স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম নির্বাসিত কবি দাউদ হায়দারের দেশের প্রতি ছিল প্রবল আকর্ষণ। মৃত্যুশয্যায় থাকার আগে বন্ধুদের সঙ্গে আলাপচারিতায় বার বার তিনি দেশে ফিরে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করতেন।
বাংলাদেশের ধূলিকণা তার দেহ স্পর্শ করবে না। তাই তো মৃত্যুর বছর কয়েক আগে সাবির নামের এক বন্ধুকে (ফ্রাঙ্কফুর্ট) দিয়ে দেশ থেকে বোতলে করে মাটি আনিয়েছিলেন প্রয়াত কবি দাউদ হায়দার।
এভাবেই প্রয়াত কবি দাউদ হায়দারের সুহৃদ ও জার্মানির আদালত কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত দাউদ হায়দারের অনারারি অভিভাবক মাইন চৌধুরী কবির শেষ দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করেন বাংলানিউজের সাথে।
মাইন চৌধুরী জানান, জার্মানির বার্লিনের এমইএস, শুনেবার্গ-এ চিকিৎসাধীন ছিলেন কবি দাউদ হায়দার। ২০২৪ সালের ১২ ডিসেম্বর সিঁড়ি থেকে পড়ে আহত হওয়ার পর তিনি কথা বলতে পারতেন না। এমইএস থেকে রাতে (বাংলাদেশ সময় ভোর) তাকে জানানো হয় কবির মৃত্যুর সংবাদ। তিনি সাথে সাথে কবির ভাই বাংলাদেশে থাকা জাহিদ হায়দারকে এই সংবাদ পৌঁছে দেন।
কবির লাশ সৎকারের বিষয়ে মাইন চৌধুরী জানান, উনার ভাইরা জার্মানি থেকে উনার লাশ নেয়ার ব্যাপারে কোনো আগ্রহ প্রকাশ করেননি। কবিকে যতো তাড়াতারি সম্ভব জার্মানিতেই দাফন করতে বলেছেন কবির পরিবার। আমরা যারা কবির সুহৃদ রয়েছি তারাও দেখছি কীভাবে কী করা।
তিনি আরো জানান, জার্মানির কিছু নিয়ম কানুন রয়েছে। এগুলো শেষ করে যখন তারা বলবে তখন আমরা লাশ দাফন করতে যাবো। এখানে জার্মান কর্তৃপক্ষই আমাদের তারিখ জানাবে। আমরা শুধু যাবো। আমরা এখনও তারিখ পাইনি। কবি যেহেতু লিখিত দিয়ে যান নি, এজন্য তার লাশ মেডিকেলে দান করা সম্ভব হবে না।
মাইন চৌধুরী জানান, কবির একজন ভাগ্নি লোপা নেদারল্যান্ডস থাকেন। তিনিও কবিকে দেখতে আসবেন।
মাইন চৌধুরী স্ত্রী ও কবির সুহৃদ রিতা শেফার জানান, কবির সাথে তাদের পারিবারিক সম্পর্ক ছিল। তিনি বাচ্চাদের খুবই আদর করতেন। তাদের বাচ্চা মেয়েকে দাউদ হায়দার অনেক ভালোবাসতেন। প্রায় ৩৫ বছরের পরিচয়ে যতোদিন বাড়িতে দাওয়াত খেতে এসেছেন কিছু না কিছু তার মেয়ের জন্য কবি নিয়ে এসেছেন।
মাইন চৌধুরী কবির শেষ দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করে বলেন, গত বছর ১২ ডিসেম্বরের পর দাউদ হায়দার একদমই কথা বলতে পারতেন না। তবে এর আগে প্রায় প্রতিদিনই তাদের দেখা হতো। তিনি দেশ নিয়ে কথা বলতেন। শারীরিক ভাবে না থাকলেও তার মন ও চিন্তা-ভাবনা দেশ নিয়েই থাকতো। আসলে, মানুষ তার সম্পর্কে যা জানে সবই সঠিক নয়। মানুষকে বাইরে থেকে বোঝা যায় না।
তিনি আরো জানান, কবি চিরকুমার ছিলেন। তবে অসুস্থ হওয়ার আগে তিনি অনেক ব্যস্ত থাকতেন। কবিতা লিখতেন, থিয়েটার করতেন। সাংবাদিকতা করতেন। উনার সাথে কলকাতার কবি-সাহিত্যিকদের ভালো সম্পর্ক ছিল। উনি ১৯৭৪ সাল থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের প্রখ্যাত কবি অন্নদাশঙ্কর রায়ের বাড়িতেই ছিলেন। যার কারণে উনার সাথে বাংলাভাষী কবিদের গভীর সম্পর্ক ছিল। শেষ দিনগুলোতে উনি অবসরভাতা পেতেন। তা দিয়ে উনি স্বাচ্ছন্দে উনার দিন কাটাতে পারতেন বলেও যোগ করেন কবির প্রায় ৩৫ বছরের জার্মানির এই সুহৃদ।
মাইন চৌধুরী বলেন, শুধুমাত্র আদালত কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত অভিভাবক হিসেবে নয়, কবির একজন পারিবারিক বন্ধু হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে বলছি, উনি কখনো ধর্ম নিয়ে কটূ কিছু বলেননি। উনি প্রগতিশীল ছিলেন কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীল ছিলেন না। অন্যের মতের উপর কখনো নিজের মত চাপিয়ে দিতেন না। উনি মাটির মতো সহজ-সরল মানুষ ছিলেন।
প্রসঙ্গত, ১৯৭৪ সালে শেখ মুজিবুর রহমান সরকার কর্তৃক বাংলাদেশ থেকে জোরপূর্বক নির্বাসনের পর ১২ বছর কবি কলকাতায় প্রখ্যাত সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায়ের বাড়িতে ছিলেন। এসময় তিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনাও করেন। ১৯৮৬ সালে নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক গুন্টার গ্রাস কবিকে জার্মানিতে নিয়ে আসেন।
প্রসঙ্গত, কবি দাউদ হায়দার ২৬ এপ্রিল রাতে (২৭ এপ্রিল বাংলাদেশ সময় ভোরে) জার্মানির বার্লিনে মৃত্যুবরণ করেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৬২৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৭, ২০২৫
এমএম
বাংলাদেশ সময়: ৪:৩১ পিএম, এপ্রিল ২৭, ২০২৫ /