ঢাকা, মঙ্গলবার, ২২ বৈশাখ ১৪৩২, ০৬ মে ২০২৫, ০৮ জিলকদ ১৪৪৬

মুক্তমত

আত্মঘাতী ‘মানবিক করিডর’

অদিতি করিম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯:২৩, মে ৫, ২০২৫
আত্মঘাতী ‘মানবিক করিডর’ অদিতি করিম

সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের একটি ‘নীতিগত অবস্থান’ রাজনৈতিক অঙ্গনে তীব্র বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। সাধারণ মানুষকে করেছে উদ্বিগ্ন।

মিয়ানমারের রাখাইনের মধ্যে একটি ‘মানবিক করিডরের’ প্রস্তাবে সরকারের ইতিবাচক অবস্থান সব মহলকে বিস্মিত করেছে। সরকার যদি এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে তা হবে আত্মঘাতী। আমাদের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতার জন্য হুমকি।

মিয়ানমারের রাখাইনে বিপন্ন জাতিগোষ্ঠীর জন্য ‘মানবিক সহায়তা’ পাঠানোর জন্য বাংলাদেশের ভিতর দিয়ে যে একটি চ্যানেল বা করিডর তৈরি করা হবে, তার প্রথম ইঙ্গিত পাওয়া যায় ফেব্রুয়ারি মাসে। গত ৭ ফেব্রুয়ারি নিউইয়র্কে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা সমস্যা ও অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়াবলিসংক্রান্ত বিশেষ প্রতিনিধি খলিলুর রহমানের আলোচনায় ‘হিউম্যানিটারিয়ান চ্যানেল’ বা মানবিক করিডরের বিষয়টি প্রথমে উত্থাপিত হয়। এর এক মাস পর গত মার্চে বাংলাদেশ সফরে আসেন জাতিসংঘ মহাসচিব। এ সময় তিনি পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে যৌথ সম্মেলনে বলেছিলেন, মিয়ানমারে লড়াই বন্ধ ও সেখানে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং মিয়ানমারের সব প্রতিবেশী দেশের চাপ বৃদ্ধি করা অত্যন্ত জরুরি। এর প্রথম ধাপ হবে সহিংসতা বন্ধ করা এবং একই সঙ্গে এমন কার্যকর ব্যবস্থা গঠন করা, যা মিয়ানমারে প্রকৃত গণতান্ত্রিক সমাধানের পথ সুগম করবে- যা স্বাভাবিকভাবেই রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনকে সহজ করবে। তাঁর বক্তব্যে দুটি বিষয় খুব স্পষ্ট ছিল- ১. আরাকান আর্মি একটি সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ যেন তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে এবং ২. রাখাইনে সহায়তা পাঠাতে যেন বাংলাদেশ একটি চ্যানেল (করিডর) তৈরি করে। গত ৮ এপ্রিল খলিলুর রহমানকে উদ্ধৃত করেই গণমাধ্যমে বলা হয়, রাখাইনে ‘মানবিক সহায়তার চ্যানেল’ হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ।

প্রসঙ্গত, ফেব্রুয়ারি মাসে খলিলুর রহমান যখন জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে আলাপ করেন তখন তিনি ছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা সমস্যা ও অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়াবলিসংক্রান্ত বিশেষ প্রতিনিধি। আর যেদিন (৮ এপ্রিল) বললেন যে, রাখাইনে ‘মানবিক সহায়তার চ্যানেল’ হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ-তার পরদিনই তাকে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। সর্বশেষ গত ২৭ এপ্রিল বিকালে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন সাংবাদিকদের জানান, গৃহযুদ্ধে পর্যুদস্ত রাখাইন রাজ্যে মানবিক সহায়তা পৌঁছে দিতে বাংলাদেশের কাছে জাতিসংঘ ‘করিডর’ দেওয়ার যে অনুরোধ জানিয়েছিল, তাতে অন্তর্বর্তী সরকার নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে। এর পরই রাজনৈতিক অঙ্গনে এ নিয়ে শুরু হয়েছে বিরূপ প্রতিক্রিয়া।

করিডর ইস্যুতে সরকারের সমালোচনা করছে বিএনপি ও জামায়াত। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘রাখাইনে করিডর ইস্যুতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সরকারের উচিত ছিল সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করা। ’ ফখরুল বলেন, ‘বিএনপি এ অঞ্চলে গাজার মতো আরেকটি পরিস্থিতি দেখতে চায় না। ’ অন্যদিকে করিডরের বিষয়টি পরিষ্কার করার আহ্বান জানিয়েছেন জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমানও। প্রশ্ন হলো, এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা না করেই একটি অনির্বাচিত অন্তর্বর্তী সরকার কেন এ বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিল? জাতিসংঘ চেয়েছে বলে? জাতিসংঘ সব সময় কি বাংলাদেশের কল্যাণে কাজ করবে? জাতিসংঘ কি এ অঞ্চলে নতুন কোনো রাষ্ট্র গঠন বা কোনো একটি দেশে বা দেশের সীমান্তে যুদ্ধাবস্থা তৈরি হলে তার দায় নেবে? জাতিসংঘ যে মানবিক সংকটের কথা বলছে, তারা কি পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মানবাধিকারের প্রশ্নে সরব?
দেশের ভিতর রাজনৈতিক ঐকমত্য ছাড়া এবং একই সঙ্গে মিয়ানমারে জান্তা সরকার ও আরাকান আর্মি ছাড়াও মিয়ানমারে প্রভাব আছে- এমন আঞ্চলিক সব পক্ষ একমত না হলে প্রস্তাবিত করিডরটি বাংলাদেশের জন্য সামরিক ও নিরাপত্তাঝুঁকি তৈরি করতে পারে।

করিডর দেওয়ার বিনিময়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে মিয়ানমার তথা রাখাইনে ফেরত পাঠানো যাবে-তার কি কোনো সম্ভাবনা রয়েছে? কেননা রোহিঙ্গাদের ধর্মীয় পরিচয় মুসলিম বলে আরাকান আর্মি তাদের স্বীকার করে না। বরং তারা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি মুসলিম হিসেবে বিবেচনা করে। যারা রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবেই মনে করে না, তারা এ রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে সহায়তা করবে, সেটি ভাবার কোনো কারণ নেই। উপরন্তু মিয়ানমার সরকারও ঠিক একই কারণে রোহিঙ্গাদের উৎখাত করেছে। অর্থাৎ রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে মিয়ানমার সরকার ও আরাকান আর্মির দৃষ্টিভঙ্গিতে খুব বেশি ফারাক নেই।

জাতিসংঘ এবং বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার কি মনে করছে যে, স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে সশস্ত্র সংগ্রামরত আরাকান আর্মিকে সহযোগিতার বিনিময়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পথ সুগম হবে? সেক্ষেত্রে মিয়ানমার সরকারের ভূমিকা কী হবে? ইতোমধ্যে মিয়ানমারের জান্তা সরকার এ ধরনের করিডরে তাদের আপত্তির কথা জানিয়েছে।

রাখাইনে মানবিক সহায়তা পাঠানোর জন্য করিডর দেওয়ার ফলে বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত একটি প্রক্সি ওয়ারে জড়িয়ে যাবে কি না-সেই প্রশ্নও রয়েছে। তা ছাড়া বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত এবং বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলে সক্রিয় সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো সক্রিয় হবে কি না এবং সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য আরেকটা বিপদ তৈরি হবে কি না, সেটিও ভেবে দেখা দরকার। কক্সবাজার এবং পার্বত্য অঞ্চল আমাদের জন্য নানা কারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতর। বাংলাদেশের সবচেয়ে পর্যটনসমৃদ্ধ এলাকা কক্সবাজার। এমনিতেই বিগত সরকারের একটি ভুলের কারণে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা ২০১৭ সাল থেকে বাংলাদেশে একটা ‘বোঝা’ হয়ে আছে। এ রোহিঙ্গাদের দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার কোনো সফল উদ্যোগ বিগত সরকার নেয়নি। এর ফলে একদিকে যেমন কক্সবাজারের সৌন্দর্য এবং পর্যটন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অন্যদিকে পরিবেশ বিপর্যয়ের এক ভয়ংকর ঝুঁকির মধ্যে আছে এই পর্যটন নগরী। এরকম একটি বাস্তবতায় যদি ‘মানবিক করিডর’ দেওয়া হয় তাহলে আমাদের পর্যটনের প্রধান আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে যাবে। সৌন্দর্যের লীলাভূমি কক্সবাজার হবে যুদ্ধক্ষেত্র। গোটা দেশ হয়ে পড়বে অস্থিতিশীল।

পৃথিবীর ‘মানবিক করিডর’-এর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, যেসব দেশ এ ধরনের মানবিক করিডর দিয়েছিল তাদের প্রত্যেককে ভুগতে হয়েছে। অনেক জায়গায় নিরাপত্তাঝুঁকি তৈরি হয়েছে। এমনকি অনেক জায়গায় মানবিক করিডরে হামলায় সাধারণ নিরীহ জনগোষ্ঠীর প্রাণহানি হয়েছে।

নাৎসি নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলো থেকে ইহুদি শিশুদের যুক্তরাজ্যে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল ১৯৩৮-৩৯ সালে। অভিজ্ঞতা ছিল শোচনীয়। নিরাপত্তা পরিষদের নেওয়া প্রস্তাবের ভিত্তিতে বসনিয়ার সারায়েভোতে ১৯৯২-৯৫ সালে এবং ২০১৮ সালে সিরিয়ার ঘৌতা থেকে বেসামরিক লোকজনকে সরিয়ে আনার জন্য মানবিক করিডর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। এটিও আত্মঘাতী হিসেবে বিবেচিত হয়। প্রথম আর্মেনিয়া-আজারবাইজান যুদ্ধের (নাগার্নো-কারাবাখ যুদ্ধ) সময় ১৯৮৯ সালে লাচিন করিডর স্থাপিত হলেও সেটি দুই বছরের মধ্যেই বন্ধ করে দিয়েছিল আজারবাইজান সরকার। কারণ এতে আজারবাইজানের নিরাপত্তাই বিপন্ন হয়। ১৯৯৩ সালে নিরাপত্তা পরিষদের এক প্রস্তাবের মাধ্যমে সেব্রেনিৎসা ছিটমহলকে নিরাপদ এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পরে ওই বছরেই আরেক প্রস্তাবের মাধ্যমে সারায়েভো, জেপা, গোরাজদে, তুজলা ও বিহাচকেও এর অন্তর্ভুক্ত করে মোট ছয়টি মানবিক করিডর প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু নিরাপদ এলাকাগুলোকে কীভাবে সুরক্ষিত রাখা হবে তার কোনো রূপরেখা ছিল না। ফলে পরে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়। ১৯৯৫ সাল নাগাদ সেব্রেনিৎসায় গণহত্যার পরিস্থিতি তৈরি হয়।

ইয়েমেনের চলমান যুদ্ধের মধ্যে বারবার এমন করিডরের আহ্বান জানিয়েও সফল হয়নি জাতিসংঘ। আফ্রিকার কঙ্গোয় ২০০৮ সালে রাষ্ট্রীয় বাহিনী এবং জেনারেল লরেন্ট নকুন্ডার নেতৃত্বাধীন মিলিশিয়া বাহিনীর মধ্যে সশস্ত্র দাঙ্গা চরম আকার ধারণ করলে জাতিসংঘের প্রস্তাবে গোমা অঞ্চলে একটি মানবিক করিডর খোলার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু সেটি শেষ পর্যন্ত সামরিক নানা বিষয়ে জড়িয়ে সংকটে পড়ে যায়।

বাংলাদেশ এখন যদি এ বাস্তবতা বিশ্লেষণ করে তাহলে এ মানবিক করিডর দেওয়া হলে আমরা কী ধরনের সংকটের মধ্যে পড়তে পারি? সবচেয়ে বড় সংকট হতে পারে বিপুল পরিমাণ রাখাইন বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেবে। ১১ লাখ রোহিঙ্গার চাপে এমনিতেই আমরা অস্থির। বাড়তি চাপ বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে সামাল দেওয়া বাংলাদেশের জন্য অসম্ভব।

দ্বিতীয়ত, রাখাইন রাজ্যে আরাকান বাহিনীর সঙ্গে মিয়ানমারের সৈন্যদের যুদ্ধ হচ্ছে এবং রাখাইন রাষ্ট্রের একটি পরিকল্পনা বিভিন্ন পশ্চিমা দেশগুলোর মাথায় রয়েছে। এরকম পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশের দিকে অনেকের কু-দৃষ্টি রয়েছে। আর এ ধরনের করিডর দেওয়ার ফলে একটি রাখাইন রাষ্ট্রের সম্ভাবনা মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে। ফলে বাংলাদেশের অখণ্ডতা ক্ষুণ্ন হবে, বিপন্ন হবে সার্বভৌমত্ব। এ ছাড়াও রাখাইনে আরাকান আর্মি এবং মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধের ঢেউ আছড়ে পড়বে পুরো কক্সবাজারে। এমনকি বাংলাদেশেও। আমরা কখনোই বাংলাদেশের শান্তি বিঘ্নিত হোক তা চাইব না নিশ্চয়ই। তাই যারা এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তারা চিন্তা করবেন, বুঝেশুনে নেবেন এটাই সবাই প্রত্যাশা করে। তা ছাড়া অন্তর্বর্তী সরকার একটি ক্ষণস্থায়ী সরকার। এ সরকারের জনগণের কোনো ম্যান্ডেট নেই। এ সরকারের প্রধান কাজ হলো জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। তারা এ ধরনের নীতিনির্ধারণী স্পর্শকাতর সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। এজন্য বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান যথার্থই বলেছেন যে, সিদ্ধান্ত তুলে রাখতে হবে জনপ্রতিনিধিদের মতামতের জন্য। আমরা যেন কাউকে খুশি করতে দেশের সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে না দিই। সবার আগে দেশ- এটা মনে রাখতে হবে সবাইকে।
 
অদিতি করিম: নাট্যকার ও কলাম লেখক
সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন

এসআই
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।