ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ বৈশাখ ১৪৩২, ০৮ মে ২০২৫, ১০ জিলকদ ১৪৪৬

জাতীয়

মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানিতে জালিয়াতি

সেই স্বপন এখনো অধরা

নিউজ ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯:১২, মে ৮, ২০২৫
সেই স্বপন এখনো অধরা মো. রুহুল আমিন স্বপন

মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে সিন্ডিকেট গড়ে তুলে হাজার কোটি টাকা লুটপাট করেছে ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী ও বায়রার সাবেক মহাসচিব রুহুল আমিন স্বপন। কিন্তু বহু অপরাধের হোতা হয়েও প্রভাবশালীদের মদদ আর দুর্নীতির ছত্রচ্ছায়ায় এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন তিনি।

জনশক্তি রপ্তানিতে তাঁর সিন্ডিকেটের ব্যাপক জালিয়াতি ও দুর্নীতির তথ্য সরকার ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কাছে থাকলেও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি তাঁর বিরুদ্ধে। জনশক্তি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সঠিক বিচার না হওয়ায় ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন স্বপন ও তাঁর সিন্ডিকেটের সদস্যরা।

এর ফলে ফের মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে ওই সিন্ডিকেট। আবারও মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার দখল করার চেষ্টা করছে তারা।
সূত্র জানায়, জনশক্তি রপ্তানির এই সিন্ডিকেটের মূল হোতা রুহুল আমিন স্বপন ও মালয়েশিয়ার নাগরিক আমিনুল ইসলাম বিন আমিন নুর ওরফে দাতো শ্রী আমিন। স্বপন-আমিন সিন্ডিকেট ২০২২ সালে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খোলার পর চড়া দামে কর্মী পাঠিয়ে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়।

প্রতিজন কর্মীকে গন্তব্যে পাঠাতে পাঁচ থেকে ছয় লাখ টাকা আদায় করা হয়, যেখানে সরকার নির্ধারিত ফি ছিল মাত্র ৭৯ হাজার টাকা। এতে হাজার হাজার শ্রমিক আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

এদিকে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে স্বপন-আমিন সিন্ডিকেট যাতে আইনের আওতায় না আসে, সে জন্য ওই সময়ে মন্ত্রণালয়ে অর্থ ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল তারা। গত বছর ৫ আগস্টের পরপর সিন্ডিকেটটির বড় একটি অংশ দেশ ত্যাগ করে।

তার পরও তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো আবারও বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর সিন্ডিকেটকে সক্রিয় করে তুলতে কাজ করছে। এরই মধ্যে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সামনে একাধিকবার মানববন্ধন করেছে তারা।

অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, চলতি বছেরের ২০ মার্চ সিঙ্গাপুরে একটি বিলাসবহুল হোটেলে মালয়েশিয়া সিন্ডিকেট ইস্যুতে গোপন সভা করেন স্বপন-আমিন সিন্ডিকেটের ঘনিষ্ঠজনরা। এরই মধ্যে দেশে ব্যবসারত রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে সিন্ডিকেট থেকে প্রলোভন দেখানো হচ্ছে। সিন্ডিকেট সদস্য হতে প্রতি এজেন্সি থেকে ৫০ লাখ মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত বা সাড়ে ১২ কোটি টাকা দাবি করছে স্বপন-আমিন সিন্ডিকেট।

প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা যায়, মালয়েশিয়া ইস্যুতে স্বপন-আমিন সিন্ডিকেটের ২৭টি রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলেও স্বপনের ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনালসহ ৭২টি রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। মালয়েশিয়ার ঘটনায় সিন্ডিকেটে অন্তর্ভুক্ত ২৭টি রিক্রুটিং এজেন্সি ও সিন্ডিকেটের সহযোগী ৩০টি রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় মন্ত্রণালয়। তবে সিন্ডিকেটে অন্তর্ভুক্ত ২৭টি রিক্রুটিং এজেন্সির মধ্যে মাত্র ১৪টি রিক্রুটিং এজেন্সির লাইসেন্স এখনো লক রয়েছে, অর্থাৎ শাস্তির তালিকাভুক্ত রয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলো। আর ১৩টি রিক্রুটিং এজেন্সির শাস্তি এরই মধ্যে মওকুফ করা হয়েছে, অর্থাৎ লাইসেন্সের লক খুলে দেওয়া হয়েছে।

লাইসেন্স লক আছে ১৪ এজেন্সির, খুলেছে ১৩টির

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে সূত্রে জানা যায়, শাস্তির তালিকাভুক্ত থাকা ১৪টি রিক্রুটিং এজেন্সি রয়েছে, যারা এখন দেশ থেকে কোনো শ্রমিক বিদেশে পাঠাতে পারছে না। এর মধ্যে রয়েছে আহমেদ ইন্টারন্যাশনাল (আরএল-১১৪৬), এমইএফ গ্লোবাল বাংলাদেশ লি. (আরএল-১৯৬৩), ৫এম ইন্টারন্যাশনাল (আরএল-১৩২৭), আইএসএমটি হিউম্যান রিসোর্স (আরএল-১১৯৪), আল-ফারাহ হিউম্যান রিসোর্স (আরএল-১৪৮৫), ব্রাদার্স ইন্টারন্যাশনাল (আরএল-১৫৭১), বিএম ট্রাভেলস (আরএল-১৪২১), পিআর ওভারসিজ (আরএল-১৯২৮), দ্য জিএমজি অ্যাসোসিয়েটস লি. (আরএল-১১৪৩), রমনা এয়ার ইন্টারন্যাশনাল (আরএল-১১৭২), মালয়েশিয়া বাংলাদেশ লি. (আরএল-১৬৭৫), কমফোর্ট ওভারসিজ কনসালট্যান্ট (আরএল-১৭৩৯), ইউনাইটেড ম্যানপাওয়ার কনসালটেন্সি (আরএল-১২১৬) ও আল হেরা ওভারসিজ (আরএল-১৫৬৮)।

শাস্তি মওকুফ হওয়া ১৩টি রিক্রুটিং এজেন্সির মধ্যে রয়েছে দাহমাশি করপোরেশন লি. (আরএল-৭২৭), ইস্ট ওয়েস্ট প্যারাডাইজ (আরএল-৬১৯), প্রভাতী ইন্টারন্যাশনাল লি. (আরএল-৯৩২), ইম্পেরিয়াল রিসোর্সেস লি. (আরএল-১৮৭৪), রুবেল বাংলাদেশ লি. (আরএল-১৪৫৫), আরভিং এন্টারপ্রাইজ (আরএল-২১৫), মদিনা ওভারসিজ (আরএল-৬৩৯), জিএমজি ট্রেডিং (আরএল-৪৯০), বিএনএস ওভারসিজ (আরএল-১৪৫০), পিএন এন্টারপ্রাইজ (আরএল-৩৭৬), আমান এন্টারপ্রাইজ (আরএল-৭২৪), ইউনাইডেট এক্সপোর্ট লি. (আরএল-৪৮৬) ও উইন ইন্টারন্যাশনাল (আরএল-৭২১)।

সহযোগী এজেন্সির লাইসেন্স লক ২০টির, খুলেছে ১০টির

সিন্ডিকেটের সহযোগী ৩০টি রিক্রুটিং এজেন্সির মধ্যে ১০টি রিক্রুটিং এজেন্সির শাস্তি মওকুফ করা হয়েছে। আর ২০টি রিক্রুটিং এজেন্সিকে এখনো শাস্তির তালিকায় রাখা হয়েছে। শাস্তি মওকুফ হওয়া ১০টি রিক্রুটিং এজেন্সির মধ্যে রয়েছে কিউপিড ট্রেডার্স (আরএল-১১), লয়াল ম্যানপাওয়ার (আরএল-২০৬), লিংক আপ ইন্টারন্যাশনাল (আরএল-৩১১), প্রবাসী ইন্টারন্যাশনাল (আরএল-৫৫৪), পপুলার ট্রেড (আরএল-৬৫৯), এভারেস্ট ইন্টারন্যাশনাল (আরএল-৬৬৩), ফেইথ এয়ার ইন্টারন্যাশনাল (আরএল-১৮৪২), আরিয়ান ট্রেড (আরএল-১৫৫০), জিএম ওভারসিজ (আরএল-১৯০৩) ও এয়ার টপ ওভারসিজ (আরএল-১৯৭৯)।

শাস্তির তালিকায় থাকা ২০টি রিক্রুটিং এজেন্সির মধ্যে রয়েছে ইন্টারফ্লো ইন্টারন্যাশনাল (আরএল-১০৪), অর্কিড ভিউ ইন্টারন্যাশনাল (আরএল-৪৭৭), আল ইরফান ইন্টারন্যাশনাল (আরএল-৪৮৮), ম্যাব অ্যাসোসিয়েটস (আরএল-৬৫০), ইউরোপা ওভারসিজ (আরএল-৭৯১), বিসমিল্লাহ ওভারসিজ (আরএল-৮২৪), নোভা ওভারসিজ (আরএল-১৩৩০), ল্যাম্ব ওভারসিজ (আরএর-১৩৫৮), মা-মনি ওভারসিজ (আরএল-১৬৩৫), জয়নব জাফরিন (আরএল-১৬৪৮), এসকে গ্লোবাল (আরএল-১৪৪৭), মালি ওভারসীজ (আরএল-১৯২০), ওয়েজ কর্মাশিয়াল (আরএল-১৯৭০), আরাফ ম্যানপাওয়ার (আরএল-২২০০), পাবনা ইন্টারন্যাশনাল (আরএল-২৩৫৮), কাওয়ান ওভারসিজ (আরএল-২৪৭০), বিএইচবি ওভারসিজ লি. (আরএল-২৭২৮), আজিজ আব্বাস ট্রেড (আরএল-২১১৬), ইউরেকা গ্লোবাল (আরএল-৮৮) ও ম্যারি গোল্ড (আরএল-৫০৭)।

প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, রিক্রুটিং এজেন্সির সর্বোচ্চ শাস্তি হলো তার লাইসেন্সটি লক করে দেওয়া। অর্থাৎ যাদের লাইসেন্স লক রয়েছে তারা কোনো দেশেই কর্মী পাঠাতে পারবে না। যদি পাঠায় তাহলে তার বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে।

ক্যাথারসিসসহ ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি ৭২টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে

শ্রমিকের রক্ত ক্ষয় করে উপার্জিত টাকা লুট করলেও স্বপনের ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনালসহ ৭২টি রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এর মধ্যে শীর্ষ ২৫ সিন্ডিকেট সদস্যের মধ্যে ২০টির বিরুদ্ধেও মন্ত্রণালয় থেকে নেওয়া হয়নি কোনো ব্যবস্থা। এর মধ্যে রয়েছে অরবিটালস ইন্টারন্যাশনালের (আরএল-১১৩ ও ১৪৫৭) চেয়ারম্যান ও সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, ফেনী-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও স্নিগ্ধা ওভারসিজের স্বত্বাধিকারী (আরএল-১৫৫১) নিজাম উদ্দিন হাজারী, বায়রার সাবেক সভাপতি ও সরকার রিক্রুটিং এজেন্সির (আরএল-২২৬) মোহাম্মদ আবুল বাশার, কাজী এয়ার ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী (আরএল-২০৭) কাজী মোফিজুর রহমান, অনন্য অপূর্ব রিক্রুটিং এজেন্সির স্বত্বাধিকারী (আরএল-২১০১) মোহিউদ্দিন আহমেদ (মহি), আল-রাবেতা ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী (আরএল-৩৫৪) মোহাম্মদ আবুল বাশার, আদিব এয়ার ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরসের স্বত্বাধিকারী (আরএল-১০২৪) কে এম মোবারক উল্লাহ শিমুল, আকাশ ভ্রমণের স্বত্বাধিকারী (আরএল-৩৮৪) মনসুর আহমেদ খান, জাহরাত অ্যাসোসিয়েটসের স্বত্বাধিকারী (আরএল-২৮৫) শফিকুল ইসলাম ফিরোজ, আল বোখারী ইন্টারন্যাশলানের স্বত্বাধিকারী (আরএল-৩০১) সাইফুল ইসলাম ভূইয়া, আমিয়াল ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী (আরএল-১৩২৬) শাহ জামাল মোস্তফা, বিনিময় ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী (আরএল-৩৫১) এম এ সোবহান ভূঁইয়া, গ্রিনল্যান্ড ওভারসিসের স্বত্বাধিকারী (আরএল-৪০) রেহেনা আরজুমান হাই, অইছি ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী (আরএল-১১৪১) মোস্তাফিজুর রহমান, পাথ ফাইন্ডার ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী (আরএল-১২৯৮) মাজহারুল ইসলাম, সরকার ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী (আরএল-১৭১৫) মোহাম্মদ আলী সরকার, শাহেনা ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলসের স্বত্বাধিকারী (আরএল-৮৯৬) রফিকুল ইসলাম, সাউথ পয়েন্ট ওভারসিসের স্বত্বাধিকারী (আরএল-৬২২) মোহাম্মদ মিজানুর কাদের, জাহরাত অ্যাসোসিয়েটের স্বত্বাধিকারী (আরএল-২৮৫) শফিকুল আলম।

এ প্রসঙ্গে জানতে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. নেয়ামত উল্যা ভূঁইয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তাঁর মোবাইল নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।