি। আবার এসব অপরাধ ঈদের সময় আবার বেড়ে যায়। সুতরাং অপরাধের মাত্রা বর্তমানে দ্বিগুণ হয়েছে। যারা গ্রামে যাবেন, তাদের ঢাকার বাসা-বাড়ি অবশ্যই তালাবদ্ধ করে যাবেন।
তিনি বলেন, বাসায় সিসি ক্যামেরা থাকলেও চুরির ঘটনা ঘটার চিত্র এর আগেও দেখা গেছে। এসব ঘটনায় তদন্তে দেখা যায়, অনেক ক্ষেত্রে ওই বাসার দারোয়ান অথবা ভাড়াটিয়ার পূর্বপরিচিতরা, তাদের যোগসাজশেই চুরির ঘটনাগুলো ঘটে। সিসি ক্যামেরার ক্ষেত্রে দেখা যায়, তার কেটে দেওয়া হয়েছে অথবা বিদ্যুৎ বন্ধ করে দেওয়া হয়, এ ধরনের ঘটনা ঘটে।
তৌহিদুল হকের মতে, যেহেতু, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরিপূর্ণভাবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে পারছে না, তাদের বিশেষ একটি পরিস্থিতির মধ্যদিয়ে যেতে হচ্ছে, সেক্ষেত্রে তাদের ওপর থাকা প্রত্যাশা পূরণ নাও হতে পারে।
তিনি বলেন, যারা বাড়ি যাবেন, তাদের মূল্যবান জিনিসপত্র নিজেদেরই নিরাপদে রাখতে হবে। কারণ এখন যে পরিস্থিতিতে আমরা এসে দাঁড়িয়েছি, সেই ব্যক্তিকেই দায়িত্ব নিতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বক্তব্য অনুযায়ী, তারা পরিপূর্ণভাবে দায়িত্ব নিতে পারছে না বর্তমান পরিস্থিতির কারণে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় অক্সিলিয়ারি ফোর্সের প্রসঙ্গ তুলে ধরে তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অপরাধ নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে অক্সিলিয়ারি ফোর্সকে অ্যাকটিভ করছে বা সম্পৃক্ত করছে। এই ফোর্সকে যদি সঠিকভাবে মনিটরিংয়ের মাধ্যমে কাজে লাগানো যায়, তবে নিরাপত্তার যে সংকট আছে, যারা বাড়ি যাচ্ছেন নিরাপত্তা সংকটে ভুগছেন, তারা কিছুটা হলেও রেহাই পাবেন, কিছুটা স্বস্তিতে থাকবেন।
এবারই প্রথম অক্সিলিয়ারি ফোর্স
এই বিশ্লেষকের পরামর্শ, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাজধানীর নিরাপত্তা-সুরক্ষার প্রশ্নে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সতর্ক থাকতে হবে। গণঅভ্যুত্থান কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে দূরত্ব, বিপরীত অবস্থান, দোষারোপ, প্রতিশোধ— ঈদকেন্দ্রিক ছুটির সময়ে এসব বিষয়ের পুনরাবৃত্তি হতে পারে। তাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে।
‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যতটা সক্ষমতা আছে, তাদের সোর্সগুলোকে অ্যাকটিভ করে, মনিটরিংয়ের মাধ্যমে অক্সিলিয়ারি ফোর্সকে অ্যাকটিভ করে ব্যক্তির নিরাপত্তা এবং ঢাকা শহরের সুরক্ষার প্রশ্নে একযোগে কাজ করতে হবে। এর সঙ্গে সবাই নিজ নিজ জায়গা থেকে দায়িত্বশীল আচরণ করতে পারলেই নিরাপত্তার যে সংকটের কথা আমরা ভাবছি, তা অনেকটাই কাটিয়ে ওঠা যাবে। ’
অক্সিলিয়ারি ফোর্সের ব্যবহার নিয়ে ডিএমপির উপ-কমিশনার (মিডিয়া) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, এবারই প্রথম অক্সিলিয়ারি ফোর্স কাজ শুরু করে দিয়েছে। তারা পুলিশের সহায়ক হিসাবে কাজ করবে, তথ্য দেবে এবং অপরাধীদের আটকে সহায়তা করবে। তারা মূলত ঈদের সময় আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকায় নিরাপত্তা রক্ষায় সহায়তা করবে। রাজধানীতে চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতি প্রতিরোধে ঢাকা মহানগর পুলিশ নিয়মিত টহল কার্যক্রম জোরদার করেছে এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে চেকপোস্ট পরিচালনা করছে।
বাংলাদেশ সময়: ০১৩৫ ঘণ্টা, মার্চ ২৮, ২০২৫
এজেডএস/আরএইচ